ছবি : সংগৃহীত

বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ শ্লোগান লিখে গণতন্ত্রের আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেন জীবন্ত পোস্টার হয়ে আছে দেশবাসীর হৃদয়ে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে উত্তাল আন্দোলনে রাজধানী ঢাকার রাজপথে স্বৈরাচারের বাহিনীর গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন নূর হোসেন।

ঐদিন অনেক শহীদের মধ্যে আরেক নাম সৈয়দ আমিনুল হুদা টিটো। তিনি সাইকেল চালিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে গণআন্দোলনে যোগ দিতে। তিনিও শহীদ হন। তার লাশ গুম করে ফেলা হয়।

শহীদদের পথ ধরে জনগণের গণআন্দোলনে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী সরকার পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে। নূর হোসেন-সৈয়দ আমিনুল হুদা টিটোদের রক্তদান আর বুকে পিঠে লেখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ শ্লোগান আজও বহমান। আজকের দিনে তাদের বিশেষভাবে স্মরণ করি।

এই সময়ে তাকালে দেখা যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে নাকাল সাধারণ মানুষ। তারপরও এই উত্তাপকে ছাপিয়ে গেছে চলমান রাজনৈতিক উত্তাপ। এই উত্তাপ আরও তীব্রতর হচ্ছে। জনমত, সভা, সমাবেশ, বিক্ষোভ, হরতাল, অবরোধ সরকারকে তার অবস্থান থেকে টলাতে পারছে না।

অতীত থেকে আরও কঠোর অবস্থান নিয়ে সভা-সমাবেশ পণ্ড করা, গ্রেফতার, নির্যাতন, হামলা-মামলা, হুমকি-ধামকি ভয়ের রাজত্ব সবই চলছে পুরোনো কায়দায়। জীবন দিতে হচ্ছে মানুষকে। এই জীবন দেওয়ার মধ্য দিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে অনেক পরিবার। অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হচ্ছে অনেকে। সাধারণ মানুষের আর্থিক সংকটের মধ্যে জীবন-জীবিকা আরও ব্যহত হচ্ছে। কঠিন হয়ে উঠছে সবকিছু। 

...পুরো ব্যবস্থা বদল ছাড়া সাধারণ মানুষের মুক্তি নেই। কিন্তু বর্তমান সংকটে সাধারণ ও সচেতন মানুষ চায় চলমান রাজনৈতিক সংকট দূর করে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

‘দিন আনি দিন খাই’—মানুষের সংকট আরও বাড়ছে। সিন্ডিকেটের রাজত্বে রাজনৈতিক সংকটে ‘রাস্তায় খরচ বেড়ে যাওয়ার’ অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে লাফিয়ে। আর স্থানীয় উৎপাদকেরা পণ্য বিক্রিতে পাচ্ছেন না লাভজনক মূল্য। অর্থনীতির নানা সূচক ভবিষ্যতের আরও সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এইসবের মধ্যে চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও উদ্বোধন হচ্ছে মেগা প্রকল্প। নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়া থেমে নেই। নিজেদের জীবনের সংকটে এইসব উন্নয়ন প্রচার সাধারণ মানুষের জীবনকে স্পর্শ করছে না। নদীর তলদেশে টানেলের বিরাট খবর মানুষের আলোচনায় প্রধান হয়ে উঠছে না।

চলমান রাজনৈতিক সংকটই সবকিছুকে ছাপিয়ে সামনে আসছে। এই সংকটে সংঘাত-সংঘর্ষের রূপ নানা মাত্রায় বেড়ে চলছে। এই সংকট থেকে দেশবাসী মুক্তি চায়।

পুরো ব্যবস্থা বদল ছাড়া সাধারণ মানুষের মুক্তি নেই। কিন্তু বর্তমান সংকটে সাধারণ ও সচেতন মানুষ চায় চলমান রাজনৈতিক সংকট দূর করে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যেখানে সবাই নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবে। ভোট ঠিকমতো গণনা করা হবে। অদৃশ্য হাতের কারসাজি বন্ধ হবে এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনা করবে।

ছিনতাই হওয়া মানুষের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই প্রধান। পরিবারতন্ত্র, জমিদারতন্ত্র, দলতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্রের হাত থেকে মানুষ মুক্তি চায়। চায় নির্ভয়ে কথা বলতে, নিজের মতামত প্রকাশ করতে।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের প্রহসনের ভোটে নির্বাচিত সরকার জনমত উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে মানুষের মনে এই ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, আরও একটা প্রহসনের নির্বাচন সংগঠিত করে সরকার ক্ষমতায় থাকতে চাইছে।

বিরোধী দলগুলোর ওপর নির্যাতন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিরোধী মত দমনে পাহারা বসানো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা আর রাজনৈতিক দলকে একাকার করে ফেলা, নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব, সর্বশেষ বিদেশ ভ্রমণ শেষে সংবাদ সম্মেলন ও সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে একতরফা নির্বাচন নিয়ে মানুষের মনের সংশয়কে আরও গভীর করে তুলেছে।

এই সময়ে নানা অপশক্তির তৎপরতা বেড়েছে। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি (অসৎ আমলা, অসৎ ব্যবসায়ী, অসৎ রাজনৈতিক চক্র) ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনৈতিক চালকের আসনে বসছে। রাজনীতির নীতিহীন প্রতিযোগিতা চলছে।

একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধী, অগণতান্ত্রিক, সুবিধাবাদী চক্র গণতন্ত্রহীন, বিরাজনীতিকরণের ধারায় দেশকে ফেলে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে। বিদেশি শক্তিগুলো যার যার স্বার্থে তৎপরতা চালাচ্ছে। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় তাদের তৎপরতা অনেক বেশি দৃশ্যমান।

রাখঢাকের বালাই না রেখে তারা প্রকাশ্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। এতে মানুষের উদ্বেগ আরও বেড়ে চলেছে। আবার অনেক মানুষ এদের প্রতি নির্ভরতা বাড়াচ্ছে, যা মানুষের নিজস্ব শক্তিকে ভোতা করে তুলছে।

এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক শক্তিসমূহের দায়িত্বশীল আচরণ মানুষ প্রত্যাশা করে। ‘শব্দ বোমা’, ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নীতিহীন প্রতিযোগিতা মানুষ দেখতে চায় না।

এই ক্ষেত্রে সংকট নিরসনে সরকারকেই প্রধানত—দায়িত্বশীল হয়ে উদ্যোগী হতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় গ্রেফতার নির্যাতন বন্ধ করে, গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তি দিয়ে স্বস্তির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সবার সামনে এইসব পদক্ষেপ দৃশ্যমান করতে হবে। 

বিদেশি শক্তিগুলো যার যার স্বার্থে তৎপরতা চালাচ্ছে। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় তাদের তৎপরতা অনেক বেশি দৃশ্যমান।

এইসব পদক্ষেপকে বিশ্বাসযোগ্য করতে সরকারকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে ঐ সরকারের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে। অন্যদেরও সহনশীল আচরণ করতে হবে।

২৮ অক্টোবর ২০২৩ সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরকে দোষারোপ করে প্রকৃত সত্য উদঘাটনে বাঁধা দিচ্ছে এতে জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে। এর অবসানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে তার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতে হবে। পাল্টা সমাবেশ, প্রশাসন ও দলকে একাকার করে ফেলার ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

নির্বাচন কমিশনকে অধিকাংশ ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের মতামতকে উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা বন্ধ রাখতে হবে।

এইসব সমস্যার দ্রুত সমাধান দেশবাসী প্রত্যাশা করে। সরকার এই কাজে এত সহজে সাড়া দেবে না। তাই জনতার শক্তিকে জাগ্রত করে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’—এই বহমান স্লোগানে সারা দেশে গণআন্দোলন-গণসংগ্রাম গড়ে উঠলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগুবে।

এইবারের শহীদ নূর হোসেন-সৈয়দ আমিনুল হুদা টিটো দিবসে এই জাগরণের সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হবে।

রুহিন হোসেন প্রিন্স ।। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
hossainprince@yahoo.com