ছবি : সংগৃহীত

আমাদের ইতিহাসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে স্বদেশী আন্দোলন হয়, সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতো বড় বড় সাহিত্যিকরা দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন।

এইসব গান তখনকার দিনে গণআন্দোলনে গভীর প্রভাব রাখে এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করে। এই ঘরানার একটি গান আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট।’

নজরুলের এই গানটির দুই বাংলায় গভীর আবেদন রয়েছে। স্বদেশী আন্দোলনের সময় এই গানটি রচিত হলেও, দুই বাংলাতে যখনই মানুষ অন্যায়, অবিচার, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, এই গান তাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তাই অঙ্গুলিমেয় যেসব গান বাংলার ঘরে ঘরে সুপরিচিত ও আদৃত, এই গানটি তার মধ্যে একটি।

বাংলাদেশের কথা যদি বলি, তাহলে আমাদের মধ্যে যাদের একটু বয়স হয়েছে, তাদের এই বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার প্রাক্কালে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনে, উনসত্তরের আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলনে, স্বাধিকার আর গণতান্ত্রিক সংগ্রামে যখন স্বৈরাচারী পাকিস্তানিরা আমাদের নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করেছে, কারাগারে বন্দি করেছে, তখন বারবার আমরা নজরুলের গানটি গেয়েছি, আবৃত্তি করেছি। সেই সময় থেকে এই গানটি আপামর বাঙালির মনে স্থান করে নিয়েছে।

দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা জ্ঞাপনের জন্য বাঙালি যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেনের দেশাত্মবোধক গানের শরণ নেয়, তেমনি কঠোর সংগ্রামের সময় আমরা বারবার নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছি, সাহস সঞ্চার করেছি।

স্বদেশী আন্দোলনের সময় এই গানটি রচিত হলেও, দুই বাংলাতে যখনই মানুষ অন্যায়, অবিচার, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, এই গান তাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

তার কারণ হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যদের গানে দেশের প্রতি ভালোবাসার গভীর ছোঁয়া রয়েছে বটে, কিন্তু নজরুলের এই গানটি যেভাবে প্রতিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে, সেইটা গানটিকে একটি বিশিষ্ট মাত্রা দিয়েছে।

আজ আর তর্কের অবকাশ নেই, আপনি যদি বাংলাদেশের যেকোনো মানুষকে জিজ্ঞেস করেন, নজরুলের কোন গানটি তাকে সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত করে, তারা সবার আগে এই গানটির কথা উল্লেখ করবে এবং দুই চরণ মুখস্থও বলে দেবে।

আমরা সাম্প্রতিককালে প্রত্যক্ষ করলাম এই রকম একটা গান নিয়ে ভারতের এক প্রসিদ্ধ সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমান ‘পিপ্পা (২০২৩)’ নামের একটি চলচ্চিত্রের জন্য সম্পূর্ণ মনগড়া সুরে ‘কারার এই লৌহ কপাট’ গানটি সুরারোপ করেছেন।

এই কাজটি যেমন স্বেচ্ছাচারী হয়েছে, তেমনি বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত অপমানকর। এটা শুধু আমার কথা নয়, কয়েক দিনে দুই বাংলায় এর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে, নজরুল সংগীতশিল্পী বা সাধারণ শিল্পী থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে।

তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর এই গানটির পরিবর্তন যারা করেছেন, তারা জানিয়েছেন যে তারা কবি পরিবারের অনুমতিক্রমে গানটির একটা নতুন রূপ দিতে প্রয়াসী হয়েছেন। এই বিষয়ে চুক্তিপত্রের কথা গণমাধ্যমে বলা হয়েছে। 

আইনের দৃষ্টিতে তাদের এই অধিকার রয়েছে কি না সেই প্রসঙ্গে আমি যাব না। আমার বক্তব্য হলো, এটি সাংস্কৃতিক নৈতিকতার প্রশ্ন।  আইনে অধিকার থাকলেও নিজ সংস্কৃতির প্রতি সহজাত শ্রদ্ধাবোধের কারণে কিছু কিছু কাজ থেকে আমাদের বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়।

বাঙালি যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেনের দেশাত্মবোধক গানের শরণ নেয়, তেমনি কঠোর সংগ্রামের সময় আমরা বারবার নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছি, সাহস সঞ্চার করেছি।

আমি একটু অবাক হচ্ছি যে, এই কথাটা স্পষ্ট করে বলতে হচ্ছে। প্রতিটি সমাজে কিছু কিছু সাংস্কৃতিক দিকচিহ্ন রয়েছে যেটা জনগণের হৃদয়ে এমন গভীরে প্রোথিত, যে তার রূপকে ভাঙচুর করা সাধারণ মানুষের অন্তরে আঘাত করার সামিল। নানান দেশেই এইরকম সব রচনা রয়েছে। 

বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলার আপামর মানুষই জানিয়ে দিয়েছে এই গানটির ওপর এইরকম নির্মম ভাঙচুর তাদের কতখানি আহত করেছে। এই সর্বজনীন প্রতিবাদের উৎস গানের প্রতি সব বাঙালির গভীর মমতাপ্রসূত অধিকারবোধ।

আমার খানিকটা আশা ছিল যে এই প্রতিক্রিয়ার ফলে যারা গানটির এমন অবমাননা করলেন তাদের কিছুটা বোধোদয় হবে। উল্টো তারা কবি পরিবারের সাথে বোঝাপড়ার খোঁড়া যুক্তি দিয়ে নিজেদের অবস্থানে অটল রইলেন। এই কাজ আইনে সিদ্ধ কি না তা জানি না, কিন্তু সাংস্কৃতিক নৈতিকতার দৃষ্টিতে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

আমি আশা করব, এ আর রহমান এবং ‘পিপ্পা (২০২৩)’ চলচ্চিত্র কর্তৃপক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক অনুভূতির কথা বিবেচনা করে তারা গানটি যদি চলচ্চিত্রে অন্তর্ভুক্ত করতেই চান, তাহলে তা প্রমিত সুরে পুনরায় সংযোজিত করবেন।

খায়রুল আনাম শাকিল ।। নজরুল সংগীতশিল্পী