ছবি : সংগৃহীত

প্রকৃতি তার আপন ছোঁয়ায় আমাদের চারপাশে গড়ে তুলেছে সবুজ উপাদানে তৈরি সৌম্য-শান্ত ও সজীব পরিবেশ। ফলদ ও বনজ গাছগাছালি, রং-বেরঙের পাখিদের কলতান, নিরবধি বয়ে চলা ঝরনা-নদী, পাহাড় পর্বত, সাগর মহাসাগর, এসবই প্রকৃতি তার প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছেন।

পৃথিবীর সব জীবের বেঁচে থাকার মূল উপাদান গাছপালা ও সবুজ বনাঞ্চল। মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে প্রয়োজন নির্মল বায়ুর। আর তার পুরোটাই আসে গাছপালা ও বনাঞ্চল থেকে। প্রাণীকুলের এই অমোঘ প্রয়োজন পূরণার্থে সৃষ্টি হয়েছে নানা ধরনের বৃক্ষরাজি এবং প্রাণী।

প্রাণীকুলের বসবাসের জন্য রাখা হয়েছে আলাদা বনভূমি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, কিছু স্বার্থান্বেষী ও লোভী মানুষের লালসার মুখে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষরাজি ও বনাঞ্চল। ইদানীং পত্রিকা খুললেই বিভিন্ন জায়গায় বন দখল করে উন্নয়ন প্রকল্পের খবর দেখতে পাই যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত প্রকল্পের মাধ্যমে যে পরিমাণে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে, সেই তুলনায় রোপণ হচ্ছে অনেক কম। যার ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, অনাবৃষ্টি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

মৌলভীবাজারের জুড়ীর সংরক্ষিত বন লাঠিটিলায় ৫ হাজার ৬৩১ একর জায়গাজুড়ে এক হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা দিয়েছে বন বিভাগ। এখন দেশে গাজীপুর ও কক্সবাজারে দুটি সাফারি পার্ক রয়েছে। আরেকটি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সংরক্ষিত বন লাঠিটিলায়।

দেশে প্রতিষ্ঠিত দুটি সাফারি পার্কের কাজই এখনো পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়নি তার মধ্যে আরেকটি সাফারি পার্ক তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবাদীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। সংরক্ষিত বনে স্থাপনা নির্মাণ তো দূরে থাক, প্রবেশ করতেও বন বিভাগের অনুমতি লাগে। সেইখানে লাঠিটিলায় বনাঞ্চল কেটে রাস্তা, পাহাড় কাটা, হেলিপ্যাড, স্কাইওয়াক এবং প্রাণী হাসপাতাল ভবন নির্মাণের কথাও বলা হয়েছে প্রকল্প প্রস্তাবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ (বাপা)-সহ অনেক পরিবেশবাদী সংগঠন লাঠিটিলা বনে সাফারি পার্ক প্রকল্পকে বন ধ্বংসের আয়োজন বলে উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে।

বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত প্রকল্পের মাধ্যমে যে পরিমাণে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে, সেই তুলনায় রোপণ হচ্ছে অনেক কম। যার ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, অনাবৃষ্টি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

লাঠিটিলা বনকে ১৯২০ সালে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়। প্রস্তাবিত এই সাফারি পার্কে বেশ কয়েকটি শ্রেণিতে সড়ক নির্মাণ করা হবে। পরিবেশ সংরক্ষণ নীতিমালা অনুযায়ী, কোথাও ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত সড়ক নির্মিত হলে তা কমলা শ্রেণির প্রকল্প। এই শ্রেণির প্রকল্প হলে সেইখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র প্রয়োজন কিন্তু সেই প্রকল্প প্রস্তাবে নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। এছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালায় সরকারঘোষিত বনভূমি এলাকায় প্রকল্পের স্থান নির্বাচন পরিহারের কথা বলা হয়েছে। অথচ প্রস্তাবিত এই সাফারি পার্ক প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে জুড়ী রেঞ্জের লাঠিটিলা বিটের চিরসবুজ বনে।

দেশের উত্তর-পূর্ব বনাঞ্চলে ৩৬টি ভিন্ন পরিবারের ১২৬টি স্থলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীর তথ্য মিলেছে। মায়া হরিণ, বুনো শূকর, উল্লুক, উল্টোলেজি বানরসহ নানা জাতের বিরল ও বিপন্ন প্রাণীর বসবাস রয়েছে লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে। সুন্দরবন ছাড়া শুধুমাত্র এই বনেই ক্ষুদ্র নখযুক্ত উদ্‌বিড়াল রয়েছে। তেলসুর, বৈলাম, চন্দন, উদালের মতো বিরল প্রজাতির বৃক্ষের আধারও দেশের অন্যতম এই ক্রান্তীয় চিরসবুজ বনভূমি। দুই বছরে এই অঞ্চলে ব্যাঙের দুটি নতুন প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার কক্সবাজারে একের পর এক দখল আর বন্দোবস্তে হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়-বনভূমি। রক্ষা পাচ্ছে না ‘প্রতিবেশ সংকটাপন্ন’ বনাঞ্চলও। ইতিমধ্যে এখানকার মোট বনভূমির ২৫ শতাংশ দখল হয়ে গেছে। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দখলদার ৪৪ হাজারের বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মেরিন ড্রাইভের কাছাকাছি শুকনাছড়ি এলাকায় বড় বড় পাহাড়। এসব পাহাড় ব্রিটিশ আমলে ‘সংরক্ষিত বন’ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে এগুলো ‘প্রতিবেশ সংকটাপন্ন’ বনভূমি ঘোষণা করে। কিন্তু ২০২১ সালে এই এলাকার ৭০০ একর বনভূমি ‘একাডেমি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বানাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের। যদিও তা উচ্চ আদালতের নির্দেশে আপাতত স্থগিত রয়েছে।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের আবাসিক প্রশিক্ষণ একাডেমি তৈরি করার জন্য ২০২২ সালের কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের পাশে খুনিয়াপালং মৌজায় ২৫ একর সংরক্ষিত বন দেওয়া হয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)-কে। এই জায়গা বরাদ্দের সময়ও আপত্তি জানিয়েছে বন বিভাগ।

‘একাডেমি স্থাপনে সেইখানে পাহাড়ের পাশাপাশি কাটা পড়বে প্রায় ৩০ হাজার গাছ। বনটি মহাবিপদাপন্ন এশিয়ান হাতির আবাসভূমি। একাডেমি স্থাপনে বনের হরিণ, শূকর, বানরসহ অনেক প্রজাতির পশুপাখি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

২০২২ সালে কক্সবাজার বিভাগীয় বন কার্যালয়ের তথ্যমতে, কক্সবাজারে ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ হাজার ২৮৮ একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউট, শহীদ এটিএম জাফর আলম মাল্টিডিসিপ্লিন একাডেমি ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠান। ফেরত দেওয়ার শর্তে ২০২১ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়কে বনের ১২ হাজার ৩৪১ দশমিক ৮১ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেইখানে পাহাড় ও গাছ কেটে তৈরি করা হচ্ছে স্থাপনা; চাষ হচ্ছে চিংড়ি।

বাংলাদেশের বনভূমি কমে যাওয়ার মূল কারণ অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বনভূমি উজাড় করার সংস্কৃতি থেকে আমরা এখনো বের হয়ে আসতে পারিনি।

মধুপুর গড় বা মধুপুর শালবন বাংলাদেশের কেন্দ্রভাগে অবস্থিত একটি বৃহৎ বনভূমি এলাকা। ২০০০ সালে শালবনের ৩০০০ একর কোর এলাকাকে ৬১,০০০ রানিং ফুট দেয়াল দিয়ে ঘিরে বিতর্কিত ‘ইকোট্যুরিজম প্রকল্প’ শুরু হয়। মধুপুরের বনভূমিতে ইকো-ট্যুরিজম প্রকল্প একটি দীর্ঘদিনের চলমান সমস্যা।

এশিয়ার যে দেশগুলোয় বনের পরিমাণ সবচেয়ে কম সেইখানে বাংলাদেশের অবস্থান শেষের দিক থেকে তিন নম্বরে। বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ বা নিচের অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান ও মঙ্গোলিয়া। বাংলাদেশের বনভূমি কমে যাওয়ার মূল কারণ অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রকৃতি এবং পরিবেশ প্রাধান্য না দেওয়া এবং প্রকল্পের স্থান নির্ধারণে পরিবেশ এবং প্রাণী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ না করার কারণেই দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ ঝুঁকিতে চাচ্ছে বাংলাদেশ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বনভূমি উজাড় করার সংস্কৃতি থেকে আমরা এখনো বের হয়ে আসতে পারিনি।

প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য কোনো দেশের মোট ভূমির ৩৩ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৪৭ সালে দেশের আয়তনের ২৪ শতাংশ বনভূমি ছিল। ১৯৮০-৮১ সালে তা কমে হয় ১৭.২২ শতাংশ এবং বর্তমানে আছে ১৭.৫ শতাংশ। সঠিক পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন প্রকল্পে স্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রকৃতি-পরিবেশ এবং বনভূমিকে গুরুত্ব না দিলে ভবিষ্যতে বনভূমি আরও কমতে থাকবে।

এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের বন ও পরিবেশব্যবস্থা হুমকিতে রয়েছে। যতটুকু সংরক্ষিত বন বিদ্যমান আছে, তার পুরোটা সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে এবং নতুন নতুন বনভূমি সৃজন করতে হবে। সংরক্ষিত তো বটেই, যেকোনো বনের মধ্যে প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসকারী অবকাঠামো নির্মাণ ব্যতিরেকে কীভাবে বন রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি-২০০১ এর অনুচ্ছেদ ১৭ অনুযায়ী, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ঘোষিত বনাঞ্চল বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত থাকবে এবং বনভূমির সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই নীতি বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে অন্যথায় দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ ঝুঁকিতে থাকতে হবে আমাদের।

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com