বঙ্গাব্দের প্রবর্তক কে? শশাঙ্ক, আকবর, নাকি মুর্শিদকুলী খান? শশাঙ্কের মৃত্যুর পরের বছর ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ পরিভ্রমণে আসা হিউ এন সাঙ বাংলা অঞ্চলে ‘ভাস্করাব্দ’ নামে একটি সন প্রচলিত থাকার কথা লিখেছেন, বঙ্গাব্দের উল্লেখ করেননি। বঙ্গাব্দ প্রচলন করার গৌরব ভারতবর্ষের কোনো শাসককে দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক অঞ্চল, যেমন, ব্রহ্মদেশ, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, চীনের ইউনান প্রদেশের দাই বা থাই জাতি অধ্যুষিত এলাকা, দক্ষিণ ভারতসহ ভারতের নানা এলাকা ও শ্রীলঙ্কায় এপ্রিল মাসের ১৩/১৪/১৫ তারিখে নতুন বছর শুরু হয়।

কোনো অব্দের প্রথম দিনটি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে অতীতে দুটি বিষয় বিবেচিত হতো: ১. জ্যোতিষশাস্ত্র আর ২. খাজনা আদায়ের সুবিধা। বিভিন্ন নক্ষত্রের মধ্যে কল্পিত রেখা টেনে সিংহ, বৃষ, কর্কট ইত্যাদি বারোটি রাশি কল্পনা করা হয় জ্যোতিষশাস্ত্রে। প্রতিমাসে সূর্য নতুন রাশিতে প্রবেশ করার সময়টিকে বলা হয় ‘সংক্রান্তি’। হেমন্ত আর গ্রীষ্ম ঋতুর সূচনার মধ্যবর্তী সংক্রান্তিগুলো (উত্তরায়ণ বা মকর, মহোদরী বা বিষ্ণুপদী, ষড়শীতি এবং মহাবিষুব) এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নববর্ষের প্রথম দিন নির্বাচিত হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে, ফসল তোলার পর খাজনা আদায় সুবিধাজনক বলে। প্রাচীন ভারতে একটি ধর্মবিশ্বাস ছিল এই যে, ডিসেম্বর-জানুয়ারির উত্তরায়ণ থেকে পরবর্তী ছয় মাস স্বর্গলোকের দিবাভাগ। (দিনে ভ্রমণ নিরাপদ বলে!) এই পবিত্র সময়কাল স্বর্গে যাওয়ার জন্যে প্রশস্ত। মহাভারতে পিতামহ ভীষ্ম দেহত্যাগের জন্যে শরশয্যায় শুয়ে উত্তরায়ণের অপেক্ষা করেছিলেন।

প্রাচীন ভারতবর্ষে অগ্রহায়ণ মাসে বছর শুরু হতো, কারণ ‘অগ্রহায়ণ’ শব্দে অন্তর্ভুক্ত সংস্কৃত ‘হায়ণ’ শব্দের অর্থ ‘বৎসর’। প্রাচীন ইউরোপে দশ মাসের বছর শেষ হতো উত্তরায়ণ সংক্রান্তির কাছাকাছি সময়ে দশম মাস ডিসেম্বরে। উত্তরায়ণ ও মহোদরী সংক্রান্তির মাঝে পড়ে চীনা নববর্ষ (২১ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে)। ষড়শীতি (১লা চৈত্র) সংক্রান্তিতে কাশ্মীরের নববর্ষ ‘নাভ্রে’, কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশের ‘উগাডি’, মহারাষ্ট্রের ‘গুড়ি পাড়োয়া’, সিন্ধু দেশের ‘ছেতি চাঁদ’, পশ্চিম ভারতের ‘শকাব্দ’ (২২ মার্চ) এবং মধ্য এশিয়ার ‘নওরোজ’ (২০ মার্চ)। মহাবিষুব সংক্রান্তিতে (১৩/১৪/১৫ এপ্রিল) নববর্ষ হয় শ্রীলঙ্কা, ভারতের মণিপুর, তামিলনাডু, কেরালা, উড়িষ্যা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, (ভারত ও পাকিস্তানের) পাঞ্জাব, বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, চীনের দাইজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে।

কোনো অব্দের প্রথম দিনটি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে অতীতে দুটি বিষয় বিবেচিত হতো: ১. জ্যোতিষশাস্ত্র আর ২. খাজনা আদায়ের সুবিধা। বিভিন্ন নক্ষত্রের মধ্যে কল্পিত রেখা টেনে সিংহ, বৃষ, কর্কট ইত্যাদি বারোটি রাশি কল্পনা করা হয় জ্যোতিষশাস্ত্রে। প্রতিমাসে সূর্য নতুন রাশিতে প্রবেশ করার সময়টিকে বলা হয় ‘সংক্রান্তি’।

অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে এক সময় প্রোটো-অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর মানুষেরা বসবাস করতো বলে ধারনা করা হয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মধ্য এপ্রিলে বর্ষ শুরু করার প্রথাটা হয়তো এরাই চালু করেছিল। দক্ষিণ এশিয়ার অনার্য সংস্কৃতির সঙ্গে হিন্দু-বৌদ্ধ তথা আর্য সংস্কৃতির মিশ্রণের ফলশ্রুতি থেকে এই সনটি। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সমজাতীয় আবহাওয়াও মধ্য এপ্রিলে বর্ষ শুরুর কারণ হতে পারে।

থাই জাতির উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক। দক্ষিণ চীন থেকে থাইল্যান্ডে অভিবাসন করা দাই বা থাই জাতি প্রথমে চীনা সৌর-চন্দ্র সন অনুসরণ করতো (থাইল্যান্ডের কোথাও কোথাও এখনও চীনা নববর্ষ পালন করা হয়)। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল, মধ্য এপ্রিলে শুরু হলে বর্ষটি থাইল্যান্ডের আবহাওয়ার সাথে অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ হয়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে জাতীয় উৎসব ‘সঙ্করণ’ (‘সংক্রান্তি’র অপভ্রংশ) উপলক্ষে অফিস-আদালত-স্কুল-কলেজ ছুটি থাকে। (হোলিতে রঙ বা আবির ছিটানোর মতো) একে অপরের গায়ে জল ছিটিয়ে দেওয়া এই উৎসবের অন্যতম অঙ্গ। এই রঙ বা জল ছিটানো আর নববর্ষ পালনের প্রথাটি ভারতবর্ষ থেকে বহির্ভারতে গিয়েছে, নাকি বহির্ভারত থেকে ভারতবর্ষে এসেছে তা স্থির করা গবেষণা সাপেক্ষ।

বাংলা-আসাম অঞ্চলে একাধিক থাই-বর্মী-চীনা বংশোদ্ভূত নৃ-গোষ্ঠী মধ্য এপ্রিলে বিহু (বিষুব?) উৎসব পালন করে থাকে। শশাঙ্ক-আকবরের জন্মেরও বহু পূর্বে আদিবাসী-হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান-আস্তিক-নাস্তিক, এমনকি বাঙালি হতে শুরু করারও বহু আগে থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক জাতি-উপজাতি-নৃগোষ্ঠীর মতো আমাদের আদিবাসী-উপজাতি পূর্ব পুরুষেরাও মধ্য এপ্রিলে শুরু হওয়া এই সনটিই সম্ভবত ব্যবহার করতো তাদের দৈনন্দিন জীবনে, ব্যবসায়ে, কৃষিকাজে।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মধ্য এপ্রিলে শুরু হওয়া সব অব্দের বর্ষ সংখ্যা এক নয়। এবছর ১৪২৮ বঙ্গাব্দ হওয়ার কারণ সম্রাট আকবরের একটি সিদ্ধান্ত। তুর্কি, সুলতানি ও মুঘল আমলের প্রথম দিকে হিন্দুস্তানে সরকারি কাজকর্মে ব্যবহৃত হতো হিজরি সাল। চন্দ্র বর্ষ হওয়ার কারণে হিজরি সালের প্রথম মাস মহরমের পহেলা তারিখটা সব বছর ফসল তোলার সময়ে পড়তো না। চর্মচক্ষে চাঁদ দেখা না গেলে হিজরি মাস শুরু হয় না বলে ৩৫৪ দিনের হিজরি সন ৩৬৫ দিনের সৌর সনের চেয়ে ছোট হয়। আবুল ফজলের মতে, কোনো দেশে যদি চন্দ্র বর্ষ অনুসরণ করে খাজনা আদায় করা হয় তবে ৩০ সৌর বর্ষ = ৩১ চন্দ্র বর্ষ হওয়ার কারণে প্রতি ত্রিশ বছরে কৃষককে এক বছরের খাজনা বেশি দিতে হয়।

হিজরি সনের অর্থনৈতিক ও প্রায়োগিক সমস্যা সমাধানকল্পে আকবরের নির্দেশে ৯৯২ হিজরিতে (১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ) ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ নামে নতুন একটি ফসলি সাল প্রবর্তিত হয়। তবে ইলাহি সন গণনা শুরু হয় ৯৬৩ হিজরি বা ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে, কারণ সেই বিশেষ বছরটিতে দুটি ঘটনা ঘটেছিল: ১.পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে আকবর ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করেছিলেন এবং ২. বৈশাখ মাস আর মহরম মাস এক সাথে পড়েছিল। ইলাহি আর হিজরি সনের বর্ষ সংখ্যা এক রাখা হয়েছিল সম্ভবত সাম্রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মানুভূতিতে আঘাত না দেওয়ার জন্যে এবং দীর্ঘদিন যাবৎ প্রচলিত হিজরি বর্ষ ব্যবহারের অভ্যাস অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে। ৯৬৩ ইলাহি/হিজরির ৪৫৯ বছর পরে আজ (৯৬৩+৪৫৯) ১৪২২ বঙ্গাব্দ, কিন্তু ১৪৩৬ হিজরি হওয়ার কারণ হচ্ছে, সাড়ে চার শতকের মাথায় হিজরি সাল (সৌরবর্ষের ৩৬৫দিন - হিজরি সনের ৩৫৪ দিন = ১১ দিন x ৪৫৯ বছর = ৫০৪৯ দিন / হিজরি সনের ৩৫৪ দিন) ১৪ বৎসর ৯৩ দিন এগিয়ে গেছে। এ যাবৎকাল পর্যন্ত হিজরি সন চালু থাকলে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের জনগণকে ১৪ বছর তিন মাসের খাজনা ও আয়কর বেশি দিতে হতো।

জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বঙ্গাব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে ব্যবসায় ও কৃষিকাজে। বঙ্গাব্দ বৃহৎ ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত এই অর্থে যে বাংলা মাসের নামগুলোর মূলে আছে বিভিন্ন নক্ষত্রের সংস্কৃত নাম ‘বিশাখা’ (বৈশাখ), ‘মঘা’ (মাঘ), পূষা (পৌষ), ‘উত্তর-আষাঢ়া’ (আষাঢ়), ‘শ্রবণা’ (শ্রাবণ), ‘কৃত্তিকা’ (কার্তিক), ‘ফাল্গুনী’ (ফাল্গুন)।

ইলাহি সনের মাসের নামগুলো ফার্সি (কানওয়াদিন, আর্দি, ভিহিশু, তীর, আমাদাদ, শাহরিয়ার, আমান, আযুর, দাই, বাহাম, ইস্কান্দর ও মিয) রাখা হয়েছিল সম্ভবত মুঘল সাম্রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা ফার্সি ছিল বলে। আকবর কেন মধ্য এশিয়ার নওরোজের পরিবর্তে ১লা বৈশাখকে বর্ষশুরুর দিন নির্বাচন করেছিলেন? ভারতবর্ষের বহু এলাকায় তখনও সম্ভবত ১লা বৈশাখেই বর্ষ শুরু হতো (বৈশাখ মাসের সাথে মহরম মাসকে মেলানোর চেষ্টা এর প্রমাণ)। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধযাত্রা থেকে শুরু করে শিবির-স্থাপন, নগর-নির্মাণ ইত্যাদি সব কাজেই মুঘল সম্রাটেরা হিন্দু জ্যোতিষীদের মত নিতেন। রাশিচক্রের প্রথম রাশি মেষ বিধায় এই রাশিতে সূর্য প্রবেশের কালে এবং উত্তরায়ণের মধ্যভাগে মহাবিষুব সংক্রান্তিতে বর্ষ শুরু হওয়া ভারতীয় জ্যোতিষমতে অতি শুভ।

আরব-পারসিক-ভারতীয় সংস্কৃতির সমন্বয়ের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ তারিখ-ই-ইলাহি কোনো অজ্ঞাত কারণে ‘বঙ্গাব্দ’ নামে বাংলা অঞ্চলে এখনও চালু আছে। বাঙালি হিন্দু ও বৌদ্ধদের ধর্মীয় কাজকর্মে এখনও বঙ্গাব্দ অনুসৃত হয়। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বঙ্গাব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে ব্যবসায় ও কৃষিকাজে। বঙ্গাব্দ বৃহৎ ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত এই অর্থে যে বাংলা মাসের নামগুলোর মূলে আছে বিভিন্ন নক্ষত্রের সংস্কৃত নাম ‘বিশাখা’ (বৈশাখ), ‘মঘা’ (মাঘ), পূষা (পৌষ), ‘উত্তর-আষাঢ়া’ (আষাঢ়), ‘শ্রবণা’ (শ্রাবণ), ‘কৃত্তিকা’ (কার্তিক), ‘ফাল্গুনী’ (ফাল্গুন)। এই নামগুলো ভারতবর্ষের আরও কয়েকটি সনে ব্যবহৃত হয়।

গত কয়েক দশকে ছায়ানট-পান্তা-ইলিশ-মেলা-শোভাযাত্রার এলাহি আয়োজন নিয়ে বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে পহেলা বৈশাখ। সুতরাং দুই অর্থে বঙ্গাব্দ এখনও ‘ইলাহি’: প্রথমত, এতো সব প্রাগৈতিহাসিক, ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও কর্পোরেট প্রেক্ষাপটের সমন্বয় করা মরণশীল মানুষের সাধ্যের অতীত; দ্বিতীয়ত, বঙ্গাব্দ স্বয়ম্ভূ, এর সুনির্দিষ্ট কোনো প্রবর্তক নেই।

এশিয়ার বহু এলাকায় প্রচলিত এই সনটির নাম ‘বঙ্গাব্দ’ কেন? লক্ষ্য করা যেতে পারে যে বাঙালির দখলে যা কিছু আসে সব ‘বাংলা’ হয়ে যায়। ‘আমাদের’ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন ‘ওদের’ বিহু উৎসবে যে দো-চোয়ানি পান করে থাকেন সেটাকে আমরা ‘বাংলা’ বলি। ‘ভাত গেঁজিয়ে ধেনো মদ বহু দেশে তৈরি হয়; মদের চোলাই ‘বাংলা’ শুধু, আর কারোটা নয়!’ সুতরাং ১৪২৮ একটি প্রাগৈতিহাসিক/ঐতিহাসিক দো/তিন চোয়ানি, সুতরাং এটি অবশ্যই ‘বাংলা’। আর পহেলা বৈশাখের পরদিনই যে আমরা ‘বাংলা’ তারিখ ভুলে যাই তার একটি কারণ হচ্ছে, কোনো হুজোগ বা নেশাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

শিশির ভট্টাচার্য্য ।। অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়