সম্প্রতি দেশে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রমণশীল দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট (B.1.351 অথবা N501Y.V2) এর সাম্প্রতিক উত্থানের প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের মিডিয়ায় করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের অকার্যকারিতা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এই সমালোচনা যৌক্তিক অবশ্যই।

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত দুনিয়া তোলপাড় করা দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট [B.1.351 (N501Y.V2)] এর বিরুদ্ধে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের অকার্যকারিতার দাবি জানানো গবেষণাটি শুধুমাত্র ক্ষুদ্র স্যাম্পল সাইজই নয়, বয়স ও বর্ণের ভিত্তিতে তা প্রতিনিধিত্বমূলক নয়। এই গবেষণায় ২,০২৬ জন এইচআইভি নেগেটিভ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করে যার মধ্যে ১,৭৪৯ জনকে শেষ পর্যন্ত ফলোআপ করা হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক স্যাম্পল খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ, একটি গবেষণা তখনই বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয় যখন তা এক বা একাধিক জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শ্রেণি-বর্ণ-লিঙ্গভিত্তিক সমতামূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।

এই গবেষণার অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ৩০ বছর (অধিকাংশের বয়স ২৪-৪১ এর মধ্যে),  ৭০.৫% আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ও ৪২% ধূমপায়ী। এই কারণে এই গবেষণাটির ফলাফল বিভিন্ন ধরনের উপযাজক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।

ডিসেম্বর ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যালোচনা করা দেখা যায় ওই দেশের তরুণ ও যুবা জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাস্ক না পরা, মদ্যপান ও বিভিন্ন ধরনের পার্টি করার প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এর আগের লকডাউনের কারণে তরুণ জনগোষ্ঠীর অনেকেরই শিক্ষাজীবন ও চাকরি ব্যাহত হয় ও তারা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

আমাদের অসংযত আচরণের কারণে এর মধ্যেই দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অনেক বেশি বেড়ে গেছে (শনাক্তের হার ২৩.৫৭%)। যা আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

উক্ত গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশ তরুণ হওয়ায় তাদের বিভিন্ন মৌলিক জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক বিধিমালা মেনে না চলার যে প্রবণতা তা এই গবেষণার ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে। এছাড়াও অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪২% ধূমপায়ী। আমরা গবেষণা থেকে যতটুকু জানি তা হলো, ধূমপান ফুসফুসের ক্ষতি করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এই দিকটিও এই গবেষণাটির একটি বড় দুর্বলতা।

যেকোনো কোভিড ভ্যাকসিন মানবদেহে ভাইরাসের বিরুদ্ধে শুধু এন্টিবডিই তৈরি হয় না, টি-সেলও তৈরি হয় যা পরবর্তীতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রেও বেশ শক্তিশালী টি-সেল রেসপন্স তৈরি করতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় এই নতুন ধরনের মিউটেশন পরিলক্ষিত হয় গত বছরের শেষ নাগাদ। গবেষকরা এর মধ্যেই করোনাভাইরাসের B.1.351 জিনোমের স্পাইক রিজিওনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং প্রোটিনে K417N, E484K এবং N501Y নামের তিনটি মিউটেশন আবিষ্কার করেছেন। এই মিউটেশনগুলোর কারণে ভাইরাসটির মানবদেহের কোষে সহজে যুক্ত হতে পারে। এ কারণে দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টটি অধিক সংক্রমণশীল এবং এর মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা বেশি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এই ভ্যারিয়েন্টের জন্য মৃত্যুহার বাড়া বা গুরুতর অসুস্থতার সপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

করোনাভাইরাসের মূল ধরনের মতো এই মিউটেটেড ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রেও বয়স্ক ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভোগা ব্যক্তিরা গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়াসহ হাসপাতালে বা আইসিইউতে ভর্তির জন্য অধিকতর ঝুঁকিতে রয়েছেন।

এছাড়াও এই গবেষণায় ১ম ও ২য় ডোজের মধ্যে মাত্র ২১-৩৫ দিনের ব্যবধান রয়েছে যা আমাদের দেশে চলমান কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের শিডিউলের চাইতে অনেকটাই ভিন্ন (৮ সপ্তাহ বা ৫৬ দিন)। অথচ, ফেইজ থ্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ডেটা থেকে দেখা যায় দুই ডোজ ভ্যাকসিনের মধ্যে ব্যবধান ৬ সপ্তাহ বা ৪২ দিনের কম হলে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ChAdOx1 nCoV-19 (AZD1222) ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বা এফিকেসি কমে দাঁড়ায় ৫৫.১%। তার মানে এই গবেষণায় যে ডোজিং ইন্টারভ্যাল ব্যবহৃত হয়েছে তার কারণে ও ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা কম হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

তাই এই একটি মাত্র ক্ষুদ্র পরিসরের দুর্বল গবেষণার উপর ভিত্তি করে দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের অকার্যকারিতা প্রমাণ করা যায় না। একই কারণে ৫৬ স্যাম্পল সাইজের আইসিডিডিআর,বি-এর জিনোমিক সিকোয়েন্সিং-এ ৮১% দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পুরো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে না।

দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও বাংলাদেশে বর্তমানে সংক্রমণশীল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্টের উপর নিঃসন্দেহে আরও বিস্তারিত ও সুপরিসর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এখনই যদি আমরা ধরে নেই যে এই কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন কাজ করবে না এবং চলমান ভ্যাকসিন কার্যক্রমে অংশ না নেই, আমরা নিজেরাই নিজেদের ও পরিবারের বয়স্কদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দেব। দেশে ইতোমধ্যে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ প্রদানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার দুই সপ্তাহ পরেই কেবলমাত্র পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফর্মুলায় ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের তৈরি কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন আমাদের মতো দরিদ্র দেশের জন্য এখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই ভ্যাকসিন সিভিয়ার ডিজিজ, হসপিটালাইজেশন ও মৃত্যু প্রতিরোধ করে।

আমাদের অসংযত আচরণের কারণে এর মধ্যেই দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অনেক বেশি বেড়ে গেছে (শনাক্তের হার ২৩.৫৭%)। যা আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে সবসময়ের মতো মৌলিক কাজগুলো করাই বেশি জরুরি যা হচ্ছে নিয়ম মেনে মাস্ক পরা, সাবান বা এলকোহল-বেইজড স্যানিটাইজার দিয়ে নিয়মিত হাত ধোয়া এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলা।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফর্মুলায় ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের তৈরি কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন আমাদের মতো দরিদ্র দেশের জন্য এখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই ভ্যাকসিন সিভিয়ার ডিজিজ, হসপিটালাইজেশন ও মৃত্যু প্রতিরোধ করে। গবেষণায় পাওয়া প্রাথমিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, ভ্যাকসিন শ্বাসতন্ত্রে ভাইরাসের সংখ্যা (ভাইরাল লোড) নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও যদি কেউ সংক্রমিত হন, তার এই ভাইরাস অন্য ব্যক্তিকে ছড়ানোর সম্ভাবনা কম থাকে। এছাড়াও অতি সংক্রমণশীল ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (B.1.1.7 অথবা 20I/501Y.V1) এর বিরুদ্ধেও এই কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন অত্যন্ত কার্যকর।

যেকোনো আরএনএ ভাইরাসই দেহে অভিযোজনের জন্য মিউটেশনের মাধ্যমে নিজের সংক্রমণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে যা খুবই স্বাভাবিক। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল করোনাভাইরাসের বিভিন্ন নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে তাদের ভ্যাকসিন যাতে অধিকতর সুরক্ষা দিতে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, একমাত্র সঠিক নিয়মে মাস্ক পরাই আপনাকে করোনাভাইরাস থেকে ৯০% পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে।

ডা. মুহাম্মাদ ইরফানুল আলম ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ