ছবি : সংগৃহীত

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য। সৌন্দর্যের কী অপরূপ বর্ণনা আহা! শুধু জীবনানন্দ দাশই নন যুগ যুগ ধরে সব কবি সাহিত্যিক ও শিল্পী, নারী সৌন্দর্যের মার্গ নির্ধারণ করে চলেছেন। যেন এরপর আর কোনো কথা নেই, থাকতেই পারে না। সাধারণ মানুষজন সেইসব উপমা বিশেষ মার্গকে প্রতিদিনকার প্রায়োগিক ফর্মুলা ভেবে সৌন্দর্যকে তুমুল প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে।

আমজনতার আর দোষ কী বলুন! মার্গ আছে না! কবিগুরু বলেছেন, কালো তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ। ঠিক এই শব্দগুলোর মতোই নারীর সৌন্দর্য চিরকাল নিঃসীম কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন। এখনকার ঢঙে বলতে হয়—ওমন চোস্ত কবিতার লাইন মানুষ খেয়েছে বলেই ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী বাজার কাঁপালো। 

কয়দিন আগে কলকাতার একটা বাংলা সিনেমা দেখছিলাম নাম—শূন্য এ বুকে। দুর্দান্ত রেজাল্ট কিংবা কর্মক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় দক্ষতা অথবা অনেক গুণে গুণান্বিত এসব বলার চেয়ে বরং বলা ভালো মুখশ্রীতে মুগ্ধ হয়ে সিনেমার প্রধান নারী চরিত্রের সাথে প্রেম, এরপর বিয়ে। বাসর রাতে ভাস্কর্যশিল্পী স্বামী টের পেলেন তার স্ত্রীর বুকের জায়গাটা সমতল। গহীন এক বেদনা ভর করলো তার মনে। সারাজীবন তিনি নিজে নারীর সৌন্দর্য নির্ধারণ করেছেন। সব মনন ঢেলে দিয়ে প্রতিমা এঁকেছেন। সেই সবে রূপদান করেছেন। সে কী অপরূপ! ঠিক যেন জীবনানন্দের কবিতা! এর বাইরে তো কিছু নেই। হতেই পারে না। সুতরাং পণ্ড হয় বাসর, ভেঙে যায় বিয়ে। 

এত কথা কেন বললাম? মাত্র ক’দিন আগে বিবিসির করা বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি মিস ওয়ার্ল্ড কিংবা ইউনিভার্স নন। তিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী।

নিজের এনজিও সংস্থা ভয়েজ অ্যান্ড ভিউজ-এর মাধ্যমে তিনি অগ্নিদগ্ধদের সাহায্যার্থে কাজ করেন। কারণটা কী জানেন? কারণ তিনি নিজেও অগ্নিদগ্ধ একজন মানুষ। প্রবাদ আছে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। কিন্তু জান্নাতুল তো পালাননি বরং এগিয়ে এসেছেন। পোড়া শরীরের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি।

অনেকবার তাকে অপারেশন থিয়েটারে যেতে হয়েছে। লেখাপড়ায় ছেদ পড়েছে কিন্তু তারপরেও তিনি উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। ক্রমান্বয়ে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন আরও অনেকের জন্য সহায়ক হিসেবে। প্রেমময় কবিতার মাখো মাখো লাইনগুলো তার সাথে কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছে, না?

আত্মাকে ধারণ করে যে শক্তি, যে শক্তি চারপাশে বিচ্ছুরিত হয়, আলোকিত করে সমাজ, সেই শক্তির সাথে পরিচয় কয়জনেরইবা থাকে! এখন সময় খানিকটা অস্থিতিশীল। নির্বাচনকালীন অস্থিরতা চলমান।

বিবিসির করা বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি মিস ওয়ার্ল্ড কিংবা ইউনিভার্স নন। তিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী।

চারদিকে অবরোধ আর জ্বালাও পোড়াও আতঙ্ক। এর মাঝে জান্নাতুল ফেরদৌসের দুর্দান্ত স্বীকৃতি জানান দেয় বাংলাদেশ ঠিক তার জায়গাতেই আছে। সম্ভাবনাগুলো যেমন বাধাহীনভাবে অবারিত হচ্ছে তেমনি সৌন্দর্যের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়ে ক্রমেই তা দক্ষতায় রূপান্তরিত হচ্ছে। বাংলাদেশকে অভূতপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে প্রভাবশালী জান্নাতুলের এই স্বীকৃতি। 

যদিও আমরা জানি সময়কে অতিক্রম করা এক ধরনের যুদ্ধ এবং প্রতিটা যুদ্ধই পৃথিবীর বুকে অসংখ্য ইতিবাচক পদচিহ্ন রেখে যায়। এদেশে প্রতিটা নারীই জানে তাকে কত প্রকারের যুদ্ধ করতে হয়। 

তিরতির করে দুলতে থাকা মানসিক শক্তিই ফিনিক্সের মতো তাকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু এইটুকুই যখন একজন নারীকে বিশেষ কিছু অর্জন করতে দীক্ষা দেয় তখন সত্যিই সামনের সময় নিয়ে আশা জাগে। অমিত সম্ভাবনার একটা সমাজ চোখের সামনে দেখতে পাই।

সাধারণ একটা হিসাব যদি আমরা করি তাহলে এদেশে নারীর ক্ষমতায়নের যাত্রা খুব বেশিদিনের না। যা কিছু অর্জন তাও অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তবেই এখনকার অবস্থায় এসেছে। আসলেই কি এসেছে? নাকি আমরা সান্ত্বনা খুঁজি! বিরাট প্রশ্ন বটে!

সাধারণ একটা হিসাব যদি আমরা করি তাহলে এদেশে নারীর ক্ষমতায়নের যাত্রা খুব বেশিদিনের না। যা কিছু অর্জন তাও অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তবেই এখনকার অবস্থায় এসেছে। আসলেই কি এসেছে? নাকি আমরা সান্ত্বনা খুঁজি!

আমরা যারা নারীর ক্ষমতায়নকে শুধু আয় রোজগার বা উপার্জন সক্ষমতার মাঝে সীমাবদ্ধ করতে চাই তাহলেও টের পাব প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে শহুরে ঘরে ব্যাপক বিপ্লব ঘটে গেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে এখন স্মার্ট বাংলাদেশের পটভূমি রচিত হচ্ছে।

যেখানে লাখ লাখ টাকা প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীর হাত দিয়েই নিয়মিত লেনদেন হচ্ছে। তবে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ছাড়াও ক্ষমতায়নের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শিক্ষা, সমঅধিকার, মত প্রকাশ ও যাপনের সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা। সত্যিকার অর্থে দূরদর্শী ও অগ্রসর সরকার কাঠামোই পারে নারীর ক্ষমতায়নবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে এবং এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকার গঠন প্রক্রিয়াতে নারীর অংশগ্রহণই নিশ্চিত করতে পারে নারীর ক্ষমতায়ন। 

এবার একটু কটু কথা বলি। সমাজ ও পরিবার সবাইকে সন্তুষ্ট করার প্রচ্ছন্ন একটা দায় থাকে নারীর মাথায়। ঠিক খাড়ার মতো খাড়া। প্রথা থেকে বিচ্যুত হলে কিংবা কোনোভাবে গতানুগতিকতার অন্যথা হলে কঠিন কঠিন শব্দাবলী নারীর ওপরে বর্ষণ করা হয়। অবাক করা ব্যাপার হলো সেইসব কঠিন শব্দ নারীর যোগ্যতা পরিমাপকও!

নারীর অনেক অর্জন এই শব্দগুলোর কারণে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কেন যায়? কেন সেই শব্দগুলো নারীর গায়ে বসে যায়? কেন নারীর গায়েই ঝুলাতে হবে লক্ষ্মীমন্ত ট্যাগ? বিপরীত সত্তা কেন নয়? সময় পাল্টেছে। খুব যে পাল্টেছে বলবো না।

তবে নারীর পথ রুদ্ধ হলে নারী কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শিখেছে এটাও সত্যি। অসম্মানের বিরুদ্ধে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার মতো ক্ষুদ্র প্রতিবাদ সক্ষমতাও তো নারীর ক্ষমতায়ন!

নারীর প্রতি বিদ্বেষ, নারীর প্রতি সহিংসতার কোনো শেষ নেই। এসিড নিক্ষেপের মতো বর্বরোচিত অন্যায় একসময় হরহামেশা ঘটতে দেখেছি। জান্নাতুল ফেরদৌস অগ্নিদগ্ধ হয়েছিল রান্নাঘরের চুলার আগুনে।

তুমুল একটা দুঃস্বপ্ন পাড়ি দিয়ে আসা জান্নাতুল ফেরদৌস যখন তার পুড়ে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত মুখশ্রীকে অতিক্রম করতে পারেন তখন দেশটার প্রতি ভীষণ মায়া লাগে। আরও অনেকখানি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। ১৬ কোটি মানুষের সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য, নিজেকে ভেঙেচুরে আপাদমস্তক নতুন করে প্রতিস্থাপন করা আপনাকে অভিনন্দন জানাই জান্নাতুল ফেরদৌস।  

ওয়ারেছা খানম প্রীতি ।। প্রেসিডেন্ট, হার ই-ট্রেড