ছবি : সংগৃহীত

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০২৪-এ তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে; ২০২৫-এ পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে; ২০২৬-এ একাদশ শ্রেণিতে এবং ২০২৭ শিক্ষাবর্ষে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে।

প্রাক-প্রাথমিক স্তর হবে ২ বছরের জন্য, যা ২০২২ পর্যন্ত ছিল ১ বছরের। প্রাক-প্রাথমিক স্তরে থাকছে না সরকার নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই পড়াবেন তাদের নিজেদের মতো করে।

প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত থাকছে না কোনো পরীক্ষা। ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে শ্রেণিতে শেখার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন করা হবে। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বই থাকবে ৩টি। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বিষয়ের ৮টি বই থাকবে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বিষয়ের ১০টি বই থাকবে।

সরকার বলছে, ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশে চালু করা হয়েছে। যারা নতুন শিক্ষাক্রমকে ফিনল্যান্ড মডেল বলে চেঁচাচ্ছেন তাদের এবং দেশের জনগণকে উদ্দেশ্য করে ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা—

ফিনল্যান্ডের স্কুল শিক্ষাব্যবস্থাকে ২টি স্তরে ভাগ করা হয়। প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত একটি স্তর, সপ্তম থেকে নবম শ্রেণি আরেকটি স্তর। অর্থাৎ প্রথম স্তরের শিক্ষার্থীদের গড় বয়স ৬-১২ এবং দ্বিতীয় স্তরের শিক্ষার্থীদের গড় বয়স ১২ থেকে ১৫। নিম্নস্তরে কী শেখানো হয়? মূলত মাতৃভাষা ২৩ শতাংশ, গণিত ১৬ শতাংশ, পরিবেশ এবং প্রকৃতি বিজ্ঞান ১১ শতাংশ এবং আরও অন্যান্য।

এই ৬-১২ বছর বয়সের বাচ্চাদের কারা পড়ায়? যারা পড়ায় তাদের বলা হয় ক্লাস টিচার। এদের শিক্ষাগত যোগ্যতা হলো স্কুল শিক্ষা বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করা। এই বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিভাগগুলোর মধ্যে অন্যতম!

বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সাবজেক্ট পড়ার জন্য কঠিন প্রতিযোগিতা কারণ ফিনল্যান্ডে শিক্ষকদের সম্মান ও বেতন দুটোই বিশ্বসেরা। এই শিক্ষকদের শিক্ষানীতির ওপর পড়াশোনা থাকতে হয়, শিশুদের মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে পড়াশোনা থাকতে হয়। যদিও এই শ্রেণিতে সবাই সব বিষয় পড়ানোর যোগ্যতা রাখে তবুও শিক্ষকদের ইচ্ছেকে এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে কী পড়াতে হবে তা নিয়ে তেমন কোনো সিলেবাস নেই। শিক্ষকদের মোটামুটি স্বাধীনতা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশে জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা পৃথিবীতে সর্বনিম্নদের অন্যতম। আর ফিনল্যান্ড দেয় জিডিপির ৬-৭ শতাংশ!

উপরের স্তরটি বিশেষায়িত। এখানে শিক্ষকদের নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষ হতে হয়। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিত বিষয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষক হতে হলে শিক্ষককে মাস্টার্স করার সময় অন্তত শিক্ষকতা চলাকালীন ৭০ সপ্তাহ ওই বিষয়ের কোর্স পড়া থাকতে হবে। এছাড়া শিক্ষকতা চলাকালীন ৩৫ সপ্তাহ শিক্ষানীতি নিয়ে পড়া থাকতে হবে। এর মধ্যে ব্যবহারিক ক্লাস অন্তর্ভুক্ত।

উপরের স্তরে ন্যূনতম বাধ্যতামূলক বিষয়গুলো হলো মাতৃভাষা, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও ভূগোল। কোথায় তথ্য প্রযুক্তি? কোথায় জীবন ও জীবিকা?

এছাড়া সপ্তম থেকে নবম পর্যন্ত রসায়নের যেসব বিষয় পড়ানো হয় তা আমাদের ধারণারও বাইরে। রসায়নের অর্জন, নিরাপদভাবে গবেষণাগারে কাজের কৌশল, এলিমেন্ট কম্পাউন্ড, হাইড্রোকার্বন, অ্যালকোহল, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেটস, ফ্যাট, ডিটারজেন্ট, সল্ট অ্যান্ড মেটাল, প্রোপার্টিজ অব মেটাল, প্লাস্টিক অ্যান্ড পেট্রোলিয়াম ইন্ডাস্ট্রি, মেডিসিন, কসমিক সাবটেন্স, নিউ ম্যাটেরিয়ালস, ক্যামিস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টসহ আরও অনেককিছু।

এগুলো কি আমাদের দেশে সম্ভব? এইসব বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে বইয়ের কনটেন্ট, কাগজের মান ইত্যাদি সবকিছুতে মায়ার ছাপ। আর আমাদেরগুলোয় শুধু লোভের ছাপ।

নতুন শিক্ষাক্রম আমাদের শিক্ষার্থীরা কী শিখবে তাও জানা জরুরি। এতদিন ধরে চলে আসা পরীক্ষার বাইরে মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন সামষ্টিক উপায়ে। উঠে যাচ্ছে পিইসি, এবতেদায়ি ও জেএসসি/জেডিসি নামের পাবলিক পরীক্ষা।

শিখনকালীন মূল্যায়নের ধরন হচ্ছে অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগ এবং হাতেকলমে। চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ।

একাদশ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৩০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৭০ শতাংশ। এসএসসি পরীক্ষা আর আগের মতো নবম-দশম শ্রেণির বই মিলিয়ে হবে না। শুধু দশম শ্রেণির বই ও সিলেবাস অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে শিক্ষার্থীদের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। মাধ্যমিক পর্যায়ে থাকছে না বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য শাখা। এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা অভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করবে।

একটি শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম হঠাৎ করে শতভাগ পরিবর্তন পৃথিবীর কোথাও করে না। পরিবর্তন আনতে হয় সাম্যাবস্থা বজায় রেখে একটু একটু করে, যাতে ভুল হলেও ক্ষতি কম হয়।

তাহলে কী বুঝলেন? কোথায় ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা আর কোথায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। ফিনল্যান্ডে প্রাইমারি শিক্ষক যারা হবেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখেছেন? আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট ও এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ এর অনেক শিক্ষকের যোগ্যতার সমান। তাদের বেতনও আকর্ষণীয়।

তাহলে ফিনল্যান্ড কী করেছে? আগে শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় এবং উচ্চ যোগ্যতা সম্পন্ন করেছে। তারপর কী শেখানো হবে,  স্কুল-কলেজ শেষে একজন শিক্ষার্থীর কতটুকু শিখতে হবে সেই টার্গেট স্থির করে বড় পর্দায় কোন ক্লাসে কী পড়ানো হবে এবং কীভাবে অগ্রগতি হবে তা নির্ধারণ করে বই লেখা হয়। এইগুলো গবেষণা করে ঠিক করা হয়।

একটি দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষা নিয়ে ভণ্ডামি করা যায় না। এখানকার শিক্ষক কারা হবে, তাদের বেতন ও সম্মান খুব বিবেচনা ও চিন্তা করে নির্ধারণ করতে হবে। এরা যদি সংসার চালাতে গিয়ে অর্থের টানাটানিতে ভোগে কীভাবে তারা আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াবে এবং শেখাবে?

এই শিক্ষকদের একটা সুখী জীবন ধারণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ফিনল্যান্ড মডেল, ফিনল্যান্ড মডেল বললেই ফিনল্যান্ডের শিক্ষা হয়ে যাবে না। বাংলাদেশে জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা পৃথিবীতে সর্বনিম্নদের অন্যতম। আর ফিনল্যান্ড দেয় জিডিপির ৬-৭ শতাংশ! ফলে এই মানের শিক্ষকতা যোগ্যতা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষক হলে তাদের হাতে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষমতা দেওয়া যায়। কারণ তাদের ওপর এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার, এমপি, পাতিনেতারা এসে মাতব্বরি করবে না।

আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর সম্মান আর বেতনও দেওয়া হয় রাষ্ট্রের অনেক তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর চেয়ে কম। এদের দিয়ে রাষ্ট্র যত রকমের ছোটখাটো কাজ করিয়ে নেয়। এরা অত্যন্ত দুর্বল শ্রেণির। আর তাদের ওপর ন্যস্ত করেছেন আমাদের ছোট ছোট সোনামণিদের পড়ানোর দায়িত্ব! 

একটি শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম হঠাৎ করে শতভাগ পরিবর্তন পৃথিবীর কোথাও করে না। পরিবর্তন আনতে হয় সাম্যাবস্থা বজায় রেখে একটু একটু করে, যাতে ভুল হলেও ক্ষতি কম হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে রাক্ষসদের হাতে পড়েছে তার প্রধান প্রমাণ হলো এক সাথে শতভাগ পরিবর্তন করা। এটা কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব। সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ আর এই দেশের আমলা মন্ত্রী!

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়