ছবি : সংগৃহীত

১৬ ডিসেম্বর, বাঙালির জীবনে হিরকখচিত সহস্র বছরের আকাঙ্ক্ষিত বিজয়ের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনেই স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয় লাভ করে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে 'বাংলাদেশ' নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের।

স্বাধীনতা শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রের স্বাধীনতার সাথে সাথে চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি ব্যক্তির স্বাধীনতা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।

রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তার 'স্বাধীনতা' কবিতায় বলেছেন—

‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,

কে বাঁচিতে চায়?

দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,

কে পরিবে পায়।

কোটিকল্প দাস থাকা নরকের প্রায় হে,

নরকের প্রায়।

দিনেকের স্বাধীনতা, স্বর্গ-সুখ তায় হে,

স্বর্গ-সুখ তায়॥

সার্থক জীবন আর বাহু-বল তার হে,

বাহু-বল তার।

আত্মনাশে যেই করে দেশের উদ্ধার হে,

দেশের উদ্ধার॥

অতএব রণভূমে চল ত্বরা যাই হে,

চল ত্বরা যাই।

দেশহিতে মরে যেই, তুল্য তার নাই হে,

তুল্য তার নাই॥’

কবি রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় তার 'স্বাধীনতা' কবিতায় সুস্পষ্টভাবে বলেছেন—স্বাধীনতা হীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। জগতের কেউ পরাধীন হয়ে বাঁচতে চায় না। এমনকি যে পথের ভিখারি সেও পরাধীন হয়ে বাঁচতে চায় না। রাস্তার একজন পাগল পর্যন্ত পরাধীন হয়ে থাকতে চায় না; তাই সে তার মতো করে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। সেই চলাফেরা স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক দুটোই হতে পারে।

অন্যের দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক হলে তাকে পাগলামি বলে। একটি শিশুও পরাধীন থাকতে চায় না, সে কান্নাকাটি করে হলেও সাধ্যমতো প্রতিবাদ করে তার স্বাধীন ইচ্ছা পূরণ করে।

কোটিকল্প দাস থেকে হুজুরের মজুর হয়ে বিভিন্ন উপাদেয় ভোগ্যবস্তু হয়তো ভোগ করা যায়। কিন্তু যদি স্বাধীনতা না থাকে দিনশেষে তার কোনো মূল্য থাকে না।

সেই সময়ের সাহিত্যে অসুর, দস্যু আর কেউ নয়; এদেশীয় ধর্ম-দর্শন এবং সংস্কৃতি বিরোধী বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীরা। তাই মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলোয় আমরা সেই অলৌকিকতার ব্যবহার দেখি।

আমরা অনেকেই সঠিক সময়ে বুঝতে পারি না যে, আমরা হুজুরের মজুর হয়ে বহুকাল বেঁচে থাকব নাকি মজুরের হুজুর হয়ে ক্ষণকাল বেঁচে থাকব। সিদ্ধান্ত আমাদের।

আমাদের যদি কোনো ব্যক্তিস্বতন্ত্রতা না থাকে, চিন্তার স্বাধীনতা না থাকে; তবে কখনোই তার মধ্যে অন্তর্নিহিত সুকুমার বৃত্তিগুলোর জাগরণ ঘটবে না। এই কারণে পরাধীন অবস্থায় মানুষ যা চিন্তা করে, চিন্তাগুলো খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না।

পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, পরাধীন অবস্থায় যেকোনো জাতির সাহিত্যচর্চার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে পরাধীনতার প্রভাব দেখা যায়। এর বড় উদাহরণ মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যগুলো।

মধ্যযুগে তুর্কি শাসন শোষণে নিষ্পেষিত এদেশীয় মানুষগুলোর সাহিত্য পরিবর্তিত হয়ে অত্যন্ত অলৌকিকতার আমদানি হয়েছিল। মানুষ যখন সম্মুখের ভয়ংকর শত্রুদের জয় করতে পারে না; তখন সে অলৌকিকতার আশ্রয় নিয়ে শত্রুকে পরাজিত করতে চায়। এই ঘটনাটিই ঘটেছিল বাংলায়।

সেই সময়ের সাহিত্যে অসুর, দস্যু আর কেউ নয়; এদেশীয় ধর্ম-দর্শন এবং সংস্কৃতি বিরোধী বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীরা। তাই মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলোয় আমরা সেই অলৌকিকতার ব্যবহার দেখি।

সাধারণ মানুষ যখন দেখলেন, শত্রুদের সাথে মুখোমুখি সম্যক লড়াই করা অসম্ভব। তখনই তারা চিন্তা করলেন যেকোনো দেবতা এসে আমার কাছের মানুষ হয়ে, আমার ঘরের মানুষ হয়ে, আমার আপনজন হয়ে আমাকে রক্ষা করবে।

যিনি নিঃশেষে নিজের জীবন দান করে আপন বাহুবলে দেশের জন্য আত্মাহুতি দেন তিনি অক্ষয় স্বর্গ লাভ করেন। দেশের জন্য যারা প্রাণ বলিদান করেন, জগতে এমন সৌভাগ্য কম মানুষের জীবনেই ঘটে। তাদের মৃত্যু নেই, ক্ষয় নেই।

মৃত্যু হলেও তারা জগতে অমর হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'সুপ্রভাত' কবিতায় বলেছেন, উদয়ের সূর্যোদয়ের পথে তাদের প্রেরণাদীপ্ত বাণী শোনা যায়—

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী,

ভয় নাই, ওরে ভয় নাই-

নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান

ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’

বাংলাদেশ আজ মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উদযাপন করছে। ঠিক সেই সময়ই দুঃখজনকভাবে আমরা দেখছি, দেশে বিদেশে আমাদের সংস্কৃতির অভিমুখকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হচ্ছে।

অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এই বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে দলীয়ভাবে চর্চা করে তৃণমূল পর্যায়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। আমি ঠিক জানি না কয়জন বিষয়টি যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

যার নির্দেশনায় এই দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য বিজয়ের মাস ডিসেম্বরই ভাঙা হয়েছে। ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতের কোনো একসময় কুষ্টিয়া পৌরসভার পাঁচ রাস্তার মোড়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ডান হাত, পুরো মুখ ও বাম হাতের অংশ ভেঙে ফেলা হয়। জাতির জন্যে এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে?

দেশের আনাচে-কানাচে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জুড়ে স্বাধীন সার্বভৌম এই জাতিরাষ্ট্রে আজও পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা গিজগিজ করছে। এরা প্যাঁচার মতো সূর্যের আলোকে সহ্য করতে পারে না।

স্বাধীনতার সূর্যের আলো এই অন্ধকার প্রিয় প্যাঁচাদের অপছন্দ। তারা অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছে। অন্ধকারই তাদের বড় প্রিয়, দিনের আলোয় তাদের ভয় এই বুঝি সবাই অন্ধকারস্বরূপ চিনে গেল, জেনে গেল। তারা আজও স্বপ্ন দেখে, তাদের সাধের পেয়ারের পাকিস্তানের। আজও তারা চর্চা করে পাকিস্তানের উর্দু ভাষার প্রেমে মশগুল।

স্বাধীন দেশে এই পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের শক্তি সামর্থ্য পাওয়ার কারণ কী? আমরা লক্ষ্য করলে দেখব এদের সংখ্যা খুবই নগণ্য, কিন্তু তারা অত্যন্ত সক্রিয়। তারা সর্বদা জেগে আছে, আর কিছু মানুষ ছাড়া স্বাধীনতার মূলস্রোতের মানুষেরা উদাস। তা এই বিষয়গুলো দিনে দিনে অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে।

অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এই বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে দলীয়ভাবে চর্চা করে তৃণমূল পর্যায়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। আমি ঠিক জানি না কয়জন বিষয়টি যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। শুধু কথা সর্বস্ব হওয়ার কারণে, বিষয়গুলো নিয়ে দেশের অধিকাংশ মানুষেরই পরিষ্কার ধারণা নেই। তাই এর সুযোগ নিচ্ছে, দেশে বসবাসরত পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা। বিজয়ের দিনে আমরা প্রতিজ্ঞা করি পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের বাংলা থেকে উৎখাত করবোই, করবো।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়