ছবি : সংগৃহীত

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন শেষে নতুন সরকার গঠিত হলো। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করলো। সরকারের ধারাবাহিকতার কারণে জনগণের নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশাও অনেক বেশি।

বাংলাদেশ যেহেতু মুক্ত অর্থনীতির দেশ তাই বিশ্ব অর্থনীতিতে কোনো সংকট দেখা দিলে তার প্রভাব অবশ্যই আমাদের দেশের অর্থনীতিতে পড়বে। কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের কারণে যেমন বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছে তেমনি আমাদের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়েছে। এছাড়া নির্বাচন পূর্ববর্তী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণেও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করাই বর্তমান সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন হবে অর্থনীতির যেসব জায়গাগুলো তার মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি কমানো, রিজার্ভ বাড়ানো, রেমিট্যান্স বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব কমানো, রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যাংক খাত সংস্কার, মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল করা, ব্যাংক ঋণের সুদের হার নিয়ন্ত্রণ, অর্থ পাচার রোধ, পুঁজি বাজার নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি দমন প্রভৃতি বিষয়।

সরকারের সামনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর হস্তে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে দেশে প্রবৃদ্ধির ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে সরকারকে কৃষি ও শিল্পখাতের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।

এই দুই খাতের উৎপাদন যদি বাড়ে তাহলে একদিকে যেমন সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে তেমনি বাজারে বিভিন্ন দ্রব্যের জোগান পর্যাপ্ত থাকার ফলে দাম বাড়ার প্রবণতাও থাকবে না। ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

এছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়লে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। পাশাপাশি আমদানি শুল্ক হ্রাস করার মাধ্যমে আমদানি বাড়লে দ্রব্যের জোগান বাড়বে ফলে দ্রব্যের মূল্য কমে আসতে পারে। এমতাবস্থায় বাজারে তদারকি বাড়াতে হবে, বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে, আমদানি, পাইকারি বা খুচরা কোনো পর্যায়েই যেন সিন্ডিকেট তৈরি না হয় সেইদিকে সরকারকে কঠোর দৃষ্টি দিতে হবে।

সরকারের সামনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর হস্তে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯,৫৯৯.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা একই অর্থবছরের ডিসেম্বরে কমে দাঁড়িয়েছিল ৩৩,৭৪৭.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই এবং ডিসেম্বর মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৯,৭৩২.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২৭,১৩০.০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা কিন্তু পূর্ববর্তী অর্থবছর থেকে কম।

রিজার্ভ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষত ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে অভূতপূর্ব অস্থিরতা বিরাজ করছে। ডলারের প্রকৃত বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করা আশু প্রয়োজন।

দীর্ঘদিন ধরে দেশে মার্কিন ডলারের সংকট চলছে। ডলার সংকট এবং দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য হ্রাস পাচ্ছে। যার ফলে মূল্যস্ফীতিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উচ্চমূল্যের প্রভাব গিয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে আর কমছে জীবনযাত্রার মান। দ্রুততম সময়ে রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

তবে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হলে বিনিময় হারকে বাজারমুখী করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে আরও রেমিট্যান্স দেশে আনতে ব্যাংকগুলোর প্রণোদনা দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার কথা ভাবতে পারে।

দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতগুলো তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছে। ফলে কলমানি মার্কেট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর অন্যান্য ব্যাংকগুলোর নির্ভরতা বাড়ছে। কিছু ব্যাংকের ওপর আস্থার অভাব, রেকর্ড খেলাপি ঋণ, ঋণ আদায়ে ধীরগতি, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে সংকট, টাকার ক্রমশ অবমূল্যায়ন প্রভৃতি তারল্য সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার পেছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে এই খেলাপি ঋণ। এছাড়া রয়েছে ব্যাংকের অভ্যন্তরে সুশাসনের ঘাটতি।

এছাড়া খেলাপি ঋণের সমস্যায় আমরা জর্জরিত আগে থেকেই। খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে উঠছে। অনেক প্রচেষ্টা ও কৌশল অবলম্বন করার পরও খেলাপি ঋণ সমস্যার কোনো সমাধানে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি।

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার পেছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে এই খেলাপি ঋণ। এছাড়া রয়েছে ব্যাংকের অভ্যন্তরে সুশাসনের ঘাটতি। এসব কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে। ফলে দেশে বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীরা যারা পুঁজির জন্য ব্যাংকিং খাতের উপর নির্ভরশীল তারা বিশেষ সমস্যায় পড়ছে।

এতে করে বিনিয়োগ কমে উৎপাদন কমার সম্ভাবনা আছে। ফলে সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থান কমে মানুষের আয় কমার এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধির সম্ভাবনাও আছে। এই জন্য ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে তদারকি বাড়াতে হবে। কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে এবং এই বিষয়ে যেসব আইন আছে সেইগুলো যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো। আর এটা করতে গেলে সর্বপ্রথম যেটা প্রয়োজন তা হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এছাড়া আরও কিছু সংস্কার প্রয়োজন যেমন সরকারের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়া, সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান বাড়ানো, পুঁজিবাজারকে স্বচ্ছ করা, কর ছাড়ের পরিমাণ কমানো। 

পরিশেষে বলা যায়, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে নতুন সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, খেলাপি ঋণকে কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে, তারল্য সংকট দূর করতে হবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে হবে, ডলারের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করতে হবে এবং কঠোর মনিটরিং এর ব্যবস্থা করতে হবে যেন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কোনোভাবেই বাজারকে প্রভাবিত করতে না পারে।

সোমা ভট্টাচার্য ।। সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়