ছবি : সংগৃহীত

একবার অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এক দৌহিত্র গাল ফুলিয়ে গালাগালি করেছিলেন জিন্দাবাদওয়ালাদের নিয়ে। তার বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশে যারা ‘জিন্দাবাদ’ বলেন তারা নাকি পাকিস্তানের দালাল। জিন্দাবাদ উর্দু থেকে এসেছে এই আন্দাজ থেকেই তার এই গালাগাল। লোকজন বুঝেছিলেন যে তিনি জিন্দাবাদের উৎস জানলেও, আওয়ামী শব্দের উৎস জানেন না, মানে তখন অবধি জানতেন না অন্তত। তার এই বিচিত্র ভাষাজ্ঞান নিয়ে বেশ হাসিঠাট্টা হয়েছে। তবে তার (ও আমাদের) কপাল ভালো যে অত লোকের মনে নেই। তার কপালের কথা বলছি কারণ এত বড় দৌহিত্র হিসেবে এই ভাষাজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া আসলেই একটু ইয়ে ধরনের। আমাদের কপাল ভালো বলছি কারণ এত বড় মানুষকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে মামলা-টামলা হতে পারত।

যাই হোক, এটা মনে পড়ল বলেই বলা। জাহাঙ্গীরনগরের জিন্দাবাদওয়ালাদের নাম মোটামুটি জাবিয়ান বা জানবিবি। কে বা কারা এই নাম দুটোর প্রবর্তন ঘটিয়েছিলেন তা জানি না। তবে আমার দুটো নামেই কোনো আবেগ সঞ্চারিত হয় না। এবং আমার বেশ আনস্মার্ট লাগে। একথা অস্বীকার করব না যে, যেকোনো আবেগপ্রবণতাই আমার আচ্ছা মতো আনস্মার্ট লাগে।

বাস্তবে কোনো পরিচয় নিয়েই আমার ভাবালুতা কাজ করে না। বিশ্বাস করুন, আমার কী লাগে আর কী লাগে না তা নিয়ে আপনাদের শাসন করার কোনোই ইচ্ছা নেই। কিন্তু এই জাবিয়ান ও জানবিবিওয়ালাদের বিভিন্ন জরুরি বিষয়ে ঘাপটি মেরে থাকা আর দরকার মতো ‘কে কোথায় আছে’ মার্কা প্রচারণা দেখলে মাথা কিড়বিড় করতে থাকে। ওটুকুই বললাম আরকি।

জাহাঙ্গীরনগরে সাম্প্রতিক ধর্ষণকাণ্ডে এই পক্ষেরই একটা বড় অংশ শরম পেয়েছেন। শরম তো পাবারই কথা। কিন্তু অনেকের শরমটা এইরকম ‘লোকের কাছে মুখ দেখাব কীভাবে!’ অতি ন্যায্য কথা! কীভাবে মুখ দেখাবেন? কিন্তু প্রশ্ন আছে ভাই জাবিয়ান!

যখন কতগুলো ‘বীরপুরুষ’একটা ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিপালিত হয় তখন শরমটা কী নিয়ে? ওই ‘বীরপুরুষ’দের কর্মকাণ্ড নিয়ে নাকি ওই ‘বীরপুরুষ’রা কীভাবে দিনের পর দিন প্রতিপালিত হচ্ছে একটা প্রশাসনিক ব্যবস্থার ছত্রছায়ায় তা নিয়ে? আপনাদের শরম যদি পরেরটা নিয়ে হতো, তাহলে তো দু-চারটা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবতে পারতেন।

তাহলে তো সারাবছর ধরেই আপনার ‘প্রাণপ্রিয়’ প্রতিষ্ঠানের গভর্ন্যান্স/শাসন প্রণালী নিয়ে দু-চারটা মতামত দিতে পারতেন। কিছুই যদি করার না থাকত, অন্তত আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তার ফ্রেমওয়ার্কটা তৈরি থাকত। এখন যখন শরম শরম করেন, তখন মনে হয় কম্বলের নিচে চাপাপড়া থাকলে আপনাদের লজ্জা-মিটার ঠিকঠাক কাজ করে। যেই না কম্বলটা উদলা হয়ে সিস্টেম বেরিয়ে পড়ে, অমনি আপনার লজ্জা-মিটার চাড়া দেয়। আপনাদিগকে বরং ধিক্কার জানাই!

প্রসঙ্গটা তাহলে কম্বলচাপা দেওয়ার দিক থেকেই দেখতে হচ্ছে। যারা লজ্জিত হচ্ছেন, যাদের মনখারাপ হচ্ছে, তাদের সাথে রাগ না করে বরং জানতে চাই তারা কি মনে করেন যে ১৯৯৮ থেকে এই ২৪ বছরে জাহাঙ্গীরনগর সাধারণ মানুষজনের চলাফেরার অভয়ারণ্য ছিল? তারা কি মনে করেন না যে যৌন ও অযৌন নানাবিধ নিগ্রহ এই ক্যাম্পাসে বলবৎ আছে? নানান কর্মকাণ্ড নানান ক্যাম্পাসেই যে বলবৎ আছে তা কি তারা জানেন না? নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বসবাসের জন্য ন্যূনতম দায়দায়িত্ব যে প্রশাসন পালন করতে ব্যর্থ, তা কি তারা লক্ষ্য করেননি?

নানান কর্মকাণ্ড নানান ক্যাম্পাসেই যে বলবৎ আছে তা কি তারা জানেন না? নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বসবাসের জন্য ন্যূনতম দায়দায়িত্ব যে প্রশাসন পালন করতে ব্যর্থ, তা কি তারা লক্ষ্য করেননি?

প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বসবাসের সমস্যারও অধিকন্তু যে লাগাতার নিগ্রহ হতে থাকেন তারা, যাকে চলতি ভাষায় র‍্যাগিং বলা হয়, তা কি কখনো কানে আসেনি? কোনো শান্তি বিঘ্নিত হয়নি? কানে কি আসেনি যে, যৌন নিগ্রহের ঘটনাও ঘটে থাকে? ভুজুংভাজুং ভয়ভীতি দেখিয়ে সেইসবের নিষ্পত্তি ঘটে থাকে তাও কানে আসেনি কখনো? আচ্ছা কানে যা আসে তার মধ্যে অতিরঞ্জন থাকতেই পারে। মানলাম। কিন্তু নিজেদের মতো করে ‘নিজেদের’ ক্যাম্পাসেরই পরিস্থিতিগুলো বুঝে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ থাকবে না?

আক্রান্ত এবারে পুলিশ পর্যন্ত গেছেন। যেতে পেরেছেন। কীভাবে পেরেছেন সেই কৌতূহল থাকলেও আমি গবেষণায় বা অনুসন্ধানে নামব না। কারণ, সঠিক সময় এটা নয়। তাছাড়া এটা কারও জন্য নিরাপদ না হতে পারে। পুলিশ পর্যন্ত যাওয়াতে এবং কয়েকজন পুলিশ অফিসার ‘সদয়’ হওয়াতে বিষয়টা ‘দেশবাসীর’ মনোযোগ পেল। এই তো? আমি কিছু অতিরঞ্জন করছি না তো! আশা করি! তো তাহলে পরিপ্রেক্ষিতটা সকলেরই বুঝে নেওয়া ভালো।

ধর্ষকদের আটক করা হয়েছে বেশ দ্রুতগতিতে। এই দফা, পুলিশের কাছে আক্রান্তের যাওয়াতে এবং পুলিশ নড়াচড়া করাতে, আর কোনো বিশেষ উপায়ও ছিল না। ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে, ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন মহামান্য আদালত। না করলেই বা কী করতে পারতাম! তবে জাবিয়ান গরবে গরবান ও গরবিনি জাতির জন্য আরও মুখ্য খবর হলো, জরুরি সিন্ডিকেট সভা বসেছে। সেইখানে ৬ জনকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে ‘সাময়িক’ বহিষ্কার ও সার্টিফিকেট ‘স্থগিত’ রেখে।

ছাত্রলীগও তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে একজন অনুঘটককে অন্তত ‘বহিষ্কার’ করেছে। বাকি ক’জনকে যে কী করেছেন খোঁজ রাখিনি। ওটা আমি খবর না দেখেই বলে দিতে পারি। আপনারাও পারবেন। 

তবে এই 'বিচারে' শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। তা এই গুণধরদের রক্ষাকারীরা এখনই বের করতে শুরু করেছে। 'সিন্ডিকেট কী পারে', 'আমাদের কতটুকু এখতিয়ার' এইরকম আবোলতাবোল, গা-বাঁচানো, দুষ্কৃতিকারীদের বাঁচানো আলাপসালাপ ক্যাম্পাসে কান পাতলেই শোনা যাবে।

প্রশাসনের এই সুপারফাস্ট 'ইনসাফ' ডেলিভারির জন্য তাদের অভিনন্দন জানাই। এই অভিনন্দন তাদের প্রাপ্য। এই প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামটা শেষ করতে ৫৫ বছর লাগিয়েছে এবং তাও অশেষ হয়ে রয়েছে। একটা মেহমানখানা এমনভাবে বানাতে পারেননি যাতে অভ্যাগতদের কাছে আমাদের কোনোরকম ইজ্জত বজায় থাকে।

জাহাঙ্গীরনগরের প্রশাসকবৃন্দ ১৪৫০ কোটি টাকা প্রাপ্তির বাকবাকুম শুনিয়ে যত্রতত্র যা-তা ভবন বানানোর সময়েই কেবল বলেছেন ‘আছে আছে এবার মেহমানখানাও আছে’। এই কুৎসিত ‘উন্নয়ন’ কাজকর্মের সময় তাদের বুলিংয়ের প্রধান সাথী ছিলেন, বলাই বাহুল্য, ছাত্রলীগের নেতৃবর্গ (কোন উপদলের তা জিজ্ঞাসা করবেন না প্লিজ)। তারপর কোনো কোনো পরিস্থিতিতে তাদের মনে হলো, ‘হুমম এখন একটা মহাপরিকল্পনার সভা হতে পারে।’ সেই রকম একটা সভাও হয়েছে বটে। তা নিয়ে আরেকদিন কথা বলা যাবে। এই মহাশম্বুক গতির ও বিদঘুটে বদনিয়তসম্পন্ন প্রশাসনিক চক্রের কাছ থেকে ২৪ ঘণ্টায় ‘ইনসাফ’ প্রাপ্তি ঘটলে হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যাওয়ার মতোই হয়। হয়েছেও আমাদের কারও কারও!

প্রশাসনের আর উপায় ছিল না। অবশ্যই। তবে সতর্ক থাকা ভালো যে, এখানে ওই মহাগুণধর ছাত্রসংগঠনের অনেকগুলো উপাংশ। সকলেই পরস্পর মেলা মেলা হিংসা করে। সহায় সম্পদের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ক্যাচাল করে। আবার সতর্কভাবে ঘাপটি মেরে থাকে। এই ‘ইনসাফ’ পরিবেশনের সাথে তাদের উপাংশের কোনো উপ-উপ যোগাযোগ থেকে থাকলে আমরা জানতে পারব না। খুব সেয়ানা বুদ্ধির যারা আছি, তারা কয়েকদিনের চেষ্টায় পারলেও পারতে পারি। 

তবে এই 'বিচারে' শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। তা এই গুণধরদের রক্ষাকারীরা এখনই বের করতে শুরু করেছে। 'সিন্ডিকেট কী পারে', 'আমাদের কতটুকু এখতিয়ার' এইরকম আবোলতাবোল, গা-বাঁচানো, দুষ্কৃতিকারীদের বাঁচানো আলাপসালাপ ক্যাম্পাসে কান পাতলেই শোনা যাবে। সবসময় যে তা প্রশাসনের জাঁদরেল লোকজন করবেন তাও নয়, তাদের মেনিমুখো ‘ভালোমানুষ’ সমর্থকেরাও করবেন। তবে এদের অনেকেরই ‘জাতির বিবেক’ অভিধা পছন্দ, অনেকেই ‘রিসার্চার’ প্রোফাইল (ও ফান্ড) পছন্দ করেন। ফলে সম্ভাবনা আছে, অন্তত আমরা আশা করতে পারি যে, তাদের বিবেক ও গবেষণার স্বার্থেই তারা এগুলো তাড়াতাড়ি সমাধা করতে চাইবেন। তবে এসবে ধামাচাপা বা কম্বলচাপা দিলেও তাদের অনেকের কাজ চলবে।

কী যে বিপদ! সিন্দাবাদের ভূতকে কাঁধ থেকে নামাতে অবশ্যই সামর্থ্য লাগে। কিন্তু আরও আগে লাগে নিয়ত। সৎনিয়ত, অভিপ্রায়, ইন্টেনশন! না থাকলে নামবে না!

ড. মানস চৌধুরী ।। অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়