ছবি : সংগৃহীত

আহমেদ রুবেলের সাথে আমার পরিচয় দুই যুগ ধরে। তখন আমি কিশোরী বেলার শেষ দিকে। একুশে টেলিভিশনে ভ্রমণ বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘অ্যাডভেঞ্চার বাংলাদেশ’ উপস্থাপনা করছি। প্রাচীন গতানুগতিক অনুষ্ঠান এবং টেলিভিশন নাটক দুমড়ে মুচড়ে নতুন ধরন আনলো একুশে টেলিভিশন। যার নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুপ্রতিম সাংবাদিক সায়মন ড্রিং

সেই সময় রুবেল ভাই কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে 'প্রেত' ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করলেন। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে গেল সেই নাটক। দর্শক অপেক্ষা করতো নতুন পর্বের জন্য। রুবেল ভাইয়ের সোনালী যুগের সূত্রপাত।

থিয়েটার থেকে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে আসা রুবেল ভাইয়ের সিগনেচার ভয়েস কে না শুনেছে। দরাজ গলার অধিকারী তিনি। আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন বুঝতে পারতাম, কারণ মাঝে মাঝেই তার সাথে কাজের সুযোগ হতো।

আমার শেষ ওটিটি ফিকশন এবং চলচ্চিত্রের সহশিল্পী ছিলেন তিনি। দীর্ঘ বছরে আমার বয়স বেড়েছে, সন্তান হয়েছে তবে পাল্টায়নি তার সাথে আমার সম্পর্ক। আমার প্রতি তার স্নেহ যেন আরও প্রগাঢ় হয়েছে।

শুটিংয়ে শটের আগে আমার ঘন ঘন মহড়া করার অভ্যাস। আমি হালে থিয়েটারের সাথে যুক্ত হয়েছি তবে মহড়ার বদভ্যাসটি আমার আগে থেকেই। বদভ্যাস লিখছি কারণ অনেকেই বিরক্ত হতেন কিন্তু বিরক্ত হতেন না রুবেল ভাই। শুধু সংলাপ আওড়ে ছেড়ে দিতাম তাই নয়, ব্লকিংয়েও আমার প্রফেশনাল অত্যাচার তিনি সহ্য করেছেন একাধিকবার।

'দেশান্তর' চলচ্চিত্রে আহমেদ রুবেল; ছবি : সংগৃহীত

আমি একটু বোরিং কিসিমের মানুষ। ব্যক্তিগত আলাপ তেমন কখনো আসেনি আমাদের শুটিংয়ের বিরতির আড্ডায়। কিছুটা পড়াশোনা অভ্যাসের কারণে 'অ'ব্যক্তিগত অজস্র বিষয় ছিল আলাপ করার। এখন মনে হয় কেন জিজ্ঞেস করলাম না উনি নিজের সাথে কেন খামখেয়ালি করেছেন? তার সাথে শেষ কথা হয় ভিডিওতে। গাজীপুরে নিজের বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখালেন। তারপর তো তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হলো।

আমি হালে থিয়েটারের সাথে যুক্ত হয়েছি তবে মহড়ার বদভ্যাসটি আমার আগে থেকেই। বদভ্যাস লিখছি কারণ অনেকেই বিরক্ত হতেন কিন্তু বিরক্ত হতেন না রুবেল ভাই। শুধু সংলাপ আওড়ে ছেড়ে দিতাম তাই নয়, ব্লকিংয়েও আমার প্রফেশনাল অত্যাচার তিনি সহ্য করেছেন একাধিকবার।

অবাক লাগত তার গাজীপুর থেকে ঢাকা আসা দেখে। একদিন রুবেল ভাইয়ের সাথে সিনেমার মহড়া করার কথা। অনেক দেরি করে পৌঁছালেন। আমি অস্থির হয়ে গেছি এর মধ্যে এটা ভেবে, উনি যদি না আসেন? উনি আসতেনই।

আমার সাথে যাদের কাজ করার দুর্ভাগ্য হয়েছে তারা জানেন আমি বেশ অস্থির প্রকৃতির। সময়মতো উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা করি তাই কাজ শুরু করতে দেরি হলেই আমার হাঁসফাঁস শুরু হয়ে যায়। বলতে গেলে অনেকটা অচল এই সময়, তাই আমিও গুটিয়ে নিয়েছি নিজেকে। যাই হোক তিনি আসলেন এবং দরাজ কণ্ঠে সেই অতি চেনা স্নেহের প্রলেপে মুড়িয়ে দিলেন।

মৌটুসী বিশ্বাস ও আহমেদ রুবেল; ছবি : সংগৃহীত

শেষ যে কাজটি করেছিলাম ওটিটির জন্য তা নির্মাণ করেছেন সামির আহমেদ। নাম স্পটলাইট। সিরিজের নাম বউ ডায়রিজ। দুইদিনে কাজটা নেমেছিল। তার মাঝে একদিন আমার অর্ধেক বেলা ছিল ডিহাইড্রেশন। রুবেল ভাই খোঁজ রাখতেন। সামির ভাইয়ের মায়ের বনেদি বাসায় আমরা আরাম করে কাজটা শেষ করতে পেরেছিলাম।

ওই গল্পে মূল চরিত্র আমার করতে হয়েছিল কারণ সিরিজটাই বউদের নিয়ে। তবে রুবেল ভাইয়ের গ্রেসফুলনেস এবং স্ক্রিন অ্যাপিয়ারেন্স এত তীব্র যে, স্ক্রিনে আসলেই ঝলমল করে উঠতেন তিনি আর শুটিংয়ে ঝলমল করে রাখতেন আমাদের। ইনটেন্সড সিনগুলো পরিচালক, চিত্রগ্রাহক এবং আমরা আলোচনা করে ব্লকিং করে নিতাম। আমরা খুব আনন্দ নিয়ে শুটিংটা করেছিলাম।

রুবেল ভাইয়ের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার ছিল। তিনি ঢাকা থিয়েটারে অভিনয় জীবন শুরু করেন। টেলিভিশন নাটকের পাশাপাশি বিকল্পধারার চলচ্চিত্রে তার বিচরণ ছিল বেশি।

তারও অনেক আগের কথা। এনটিভির জন্য তৈরি হচ্ছে একটি নাটক। রুবেল ভাই আর আমি, পুরান ঢাকায় শুটিং করছি। গল্পে ছিল তিনি আমাকে অপহরণ করেন। প্রচণ্ড পরিশ্রমের ছিল কাজটি। তিনি অপহরণের দৃশ্য এমনভাবে করলেন যেন আমি কোনোভাবেই ব্যথা না পাই।

অনেকেই হয়তো বলবেন রুবেল ভাইকে কাজে লাগানো গেল না ঠিকমতো। আমি বিষয়টা এভাবে দেখি না। রুবেল ভাইয়ের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার ছিল। তিনি ঢাকা থিয়েটারে অভিনয় জীবন শুরু করেন। টেলিভিশন নাটকের পাশাপাশি বিকল্পধারার চলচ্চিত্রে তার বিচরণ ছিল বেশি।

মৌটুসী বিশ্বাস ও আহমেদ রুবেল; ছবি : সংগৃহীত

নাটকে তিনি দাপটের সাথে কাজ করে গেছেন। দেশের নামীদামি প্রায় সব পরিচালকের সাথেই তার কাজের অভিজ্ঞতা আছে। কয়েক বছরেই তিনি যে চলচ্চিত্রগুলোয় অভিনয় করেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—‘অলাতচক্র (২০২১)’, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি (২০২১)’, ‘চিরঞ্জীব মুজিব (২০২১)’, ‘দেশান্তর (২০২২)’, ‘প্রিয় সত্যজিৎ (২০২৩)’ ও ‘পেয়ারার সুবাস (২০২৪)’।

তারপরেও যদি কথা ওঠে তিনি আরও উজ্জ্বল হতে পারতেন তখন আমার মনে হয় ওই একটাই কথা, তিনি একটা সময় অনিয়ম করেছেন নিজের সাথে। নিজেকে হয়তো একটু কমই ভালোবেসেছিলেন।

শিল্পীরা এখন কয়েক ভাগে বিভক্ত। আগে শিল্পী মানেই আলোকিত, ধর্মনিরপেক্ষ ছিল, সেই রকম দেখেই তো বড় হয়েছি। ক্রমে শিল্পীদের মাঝে পরিবর্তন এসেছে। এখন এমন যুগ চলছে যে সাধারণের মাঝে অসাধারণেরা চলে যাচ্ছেন।

৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ আহমেদ রুবেল আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। দেশের উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো একে একে পরপারে চলে যাচ্ছেন। আমরা ক্রমশ একা হয়ে পড়ছি।

বিদায় রুবেল ভাই। ওপারে দেখা হলে এবার ব্যক্তিগত প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসবো।

মৌটুসী বিশ্বাস ।। অভিনেত্রী