বর্তমানে বাংলাদেশে সাত্ত্বিক মাতৃপ্রতিমার প্রচারণা অত্যন্ত জনপ্রিয় বিষয়। বিষয়টি ইদানীং বিভিন্ন ধর্মীয় সভায় প্রায়ই আলোচিত হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, সাত্ত্বিক প্রতিমা বিষয়টি কী?

এই সাত্ত্বিক বা শুদ্ধ প্রতিমা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী নেতৃবৃন্দের কাছে মতামত চাইলে প্রথমেই তারা প্রতিমার শরীরে কাপড় ঘাটতির প্রসঙ্গে বলে থাকেন। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারিনি যে, সব নগ্নতাই অশ্লীলতা নয়। দেবী কালী নগ্ন, কিন্তু এতে বিন্দু পরিমাণ অশ্লীলতার ভাব নেই।

আজ দুঃখজনকভাবে বলতে হয় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা প্রতিমাপূজা বিরোধীদের মতো হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রতিমার শ্লীল বা অশ্লীল নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমরা অন্ততপক্ষে শাস্ত্রে প্রতিমার ধ্যানমন্ত্র বা বিভিন্ন স্তোত্রে যেমন করে প্রতিমার রূপ বর্ণিত হয়েছে সেই রূপকে অবলম্বন করে প্রতিমা তৈরি করতে পারি।

পদ্মপুরাণের সুবিখ্যাত 'সরস্বতীস্তোত্রম্'-এ দেবীর শ্বেতশুভ্র মাধুর্যমণ্ডিত রূপ বর্ণিত হয়েছে। দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধানুলেপন দ্বারা শোভিতা।

তাঁর হাতে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে বিভূষিতা।

“শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।

শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা।।

শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা।

শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা।।”

দেবী সরস্বতীর গায়ের বর্ণ শ্বেত-শুভ্র। বিদ্যা যেহেতু সাত্ত্বিক এবং নিষ্কলুষ হতে হয়, তাই সেইসব বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে দেবী সরস্বতীও শুভ্রমূর্তিতে বিরাজিতা।

দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধানুলেপন দ্বারা শোভিতা। তাঁর হাতে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে বিভূষিতা।

বিদ্যা লাভের জন্য প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীদের আগে বাল্যকাল থেকে নিষ্কলুষ নির্মল চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। তবেই সে মুক্তিস্বরূপা বিদ্যা লাভ করবে।

শ্রীচণ্ডীতে বিদ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—

“সা বিদ্যা পরমা মুক্তের্হেতুভূতা সনাতনী।

 সংসারবন্ধহেতুশ্চ সৈব সর্বেশ্বরেশ্বরী।।”

(শ্রীচণ্ডী : ০১.৫৭-৫৮)

‘সেই মহামায়া দ্বিবিধা, বিদ্যা ও অবিদ্যা। যে মহামায়া মুক্তির জননী, তিনি বিদ্যা। আর যিনি সংসার বন্ধনের কারণস্বরূপা, তিনি অবিদ্যা। যিনি মুক্তির জননী, তিনিই সনাতনী পরমা বিদ্যা। তিনিই সংসার-বন্ধের কারণ-স্বরূপা এবং তিনিই মনুষ্য দেবতাসহ সকলের পরমেশ্বরী।’

দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস। রাজহাঁসের মধ্যে এক অনন্য সক্ষমতা রয়েছে; সে জল এবং দুধের মিশ্রণ থেকে দুধকে আলাদা করে নিতে পারে। জগতে বিদ্যা এবং অবিদ্যা উভয়ই আছে, সেই পঙ্কিলতা পূর্ণ তামসিক অবিদ্যা থেকে আমাদের বিদ্যাকে গ্রহণ করে নিতে হবে।

দেবী সরস্বতীর হাতে বীণা। তিনি কলা ও বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী। দেবীর হাতে বীণা, সমৃদ্ধ শিল্পকলা চর্চার প্রেরণা দেয়। কলা বিদ্যার চর্চা মানুষকে বিভিন্ন নৃশংস অপকর্ম থেকে দূরে রেখে মানবিক করে তোলে।

দেবীর হাতে পুস্তক ধারণ করে আছেন। সরস্বতী পূজাতেও দেবীর শ্রীচরণে পাঠ্যপুস্তক সমর্পণ করে বিদ্যা যাচনা করা হয়। এই বেদাদি পুস্তক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল জ্ঞানের আশ্রয়।

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মূর্তিপূজা করে না, তারা মূর্তিতে পরমেশ্বরের উপাসনা করে। আরও বিশেষ করে বলতে গেলে মূর্তিকে প্রতিমায় রূপান্তরিত করে উপাসনা করে।

অর্থাৎ মৃন্ময়ী প্রতিমাকে চিন্ময়ী প্রতিমাতে রূপান্তরিত করে উপাসনা করে। প্রতিমার সৌন্দর্যে, পূজার বিশেষত্বে এবং সাধকের সুতীব্র বিশ্বাস ও ভক্তিতেই মৃন্ময়ী, দারুময়ী, শিলাময়ী বা ধাতুময়ী প্রতিমা চিন্ময়ী প্রতিমায় রূপান্তরিত হয়। 

“আভিরূপ্যাচ্চ বিমবস্য পূজায়াশ্চ বিশেষতঃ। 

সাধকস্য চ বিশ্বাসাৎ সন্নিধৌ দেবতা ভবেৎ।।” 

(কুলার্ণবতন্ত্র : ৬.৭৭)

‘প্রতিমার সৌন্দর্যে, পূজার বিশেষত্বে এবং সাধকের বিশ্বাসে দেবতা সন্নিধিস্থ হন।’

বাংলাদেশে সারাদেশব্যাপী সরস্বতী পূজায় শ্বেত শুভ্র প্রতিমার অন্যতম দৃষ্টান্ত হতে পারে মাদারীপুর। বহুকাল পূর্ব থেকেই মাদারীপুর জেলার সরস্বতী প্রতিমা, রাজহংস এবং পদ্মসহ দেবী প্রতিমার সাথে যুক্ত সবকিছুই শুভ্র বর্ণে তৈরি করা হয়। এটি সম্ভব হয়েছে মাদারীপুরের প্রতিমার কারিগরদের কারণে।

দেবী সরস্বতীর হাতে বীণা। তিনি কলা ও বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী। দেবীর হাতে বীণা, সমৃদ্ধ শিল্পকলা চর্চার প্রেরণা দেয়। কলা বিদ্যার চর্চা মানুষকে বিভিন্ন নৃশংস অপকর্ম থেকে দূরে রেখে মানবিক করে তোলে।

অনেক আগে থেকেই শুভ্র বর্ণের প্রতিমার প্রচলন মাদারীপুরে চলে আসলেও, বর্তমানে এর নেতৃত্ব দিয়েছেন কয়েকজন প্রতিমা শিল্পী। মাদারীপুরের প্রতিমা কারিগরদের কারণে, বড়-বড় আয়োজকরা চাইলেও আর ধ্যানমন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যহীন প্রতিমা তৈরি করতে পারে না।

দুর্গাপূজায় সাত্ত্বিক প্রতিমা তৈরির প্রচারণায় আমরা মাদারীপুরের এই মডেলকে সামনে রেখে আগাতে পারি। অর্থাৎ প্রতিমা কারিগরদের মাথায় আগে প্রতিমার রূপটি প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। তবে আর জনে জনে পূজার আয়োজক এবং তার সাথে যুক্ত মানুষদের আলাদা করে বুঝাতে হবে না।

আমরা প্রতিমা কারিগরদের গিয়ে যদি দেবদেবীদের শাস্ত্রে বর্ণিত রূপটি জানিয়ে দিতে পারি; তবে আমরা স্বল্প পরিশ্রমে অনেক বেশি সুফল পেতে পারি।

মাদারীপুর জেলাটির ঐতিহ্য হলো, সরস্বতীপূজা। দুর্গাপূজায় যতটা না আনন্দ হয়, এর থেকে বেশি আনন্দ হয় সরস্বতীপূজায়। বৃহৎ, বৃহৎ প্যান্ডেলে অনুষ্ঠিত হয় সরস্বতী দেবীর আরাধনা। সেই জায়গায় তিনদিনব্যাপী বর্ণাঢ্যভাবে অনুষ্ঠিত হয় পূজা।

শ্রীপঞ্চমীর দিনটিতে দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়, পূজার পরের দিনও প্যান্ডেলে প্রতিমা অবস্থান করে। তৃতীয় দিনে মাদারীপুর শহরের সব প্রতিমা নিয়ে এক বর্ণাঢ্য আলোক শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় সবার মাঝে এক আনন্দের হিল্লোল প্রবাহিত হয়ে যায়। এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাটি শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে। তারপর দেবীর বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পূজার সমাপ্তি হয়।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়