সমালোচনা, আলোচনা কোনটাই নয়; শিল্পকর্মী ও একজন দর্শক এবং তার পারিপার্শ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে এই লেখা। কাউকে আঘাত করা তো নয়ই বরং ভেবে দেখার জন্যে অনুরোধ সাপেক্ষে এই লেখা।

২০২৪ সালের ঈদুল ফিতর এবং বাংলা নতুন বছর অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ বা বৈশাখী উৎসব প্রায় একই সাথে। তাই দর্শকদের আনন্দ, বিনোদনের লক্ষ্যে টেলিভিশন, ওটিটি ও ইউটিউব মাধ্যমে নাটক নির্মাণ করেছেন প্রযোজক, পরিচালক, অভিনয়শিল্পীসহ কলাকুশলীরা। এই কর্মযজ্ঞও যেন একপ্রকার উৎসব।

ওটিটিসহ টেলিভিশনের নাটকও দর্শক দেখতে পাবে ইউটিউবে। যথারীতি লক্ষ্য করা যাবে, বিভিন্ন মাধ্যমের লেখনীতে ‘আজকাল’ সেরা নাটক বা ভালো নাটক বিবেচিত হবে ভিউয়ের উপর নির্ভর করে। তা যেমন নাটকই হোক না কেন, নাটকগুলোর নাম যা-ই হোক না কেন।

অতি ‘হিট’ যে ‘হিটস্ট্রোক’-এর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তা নিয়ে কেউ ভাবছেই না! প্রচারমাধ্যম, প্রযোজক, পরিচালকদেরও স্রোতের উল্টো দিকে আসার প্রবণতা কম।

অতীতকে না টেনে, বর্তমানে বসবাস এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করা মঙ্গল। কিন্তু পাঠক তারপরও যে অতীতকে টানতে হয়। কারণ, আজ যিনি শিল্পাঙ্গনে কাজ করছেন তিনি তো শৈশব ও কৈশোরে নাটক দেখেছেন, মুগ্ধ হয়েছেন, তারপরই না সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি কাজ করবেন শিল্পের কোনো একটি শাখায়। অতএব অতীতকে অস্বীকার করে এগোনো অসম্ভব।

অতীতে উৎসব বা পার্বণ ভিত্তিক বিনোদন মানেই কিছু হাস্যরসাত্মক, কিছু পারিবারিক, কিছু অতিবস্তাবতা গল্পনির্ভর নাটক দর্শক দেখেছেন। কয়েক বছরে একজন দর্শক হিসেবে নয় একজন পরিচালক এবং অভিনয়শিল্পী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে যে কথাটা সর্বাধিকবার শুনতে হয়েছে তা হলো, ‘কমেডি নাটক লাগবে’। ‘কমেডি ছাড়া মানুষ খায় না’। ‘কমেডি না হলেও নাটকে প্রেম থাকতে হবে’।

আরে ভাই, নাটক তো শিল্প। শিল্প অর্থাৎ নান্দনিক। নান্দনিক অর্থ কী? সুন্দর চেতনা, আবেগ বা আবেগী মূল্যবোধ, যা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট। নান্দনিক-এর সমার্থক শব্দ আকর্ষণীয়, মার্জিত, সুন্দর, আনন্দদায়ক, আবেদনময়, দৃষ্টিনন্দন, চমৎকার ইত্যাদি। প্রত্যেকটি শব্দের অর্থ খুবই শ্রুতিমধুর। ঠিক তেমনি নান্দনিক শব্দের আরও কিছু প্রতিশব্দ এবং অনুরূপ শব্দ আছে যেমন সেক্সি, চটকদার, প্রলোভনসঙ্কুল, স্ট্রাইকিং ইত্যাদি। কালের পরিক্রমায় দেখা যাচ্ছে, টেলিভিশন নাটকের নান্দনিকতা শেষ কয়েকটি শব্দের মাঝে আটকে গেছে।

উৎসবকেন্দ্রিক নাটকগুলোয় আবেগ আছে কিন্তু অভিনয়শিল্পী কী ঠিক আছে? নেই। কারণ, একটি চরিত্রের বয়স, স্ট্যাটাস অনুযায়ী যাকে কাস্টিং করার প্রয়োজন ছিল তার জায়গায় তারকাখচিত একজন অভিনয়শিল্পীকে রূপসজ্জার মাধ্যমে ৪০ বা ৫০ বা ৬০ বছর বয়সী করে উপস্থাপন করা হয়।

অভিনেতা তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে চরিত্র ফুঁটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন, কিন্তু অভিনয়ের কিছু ভাব বা রস-এর অভাব দেখা যায়। যেমন চাহনি, কণ্ঠস্বর, হাঁটা, ওঠা, বসা, হাসি, কান্না ইত্যাদি। অবশ্য ‘প্রস্থেটিক’-এর মাধ্যম ভালোভাবে উপস্থাপন করা যেত অভিনয়শিল্পীকে। কিন্তু বাজেট সমস্যা দেখা দেয়। তারপরও কেন এই জোর-জবরদস্তি? ঐ বয়সের অভিনয়শিল্পী কি নেই আমাদের দেশের মিডিয়ায়! অবশ্যই আছে। সেই সাথে আছে তাদের অভিনয়, জীবন ও কর্মের অভিজ্ঞতা। তারাও স্টার, সুপারস্টার। তারপরও কেন কাস্টিং করা হয় না? কারণ হলো, বর্তমান এই সময়ের ‘ভিউ’ কাহিনি।

বহু বছর ধরে তো নাটকের বাইরে অন্যান্য পেশা, ফেসবুক তারকারাও অনেক পরিশ্রমিক নিয়ে যুক্ত হয়েছেন অভিনয়ে। ক্রমাগত তারা অভিনয়ে পারদর্শী এবং দর্শকনন্দিতও হয়ে উঠেছেন এবং হচ্ছেন। কিন্তু যে মানুষটি স্বপ্ন দেখেছেন অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার, তাদের অসংখ্যের মৃত্যু হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

হাস্যরস, হাস্য+রস। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘কমেডি’। এই শব্দটার ‘চল’ই বেশি বাজারে। অনেক সিরিয়াস বিষয় পুরোনো ও নতুন প্রমুখ নাট্যকার এবং নির্দেশকরা হাস্যরসের মাধ্যমে চেষ্টা করতেন সরল এবং সাবলীলভাবে উপস্থাপন করে দর্শকদের বিনোদন দেওয়ার। নাটকগুলো জীবনের, ঘরের, পাশের বাড়ির, সমাজের, সর্বোপরি রাষ্ট্রের কথা বলে অনুভূত হতো। কিন্তু বর্তমানে উৎসবকেন্দ্রিক কয়েক ধরনের নাটক দেখা যায়—

১. বাবা-মা, ভাইবোন, স্ত্রী, মেয়েজামাই ইত্যাদি অন্যান্য সম্পর্ক নিয়ে পরিবারকেন্দ্রিক নাটক—খুব কম।

২. বাধা ধরা লোকেশনে, নির্দিষ্ট কিছু অভিনয়শিল্পী নিয়ে প্রেম, বন্ধুত্ব নিয়ে হাসি ঠাট্টা তামাশা করতে করতে হঠাৎ শেষ দুই সিকোয়েন্স দর্শক কাঁদানো বা ‘অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো’ এবং নাটক শেষ—সংখ্যায় যথেষ্ট।

৩. প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রীর প্রেম নিয়ে নাটক—অনেক

৪. থ্রিলার নাটক—হাতে গোনা দুই চারটে।

৫. বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি এবং ‘ডুয়েল মিনিং’ যাকে বলা হচ্ছে তথাকথিত ‘কমেডি’ নাটক—অগণিত।

বর্তমানে উৎসবের প্রায় প্রতিটি নাটকে গান আছে। অবশ্যই গান থাকতে পারে। কিন্তু বর্তমানে সময়ে মনে হয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কারণ, প্রতিটি চ্যানেল, ইউটিউব ও ওটিটি এই নাটকগুলো থেকে গানকে আলাদা করে, আপলোড করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবার সেই গানের সংঙ্গীতশিল্পীরাও প্রায় একই। মূলত সব-ই ‘হিট’কেন্দ্রিক ভাবনা ও বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অতি ‘হিট’ যে ‘হিটস্ট্রোক’-এর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তা নিয়ে কেউ ভাবছেই না! মিডিয়া নামক সাগরের সব স্রোত একই দিকে প্রবাহিত হচ্ছে স্রোতের বিপরীতে কেউ আসতেই চাইছে না! প্রচারমাধ্যম, প্রযোজক, পরিচালকদেরও স্রোতের উল্টো দিকে আসার প্রবণতা কম। তবে, কেউ কেউ সাহস করে উল্টো দিকে সাঁতার কাটতে ভালোবাসেন এবং তা সবার মুখে মুখে আলোচিত হয়।

বর্তমান সময়ে নাটকের নাম দেখলে হতবাক হতে হয়। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, নাম যত উল্টো-পাল্টা দর্শকদের আগ্রহ তত বেশি। আবার এমনও হতে পারে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যত নাটক হয়েছে, সেই ক্ষেত্রে হয়তো বারবার একই নাম ব্যবহার করা থেকে সতর্ক থাকার চেষ্টা।

আরেকটা বিষয় তো খুব স্পষ্ট, জেনারেশন বুঝে ‘টাসকি’ খাওয়া টাইপ নাম। কিন্তু একটি নাটক দেখার আকর্ষণ কি এটা হতে পারে! যদি হয়, তাহলে পৃথিবীব্যাপী (আলাদাভাবে নাম উল্লেখ করতে চাই না) অন্য ভাষাভাষী যে সিরিজগুলো হচ্ছে সেইগুলোর নাম, কাহিনি, সাসপেন্স, ইমোশন মোদ্দাকথা পুরো প্রজেক্ট কেন এত আমাদের মুগ্ধ করে? টানে? বেদনা জাগায়? আড্ডায় আলোচনার বিষয় হয়? ফেসবুক তোলপাড় হয়? কাঁদায়? এবং হাসায়? বর্তমানে বাংলাদেশের নাটকের অবস্থা দেখে একজন দর্শক হিসেবে আমার মনেও এমন অনেক ‘কেন’ বা ‘প্রশ্ন’-এর উদয় হয়।

বছরের অন্যান্য সময় থেকে উৎসবকেন্দ্রিক নাটকের বাজেট তুলনামূলকভাবে বেশি দেওয়া হয় বলেই জানি। তারপরও এই উৎসবের নাটকগুলোর একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, দুইজন সর্বোচ্চ সম্মানীপ্রাপ্ত তারকা, দুইজন মোটামুটি সম্মানীপ্রাপ্ত এবং বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক বা দুইজন অভিনয়শিল্পী ছাড়া আর তেমন কোনো অভিনয়শিল্পী নেই।

বছরের অন্যান্য সময় থেকে উৎসবকেন্দ্রিক নাটকের বাজেট তুলনামূলকভাবে বেশি দেওয়া হয় বলেই জানি। তারপরও এই উৎসবের নাটকগুলোর একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, দুইজন সর্বোচ্চ সম্মানীপ্রাপ্ত তারকা

যদিও ছয়জন অভিনয়শিল্পী হয়তো আমি বেশিই লিখে ফেললাম। কিন্তু কেন? বাবা-মা থাকলে প্রায় সব নাটকে ‘এক’ই মুখের বাবা-মা দেখা যায়। অভিনয়শিল্পীরাও প্রায় সব নাটকে ‘এক’। শুধু ‘গেটআপ’ ‘মেকআপ’ আলাদা। হায়রে... আর বাকিরা! কেবলই কবে, কোন নাটকে ডাকবে সেই প্রতীক্ষা! সম্ভবত তারকা ব্যতীত অন্যান্য অভিনয়শিল্পীদের প্রতি মনোযোগও কম দেওয়া হয়। কারণ স্ক্রিনে, তাদের অভিনয় হয় খুব দুর্বল। আর তাই মানুষ যে কয়টি নাটক দেখে তা ঐ তারকাখচিত অভিনয়শিল্পীদের নাটকই দেখে।

ভিউ হয় কোটি কোটি। ঘুরে ফিরে সেই একটাই কক্ষপথ। কক্ষপথের ভেতরে ও বাইরেও যে অনেক জীবন আছে তা নিয়ে ভাবে ক’জন। বহু বছর ধরে তো নাটকের বাইরে অন্যান্য পেশা, ফেসবুক তারকারাও অনেক পরিশ্রমিক নিয়ে যুক্ত হয়েছেন অভিনয়ে। ক্রমাগত তারা অভিনয়ে পারদর্শী এবং দর্শকনন্দিতও হয়ে উঠেছেন এবং হচ্ছেন। কিন্তু যে মানুষটি স্বপ্ন দেখেছেন অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার, তাদের অসংখ্যের মৃত্যু হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একটি চারাগাছ যে আগামীতে মহিরুহ হয়ে উঠতে পারে সেই চিন্তা ক’জন করছে? সুযোগ না দিলে, সাহায্য না করলে অযোগ্য কী কখনো যোগ্য হতে পারে?

বাংলাদেশে শুধু নয় বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা বাংলা নাটক দেখে। নতুন নাটক দেখার অপেক্ষায় থাকেন। উৎসবের সময়টাতে তারা ছুটি পান। নাটক দেখার জন্য সময় বরাদ্দ রাখেন বা পরবর্তীতে সময় করে দেখবেন বলে নোট করে রাখেন। অবশ্যই সবার রুচি, পছন্দ বা চাহিদা এক নয়। তাই একটা নাটক মিডিয়ায় উপস্থাপন এবং প্রচারের পূর্বে অবশ্যই সব বিষয় নিয়ে ভাবা উচিত।

পরীক্ষার হলে খাতা টোকাটুকি করে সবাই একই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা না করে একটু আলাদা কী করা যায়, কীভাবে আলাদা হওয়া যায়-ভাবা উচিত। তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ঈদুল ফিতরে শুধুমাত্র টেলিভিশন নাটকের সংখ্যা প্রায় ৩০০টি। সেই জায়গায় প্রয়োজনহীন নাচানাচি, ঠোঁট-চোখ বাঁকানো, অহেতুক রঙচঙে পোশাকআশাক, অভিনয় মনে হওয়া অভিনয়, হাত-পা ছোড়াছুড়ি, আঞ্চলিক ভাষার অবমাননা, অরুচিকর হাসি-তামাশা, গালি-গালাজসহ অকথ্য ভাষাসমৃদ্ধ যদি নাটকের মান হয়, তা একপ্রকার ভীতিকর।

তাই ভিউয়ের ইঁদুর-বিড়াল দৌড়ে ক্লান্ত না হয়ে নান্দনিক নাটক উপস্থাপনার জন্য প্রচারের প্রতিটি মাধ্যম, প্রযোজক, পরিচালক, নাট্যকার এবং অভিনয়শিল্পীদের সচেষ্ট হওয়া উচিত। গ্লোবাল বা ইন্টারনেটের যুগে বাংলাদেশের নাটকের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টাই যেন হয় আমাদের মূল লক্ষ্য।

নাজনীন হাসান চুমকী ।। অভিনেত্রী, নাট্যকার ও পরিচালক