ছবি : সংগৃহীত

নববর্ষ উপলক্ষে দেশের নানান জায়গায় বসবে বৈশাখী মেলা। বরণ করে নেওয়া হবে নতুন বছরকে প্রীতি-সম্ভাষণে, গানে,  আমোদে আর মুখরোচক খাদ্যে। মেলা বসবে নানান জায়গায়, রমনার বটমূলে বসবে গানের আসর, চিরায়ত বাঙালি খাবার উঠে আসবে আমাদের রসনায়।

নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো, শিশুদের কলকাকলিতে ঘন হয়ে আসবে আকাশ-বাতাস। বৈশাখী মেলা আমার মনে পাঁচটি আঙ্গিকে দেখা দেয়—উৎসব, অর্থনীতি, ঐতিহ্য, আত্মসত্তা এবং সর্বজনীনতা।

১। বৈশাখী মেলার উৎসবের দিকটি তো চিরচেনা। ঐ যে মেলা গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে বিশাল মাঠে, পথের পাশের স্বল্প পরিসর স্থানে; ঐ যে মাটির পুতুল, ঘোড়া, হাতি, বর-কনে, নাগরদোলা; ঐ যে বাউলগান গ্রামের মেলায় আর রমনার বটমূলে ছায়ানটের আসর ঢাকা শহরে; ঐ যে রঙিন পোশাকে সুসজ্জিত নর-নারী, বালক-বালিকা; ঐ যে উচ্ছ্বসিত আর উৎফুল্লিত শিশুর দল—সবই তো বৈশাখী মেলার উৎসব। নানান রঙে আর ঢঙে বাঙালিরা আমোদিত হয় বছরের প্রথম দিন।

২। বৈশাখী মেলার উৎসবের দিকের পাশাপাশি এর অর্থনৈতিক দিকও রয়েছে—বিশেষত বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এই মেলা উপলক্ষে কুমোর, ময়রা, তাঁতি, বাঁশ-বেত শিল্পীদের জন্য নতুন কর্ম-নিয়োজনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। নতুন করে কাজ আসে যাত্রা-শিল্পীদের, কবিয়ালদের, গায়ক-বাদকদের। নতুন করে বিনিয়োগ হয় নানান ক্ষেত্রে, আয়ের সৃষ্টি হয় নানান খাতে।

গ্রামের নারীদের জন্য বৈশাখী মেলা নানান আর্থিক সুফল বয়ে আনে। সারা বছর ধরে তারা যে পাটি, ছোট ছোট ঝুড়ি ও টুকরি, পট বানান, বাড়ির পুরুষদের হাত ধরে তা পাড়ি জমায় বৈশাখী মেলায়। তাঁতি-বৌয়েরা যে সব গামছা, ছোট্ট শাড়ি তৈরি করেন তাও প্রবেশ করে বৈশাখী মেলায়। সদ্য রবিশস্য থেকে প্রাপ্ত আয় নিয়ে ক্রেতারা আসেন মেলায়। কেনেন নানান পণ্যসামগ্রী। গ্রামীণ অর্থনীতিতে যোগ হয় নতুন মাত্রা।

গ্রামের নারীদের জন্য বৈশাখী মেলা নানান আর্থিক সুফল বয়ে আনে। সারা বছর ধরে তারা যে পাটি, ছোট ছোট ঝুড়ি ও টুকরি, পট বানান, বাড়ির পুরুষদের হাত ধরে তা পাড়ি জমায় বৈশাখী মেলায়।

৩। বৈশাখী মেলার ঐতিহ্যের দিকটিইবা ভুলি কী করে? মেলায় ঐ যে কুমোরেরা মাটির পুতুল, ঘোড়া, হাতি, বর-কনে ইত্যাদি নিয়ে বসেছেন; ময়রারা বসেছেন মিষ্টি, লাড্ডু, বাতাসা, জিলাপি, কদমা নিয়ে; কিংবা শিল্পীরা দোকান সাজিয়েছেন ডালা, কুলা বা বেতের ঝুড়ি দিয়ে, সবকিছুতেই বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি জড়িয়ে আছে।

বাঙালির চিরায়ত জীবন, জগৎ, সংস্কৃতি আর কৃষ্টির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কিছু সনাতন ঐতিহ্য। গ্রামে একবারে প্রত্যুষে এক ডুবে পুকুরের এপার থেকে ওপারে গিয়ে জলে ঝুঁকে পড়া আমগাছের দুটো আম ছিঁড়ে নিয়ে আসা যেমন এই ঐতিহ্যের অংশ, তেমনি মাটির বাড়ি আর উঠোন নিকিয়ে তাতে আলপনা আঁকাও এই ঐতিহ্যেরই একটা দিক।

‘বছরের প্রথম দিনে সবাই মিলে ভালো-মন্দ খেলে বছরটা ভালো যাবে’—এই সরল বিশ্বাস যেমন ঐতিহ্যের ধারক, তেমনি ব্যবসার হালখাতা আর পেতলের ঘটিতে রাখা পাঁচটি আমপাতাও এই ঐতিহ্যেরই বাহক। 

৪। বাংলার বৈশাখী মেলা শুধু বাংলার আর বাঙালিদের। পৃথিবীর আর কোনো জাতিসত্তা এর অধিকার দাবি করতে পারে না। শুধুমাত্র বাঙালিরাই আত্মমগ্ন হয়ে বৈশাখী মেলা উদযাপন করে—তা তারা দেশেই থাকুক, কিংবা বিদেশে। তাই তো দেশের সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাই দেশের বাইরেও পৃথিবীর আনাচে-কানাচেও বাঙালি মাত্রেই উদ্বেলিত হচ্ছে পয়লা বৈশাখে।

কেন এই আত্মমগ্নতা, কেন এই উদ্বেলতা? কারণ এর সঙ্গেই বাঙালি তার জাতিসত্তাকে সংযুক্ত করে, তার আত্মসত্তাকে খুঁজে পায়। বৈশাখী মেলা তাই বাঙালির আত্মসত্তা আর জাতিসত্তার প্রতীক।

৫। বৈশাখী মেলার চেতনা তো সর্বজনীন। এই চেতনাকে বুকে ধারন করেই তো বর্ণ, ধর্ম, দল, মত নির্বিশেষে আমরা সবাই এক কাতারে মিলিত হই। আমাদের বুকের মাঝে নিরন্তর অনুরণিত হতে থাকে ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালী।’

সর্বজনীনতার চেতনাই তো আমাদের উদ্বুদ্ধ করে সেই মন্ত্রে ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ,’। বৈশাখী সর্বজনীনতাই আমাদের সবাইকে যুক্ত করে; আবার সেই সর্বজনীনতাই আমাদের মুক্তও করে—মুক্তবুদ্ধি আর মুক্তচিন্তা নিয়ে আমরা সংযুক্ত হই সবার সঙ্গে।

বৈশাখী মেলার সঙ্গেই সম্পৃক্ত মঙ্গল শোভাযাত্রা। জগতের সব শাস্ত্রই মানুষের মঙ্গলের কথা বলে, কারণ সেই মঙ্গল কামনা মানবতার মূল কথা। মানব-মঙ্গল কামনা প্রক্রিয়ায় আচার-বিধান বড় কথা নয়, তার অন্তর্নিহিত বোধটিই হচ্ছে মুখ্য।

বৈশাখী মেলার সঙ্গেই সম্পৃক্ত মঙ্গল শোভাযাত্রা। জগতের সব শাস্ত্রই মানুষের মঙ্গলের কথা বলে, কারণ সেই মঙ্গল কামনা মানবতার মূল কথা। মানব-মঙ্গল কামনা প্রক্রিয়ায় আচার-বিধান বড় কথা নয়, তার অন্তর্নিহিত বোধটিই হচ্ছে মুখ্য।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের তিনটা মাত্রিকতা আছে। প্রথমত, নতুন বছরের শুরুতেই মানবিকতার চেতনা, মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্য, আন্তধর্ম সম্প্রীতির প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা।

দ্বিতীয়ত, সেই সঙ্গে অভিব্যক্ত করা আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের আনন্দ, সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির সুখ, ধর্মীয় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নিরাপত্তা। এখানে মানবতাই বড়।

তৃতীয়ত, সর্বজনীনতা। সব ধর্মের মানুষ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারে। আমাদের বিভিন্ন আত্মসত্তার বা আত্মপরিচয়ের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।

প্রকৃত প্রস্তাবে, আমাদের প্রত্যেকেরই বহুমাত্রিক আত্মসত্তা রয়েছে। একজন মানুষ একই সঙ্গে হতে পারেন বাঙালি, মুসলমান, নারী, পেশাজীবী, মধ্যবয়স্ক, সন্তানের জননী ইত্যাদি। সবই তার বহুবিধ আত্মপরিচয়ের নানান দিক। এইসব সত্তার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই এবং বাস্তবে তার এই বিভিন্ন সত্তার মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে তার এক বা একাধিক সত্তা প্রাধান্য পায়।

সুতরাং বাঙালি আত্মপরিচয়ের প্রেক্ষিতে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা সবার মঙ্গল কামনা করি। কারণ ওটা আমাদের বাঙালিত্বের ঐতিহ্য, আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির অংশ, বাংলা নববর্ষ উৎসবের প্রাণ। চিরায়ত বাংলাদেশে সনাতন কাল থেকে সব বাঙালিই তা করেছে, আজও করছে, ভবিষ্যতেও আজকের বাংলাদেশে বৈশাখী মেলার এই সব চেতনা আর প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম।

আমাদের সমাজে আজ মৌলবাদ বিপজ্জনকভাবে ক্রমবর্ধমান। আমাদের ভূখণ্ডের চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আজ অপসৃত প্রায়। আমাদের সনাতন মূল্যবোধ—যার কেন্দ্রবিন্দু সর্বজনীন মানবতা—তা আমরা দ্রুত বিস্মৃত হচ্ছি।

আমাদের বাঙালি আত্মসত্তাকে ভুলিয়ে দিয়ে এক অনাবশ্যক বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াসে তৎপর শত্রুরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার চেতনা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। এই সবকিছু প্রতিহত করে পুরো জাতিকে ঘুরে দাঁড়াতে বৈশাখী মেলার চেতনার বড় বেশি প্রয়োজন।

ড. সেলিম জাহান ।। ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র