আট দফায় পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটি একটি রেকর্ড। মার্চের শেষ থেকে এপ্রিল মাস জুড়ে চলে এই নির্বাচন। গণনা শেষে ফল ঘোষণা হয় ২ মে। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে, ২৯৪ আসনের বিধান সভায় ২১৩ আসন পেয়ে ভূমিধস বিজয় হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের।

বিজেপি পেয়েছে ৭৭ আসন। বাম কংগ্রেস জোট সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, একটিও আসন পায়নি তারা। ছোট একটা অঘটন অবশ্য ঘটেছে নির্বাচনে। নন্দী গ্রাম আসনে সামান্য ব্যবধানে মমতা পরাজিত হয়েছেন তারই এককালের শিষ্য, দলত্যাগী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে। তাতে করে অবশ্য তার মুখ্যমন্ত্রিত্বে কোনো বাধা সৃষ্টি হচ্ছে না।

ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, বিধান সভায় তৃণমূল সদস্যরা তাকে নেতা নির্বাচন করলে (না করার কোনো প্রশ্ন নেই) তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। শুধু পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে তাকে কোনো একটি আসনে উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে হবে।

বিপুল আসনে না হলেও, সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেই তৃণমূল, এটাই প্রত্যাশা ছিল বেশিরভাগ মানুষের। তবে বিজেপির একেবারে শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যন্ত যেভাবে আদা জল খেয়ে লেগেছিল, তাতে একটা অঘটন ঘটেও যেতে পারে এমন ধারণা ছিল কারো কারো।

বিশেষ করে টাকা পয়সার ছড়াছড়ি, দল থেকে লোক ভাগিয়ে নিয়ে আসা, ইত্যাদি নির্বাচনী অপকর্ম বিজেপি করেছে পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য রাজ্যের মতোই। বিজেপি নেতৃত্বে, তাই খানিক হতাশা আছে জিততে না পারায়। বিশেষ করে গত নির্বাচনগুলোতে আসাম ও ত্রিপুরা দখল এবং লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে অভাবিত ভালো ফলের পর দলটির প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিল।

আমার মতে, সদ্য সমাপ্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভা নির্বাচনে বিজেপির অর্জন মোটেও কম নয়। সাকুল্যে তিনটি আসন জিতেছিল তারা ২০১৬ সালের নির্বাচনে, সেখানে এবারে তাদের আসন সংখ্যা ৭৭, ভোট প্রায় শতকরা চল্লিশ ভাগ। পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ বছর আগের নিতান্ত প্রান্তিক অবস্থান থেকে বিজেপি এখন শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একমাত্র বিরোধী দল। এ অবস্থানে আসার পথে তারা রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ভোটারদের একটা বড় অংশকেও তারা বেশ ভালোভাবে দলে টানতে সক্ষম হয়েছে। এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে, আগামীতে সরকার গঠনের মতো অবস্থানে যাওয়ার স্বপ্ন তারা দেখতেই পারে।

মমতা বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দেবেন না একথা স্পষ্টই বলেছেন। বিজেপি কী বলেছে তারা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় গেলে তিস্তা চুক্তি করবে? তা কিন্তু তারা বলেনি।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে সবার আগ্রহ থাকলেও আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু তিস্তা। দৃশ্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণেই প্রায় ঠিক হয়ে যাওয়া তিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। কারো কারো মতে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি জিতলে তিস্তা পানি চুক্তির সম্ভাবনা বেড়ে যেতো। এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ একমত নই।

আমাদের বুঝতে হবে যে, তিস্তা নদীতে মোটেও পানির সমস্যা নয়, সমস্যাটা হচ্ছে পানি নিয়ে ভোটের রাজনীতি। রাজ্য ক্ষমতায় যে দলই আসুক, এই রাজনীতি সহজে শেষ হবে না। অর্ধেক আসন জিতে বিজেপি যদি রাজ্য ক্ষমতায় আসতো, তারা নিশ্চয় তিস্তা চুক্তি সমর্থন করে, মমতার হাতে ভোটের অস্ত্র তুলে দিতো না। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুশি করার জন্য কিছু করা যায় কিনা তা খুঁজে দেখা যায়। তবে চুক্তি তো হবে দিল্লি-ঢাকার মধ্যেই, তাই চাপ দেওয়ার মতো কোনো তাস যদি থাকে আমাদের হাতে, তা খেলতে হবে দিল্লির সঙ্গেই।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ফলাফল তাহলে কীভাবে দেখবে বাংলাদেশ? স্বস্তি, অস্বস্তি, আশা, নিরাশার কী আছে এতে? পশ্চিমবঙ্গে বা কেন্দ্রে কোথাওই ক্ষমতার কোনো পালাবদল হয়নি, কাজেই সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন প্রত্যাশিত নয়। তবে সাম্প্রদায়িক তাস খেলেনি, এমন একটি দলই ক্ষমতায় রয়ে গেছে রাজ্যে।

আসাম, ত্রিপুরার পর এটা খানিকটা স্বস্তির কারণ হতে পারে। আসামের পর পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক পঞ্জির হুমকি বিজেপি নেতৃত্ব দিয়ে রেখেছিল সেটাও হয়তো খানিকটা স্তিমিত হবে তাতে। তবে নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোটের চরম দুর্দশা আমার মতে একটি অশনি সংকেত।

বিজেপি একটি নীতি ভিত্তিক দল, সে নীতি যতই বিভাজনকারী, প্রগতি বিরোধী হোক না কেন, পক্ষান্তরে তৃণমূল দলটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। দীর্ঘমেয়াদে, ব্যাক্তির অবর্তমানে বিজেপির অগ্রযাত্রা রুখবার মতো কোনো শক্তি পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়াবে কিনা, সেটা একটি আশঙ্কা হয়েই থাকবে।

মো. তৌহিদ হোসেন ।। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব