মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮ ও পর্যালোচনা
কাণ্ডজ্ঞানহীন, বিকৃতমস্তিষ্ক, উন্মাদ—নানা শব্দের সরল শব্দ হলো পাগল। মানব ইতিহাসের প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে কয়েক শতক আগ পর্যন্তও মানসিক ব্যাধির ফলে বিচিত্র আচরণকে ধরে নেওয়া হতো মগজে কোনো অশনি আত্মার অবস্থান। এ দীর্ঘ সময় মানসিক উন্মত্ততার বহুল প্রচলিত একটি চিকিৎসা ছিল মস্তিষ্কের খুলিতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গোল করে কেটে দেওয়া যাতে সেই অশনি আত্মা বের হয়ে যায়। স্বভাবতই অতি রক্তক্ষরণ ও তীব্র যন্ত্রণার ফলে সে ব্যক্তিটির আচরণ হয়ে যেত মোলায়েম। ধরে নেওয়া হতো অশনি আত্মা বের হয়ে গেছে সে খুলির জানালা দিয়ে। মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আলাদা করে রাখার জন্য মধ্যযুগ পরবর্তী সময়ে ইউরোপসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে গড়ে উঠে আশ্রম। সময়ের আবর্তে মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত এ ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে সচেতন হয় রাষ্ট্র। যার প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ভারতে প্রণীত হয় ‘লুনাসি অ্যাক্ট ২০১২’ যা সীমিত আকারে মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ও অধিকার সুরক্ষার একমাত্র রক্ষাকবচ হিসেবে বহাল ছিল আমাদের বাংলাদেশেও কিছুদিন আগ পর্যন্তও। বিলম্ব হলেও ২০১৮ সালে প্রণীত হয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য আইন। এ আইনের মাধ্যমে এসেছে শব্দের পরিমার্জিত পরিবর্তন, এসেছে সময়োপযোগী বিধি-বিধান। জাতীয়ভাবে আমরা হাল আমলের আইনি কাঠামো পেয়েছি তাদের অধিকার সুরক্ষায়। তবে বিদ্যমান এ আইনটির কতিপয় বিষয়ের ওপর একজন মানসিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে কিছু গঠনমূলক আলোচনা তুলে ধরছি।
আইনে মাদকাসক্তি, মানসিক অসুস্থতা (Mental Illness), মানসিক রোগ (Mental Disorder) এবং মানসিক অক্ষমতা (Mental Disability)—এই চারটি বিষয়কে আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া, সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে কেবল মানসিক অসুস্থতায় (Mental Illness) আক্রান্ত ব্যক্তিরাই সুরক্ষা পান। ফলে, মানসিক রোগ (Mental Disorder), মাদকাসক্তি বা মানসিক অক্ষমতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা এই আইনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী মানসিক অসুস্থতা নির্ণয়ের আদর্শ মানদণ্ড (DSM-5-TR ও ICD-11) অনুযায়ী, উল্লিখিত সবকটি ধারণাকেই এককভাবে ‘Mental Disorder’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অতএব, আইনে এই সংজ্ঞায়নটি স্পষ্ট করে দেওয়া এবং কোনো০ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি কী ধরনের আইনি সুরক্ষা লাভ করবে, তার সুনির্দিষ্ট বিধান থাকা আবশ্যক।
বিজ্ঞাপন
বোধ করি ঔপনিবেশিক আইনের ধারাবাহিক চর্চা, নৈতিক মানদণ্ড ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মাদকাসক্তি একটি অপরাধ বলেই মাদকাসক্তিকে আলাদা করা হয়েছে অন্যান্য মানসিক ব্যাধিগুলো থেকে। কিন্তু এ অপরাধের একটি অংশে ড্রাগ ডিলার আর অপর অংশে রয়েছে সেবনকারী। দেখা যায় সেবনকারীদের অধিকাংশই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মানদণ্ডে মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত (Substance Abuse Disorder)। মাদকের বিরুদ্ধে যেমন প্রয়োজন কঠোর আইনের প্রয়োগ, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্য আইনও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর সাথে সমন্বয় করে প্রকৃত মানসিকভাবে অসুস্থ হিসেবে চিহ্নিত মাদকসেবীদের পুনর্বাসনসহ তাদের আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করাটা এখন সময়ের প্রয়োজন। গবেষণায় দেখা যায়, মাদকাসক্ত ব্যক্তি, যারা মাদকের অপব্যাবহারজনিত মানসিক রোগে (substance abuse disorder) আক্রান্ত, তাদের অন্যান্য আরও একাধিক মানসিক সমস্যাও (comorbidity), যেমন তীব্র বিষণ্নতা (Major Depression), উদ্বেগ (Anxiety), সাইকোসিস (Psychosis), পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার (Personality disorder)সহ ইত্যাদি। দেখা যায়, তাদের কারাদণ্ডের মতো শাস্তি আরোপ করলে মাদকাসক্তি প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায় এবং সমাজে পুনরায় ফিরে আসতে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয় যা তার নেশা করার প্রবণতা আরও বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়াও এ শাস্তি তার ভেতর মর্মাঘাত (Trauma), অনিরাপদ ও লজ্জাবোধ করা, নিজেকে অর্থহীন মনে করার ফলে নানা ধরণের জটিল মানসিক সমস্যার দিকে ধাবিত করে। অথচ মানসিক স্বাস্থ্য আইনে কেবলমাত্র মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের কথাই বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
এবার আসি মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা প্রক্রিয়ার বিধানে। আইনের সংজ্ঞায়নে মানসিক রোগের সাথে সংশ্লিষ্ট তিন ধরণের পেশাজীবীর কথা বলা হয়েছে—
১) মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ (Psychiatrist),
২) মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত পেশাজীবী বা সাইকোলজিস্ট
এবং ৩) দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার। এ স্পষ্টীকরণ মনোরোগের সাথে জড়িত পেশাজীবীদের ধরন সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা লাভ করা গেলেও কার ভূমিকা কী তা সম্পর্কে স্পষ্টীকরণ জরুরি ছিল। এছাড়াও, ‘মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত পেশাজীবী বা সাইকোলজিস্ট’-এর সংজ্ঞায়নে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, এডুকেশনাল সাইকোলজিস্ট, কাউন্সিলিং সাইকোলজিস্ট এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী, সাইকিয়াট্রিক, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্ক, অকুপেশনাল থেরাপি, এডুকেশনাল সাইকোলজি, কাউন্সিলিং, কাউন্সিলিং সাইকোলজি, সাইকোথেরাপি এবং সাইকিয়াট্রিক নার্সিং-এ নিয়োজিত স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে। কিন্তু সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্ক, অকুপেশনাল থেরাপি ও সাইকিয়াট্রিক নার্সিং চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের থেকে লেখাপড়ার কারিকুলাম, সময়কাল ও উদ্দেশ্য ভিন্ন। একজন ক্লিনিক্যাল/কাউন্সিলিং সাইকোলজিস্ট চার বছরের অনার্স সম্পন্ন করার পর এক থেকে দেড় বছরের মাস্টার্স, এরপর মানসিক হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ এবং কিছু ক্ষেত্রে এমফিল সম্পন্ন করে পেশাদার চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি পান। তাদের উদ্দেশ্য হলো বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত ও প্রমাণিত বিভিন্ন ধরণের সাইকোথেরাপি ও মনোবিজ্ঞানের অন্যান্য পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে একজন মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষকে সুস্থ করে তোলা। মানসিক রোগের ধরনই হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি থেকে কেবলমাত্র ওষুধে আরোগ্য লাভ সম্ভব হয় না। অর্থাৎ মনোচিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও অন্যান্য পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চিকিৎসা পরিচালিত হলেই কেবল কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব। আইনে এ বিষয়ে স্পষ্টীকরণ জরুরি।
মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় রোগ নির্ণয় ও মেডিকেল সনদ প্রদানের দায়িত্ব কেবলমাত্র মেডিক্যাল অফিসার বা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের ওপর ন্যস্ত করা বোধগম্য নয়। একজন মানসিক হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসারের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ বা বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকার সম্ভাবনা থাকে। যেহেতু মানসিক রোগ নির্ণয় অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া, সেহেতু মেডিক্যাল অফিসারের পরিবর্তে শুধুমাত্র মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং মানসিক রোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর উপরে এই দায়িত্ব ন্যস্ত হওয়া সমীচীন। এই প্রক্রিয়ায় মনোবিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের বিশেষায়িত পড়াশোনা, অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে।
মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের যৌক্তিক সিদ্ধান্তগ্রহণের অক্ষমতা বিবেচনায় আইনে অভিভাবকত্ব নির্ণয়ের বিষয়টি প্রশংসনীয়। তবে, মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির ওপর নির্যাতন হলে তার আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ অধিকতর স্পষ্ট হওয়া জরুরি। এছাড়াও ভরণ-পোষণ, যত্ন, ও চিকিৎসার খরচ সংক্রান্ত বিদ্যমান নির্দেশনাগুলোর প্রক্রিয়াগত বিষয়গুলো আরও প্রায়োগিক ও স্পষ্ট করা প্রয়োজন। প্রায়শই দেখা যায়, বিত্তশালী মানসিক অসুস্থ ব্যক্তিরাও সন্তানদের অযত্ন-অবহেলায় ফুটপাতে দিনযাপন করে এবং বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। তাই অভিভাবক (Guardian), কাস্টোডিয়ান (Custodian) ও ম্যানেজার (Manager)—এই তিন সত্তার ভূমিকা স্পষ্ট করে প্রচলিত উত্তরাধিকার আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত।
আইনের প্রশ্নে আইনটির বিচার প্রাপ্তির সময়সীমা নিয়ে সবসময়ই একটি গভীর শঙ্কা ও জটিলতা থেকে যায়। যেহেতু মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের বিচারিক সিদ্ধান্ত প্রাপ্তি একটি জরুরি বিষয়, সেহেতু লম্বা সিভিল প্রক্রিয়া অনুসরণের বদল এক্ষেত্রে সামারি ট্রায়াল বা সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতি প্রয়োগের কথাও ভাবা যেতে পারে।
মানুষের জন্য আইন; আইনের জন্য মানুষ নয়। তাই আইনকে ভবিষ্যৎকালে বিধি প্রণয়নের ওপর ছেড়ে না দিয়ে বরং আইনটিকেই শক্তিশালী, নিখুঁত ও প্রায়োগিক করা একান্ত জরুরি। তবেই প্রকৃতপক্ষে নিশ্চিত হবে মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত অসহায় মানুষের মানবিক অধিকার।
ইমদাদুল হক তালুকদার : সহকারী অধ্যাপক (খণ্ডকালীন), মনোবিজ্ঞান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
haque.talukdar@gmail.com