অপরাধীরা ভয়ংকর ও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষের মনে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করে। মানুষ যেকোনো পরিস্থিতিতে অপরাধে আক্রান্ত হতে পারে, এমন আশঙ্কা ও ভয়ই মূলত ভয়ের সংস্কৃতির আবহ তৈরি করে। ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে বাসায় ফিরে আসতে পারবে এমন সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে।

বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতির ব্যাপকতা বেড়েছে এবং মানুষের অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে। আবার মানুষের জীবনাচরণ ও জীবনবোধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাও প্রকট আকার ধারণ করছে। অপরাধে মানুষ সাধারণত তিন ধরনের ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি হয়।

প্রথমটি হচ্ছে প্রাথমিক ক্ষতিগ্রস্ততা (Primary Victimization) যেখানে ব্যক্তি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্যক্তি কারও দ্বারা আঘাতের শিকার হয়েছে কিংবা গুরুতর আঘাতের শিকার হয়েছে।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে মাধ্যমিক ক্ষতিগ্রস্ততা (Secondary Victimization)-এর ক্ষেত্রে ব্যক্তি শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না কিন্তু ব্যক্তির সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। যেমন ব্যক্তির ঘরবাড়ি লুট, আগুনে দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি।’

তৃতীয়টি হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ততা (Tertiary Victimization)-রাষ্ট্রীয় স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি; এর প্রভাব ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর বর্তায় এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি মেডিকেল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে সমাজের বিপুল জনগোষ্ঠীর ওপর আঘাত হানা ইত্যাদি। 

অপরাধবিজ্ঞানের Lifestyle Theory of Victimization তত্ত্বটি Michael Hindelang, Michael Gottfredson, এবং James Garofalo ১৯৭৮ সালে প্রদান করেন। একজন ব্যক্তির জীবনাচরণ তার অপরাধে আক্রান্ত হওয়া তথা ক্ষতিগ্রস্ততার জন্য কীভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে তার স্বরূপ উন্মোচন করা হয়েছে তত্ত্বটিতে।

যারা পরিবারের বাইরের মানুষের সাথে বেশি সময় কাটায়, তাদের অপরাধে শিকার হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। পরিবারের মানুষের সাথে আন্তরিকভাবে যতটা মেশা যায়, সমস্যার বিষয় খোলাখুলিভাবে শেয়ার করা যায়; অন্যদের সাথে এসব ব্যাপারে তেমন আলোচনা করার উপায় নেই।

পরিবর্তিত দায়িত্ব ও কর্মসূচির কারণে মানুষের জীবনাচরণ ব্যতিক্রম হয়ে থাকতে পারে। জীবনাচরণের বৈচিত্রতা এবং ভিন্নতর অবস্থানের কারণে অনেকের উচ্চতর ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আবার যাদের সঙ্গে উঠাবসা, দৈনন্দিন সময় কাটানো, বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করা তাদের যাপিত জীবন পাশের জনকে প্রভাবিত করতে পারে। 

লাইফস্টাইল তত্ত্বের অন্যতম একটি প্রস্তাবনা হলো: একজন ব্যক্তি লোকসমাগমে (বড় রাস্তা, পার্ক, বাজার) যত বেশি সময় ব্যয় করবে ঐ ব্যক্তির অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি থাকবে। বিশেষ করে রাতের বেলা লোকজ স্থানে অধিক সময় ব্যয় করলে উক্ত ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি হবে। বাস্তবিক অর্থে বাংলাদেশে অপরাধের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাতের বেলা অপরাধের হার দিনের তুলনায় বেশি এবং যারা বেশিক্ষণ ঘরের বাইরে সময় কাটায় তাদের অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও রাতের বেলায় অপরাধ বেশি সংঘটিত হয়ে থাকে এবং যে বা যারা বাইরে বেশি সময় কাটায় তাদের আক্রান্ত হওয়ার অনুপাত তুলনামূলকভাবে বেশি।

দ্বিতীয়ত: রাতে পাবলিক প্লেসে থাকার কারণে মানুষের জীবন দর্শন ও জীবনাচরণে বৈচিত্র্যতা লক্ষ্য করা যায়। যারা নিয়মিত রাতের বেলা বাইরে সময় কাটায় তাদের জীবন দর্শন স্বাভাবিকের থেকে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। এই ব্যতিক্রম জীবনবোধের কারণে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি হয়ে থাকে। তাছাড়া অপরাধীরা রাতের সময় টার্গেটকে লক্ষ্য করে ভুক্তভোগীর ক্ষতিসাধন করে থাকে। কেননা গভীর রাত কিংবা ভোর রাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢিলেঢালা হওয়ায় অপরাধীরা সহজেই অপরাধ করে পার পেয়ে যায়।

তৃতীয়ত: সামাজিক বন্ধন ও মিথস্ক্রিয়া আনুপাতিক হারে ঘটার কারণে মানুষের অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। সামাজিক বন্ধনের সাথে সাথে মানুষের পারস্পারিক মেলবন্ধন একই গতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু সামাজিক কন্ট্রাক্টের সাথে যদি মেলবন্ধনের পার্থক্য দেখা যায় তাহলে ব্যক্তির অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সামাজিক বন্ধন হয় মূলত পারস্পারিক সৌহার্দ ও সম্প্রীতি বজায় রাখার স্বার্থে। এর বিপরীতমুখী অবস্থান ব্যক্তিকে আক্রান্ত করে থাকে, সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে এবং সামাজিক সাম্যবস্থার বিচ্যুতি ঘটায়।

চতুর্থত: আর্থ-সামাজিক অবস্থান অপরাধীর সঙ্গে যারা শেয়ার করেন তাদের অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। Ronald Clarke and Derek Cornish তাদের Rational Choice তত্ত্বে দেখিয়েছেন; কোনো অপরাধী সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে অধিক মুনাফা ও নিম্ন ক্ষতির হিসাবকে সামনে নিয়ে অপরাধ সংঘটন করে থাকে।

এ ক্ষেত্রে অপরাধীর সঙ্গে কোনো ব্যক্তির আর্থ সামাজিক অবস্থানকে তুলে ধরার কারণেই অপরাধী ব্যক্তির বিপরীতে অপরাধকর্ম সংঘটনের যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করে থাকে। ব্যক্তির পারিবারিক অবস্থান জানা থাকলে অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যক্তির কঠোর অবস্থান গ্রহণের ব্যাপারে জানা যায়। সব বিষয়কে সামনে এনে অপরাধী যখন নিজের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি খুঁজে পায় তখনই সে অপরাধ করে এবং ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি করে। 

পঞ্চমত: যারা পরিবারের বাইরের মানুষের সাথে বেশি সময় কাটায়, তাদের অপরাধে শিকার হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। পরিবারের মানুষের সাথে আন্তরিকভাবে যতটা মেশা যায়, সমস্যার বিষয় খোলাখুলিভাবে শেয়ার করা যায়; অন্যদের সাথে এসব ব্যাপারে তেমন আলোচনা করার উপায় নেই।

পরিবারের সদস্যদের সাথে আন্তরিকভাবে মেশার কারণেই সমাজের প্রচলিত রীতি নীতি ও আচারাদির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মেশা যায় এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা তৈরি হয়। যাদের পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয়, তাদের সামাজিক বন্ধনও মজবুত হয়। ফলশ্রুতিতে তারা অপরাধের ঝুঁকি থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে।  

ষষ্ঠত: নিজ পরিবারের বাইরের কারও সাথে বেশি সময় কাটালে ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। পরিবারের বাইরের যারা তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিকে ভিন্নপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করে এবং ব্যক্তিও তাদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় অনেক সময় মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হয়।

আমাদের সমাজে এমন ঘটনার অজস্র উদাহরণ রয়েছে বিশেষ করে যারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে কিংবা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ে; দেখা যায় তারা বাইরের মানুষ দ্বারা প্রভাবিত এবং বাইরের মানুষের সাথে অবৈধ ব্যবসা বাণিজ্যের অংশীদার। অর্থাৎ নিজ পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে ঝুঁকির পথে পরিচালিত হওয়ার উদাহরণ একেবারেই নগণ্য।

সপ্তমত: লাইফ স্টাইলের বৈচিত্র্যতা বিশেষ করে সুবিধাজনক পরিস্থিতি, স্থানিক বৈশিষ্ট্য এবং ব্যক্তির উপস্থিতিজনিত সূচক ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি করে থাকে। Lawrence Cohen and Marcus Felson তাদের Routine Activity Theory-তে দেখিয়েছেন; উপযুক্ত টার্গেট (suitable target), অপরাধ সংঘটনে আগ্রহী ব্যক্তি (motivated offender), প্রকৃত মালিকের অনুপস্থিতি (absence of capable guardian)-এ তিনের সমন্বয়ে একটি অপরাধ সংঘটিত হয়।

অপরাধীকে সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে হবে। পরিবেশগত উপায়ে এমন অবস্থান সৃষ্টি করতে হবে যাতে অপরাধীকে সহজেই শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করে আইনের মাধ্যমে বিচার নিষ্পত্তি করা যায়।

ব্যক্তির জীবনবোধ ও নৈমিত্তিক কাজকর্মের ওপর ভিত্তি করে অপরাধীরা ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে অপরাধ করে থাকে, ব্যক্তির উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির ওপর নির্ভর করে অপরাধীরা টার্গেট নির্ধারণ করে থাকে এবং পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধে আগ্রহ ব্যক্তিরা অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকে। 

কাজেই মানুষের জীবনাচরণ, জীবনবোধ, মিথস্ক্রিয়া, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন প্রভূত বিষয়গুলো অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ব্যক্তি কার সাথে মিশবে, কোন প্রক্রিয়ায় জীবন গড়ার চেষ্টা করবে, কোন সময় ঘরের বাইরে অবস্থান করবে ইত্যাদি বিষয়গুলো ব্যক্তির ক্ষতিগ্রস্ততার সূচক নির্ধারণ করে থাকে।

সামাজিক গোষ্ঠী, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যক্তির যোগসূত্রতা নির্ধারণে ব্যক্তির পারিবারিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সুতরাং অপরাধে ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি থেকে বিরত থাকার চেষ্টায় অবস্থান ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আধুনিক ও ধীর স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

অপরাধীকে অপরাধ সংঘটনের কোনো সুযোগ দেওয়া যাবে না, অপরাধীকে সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে হবে। পরিবেশগত উপায়ে এমন অবস্থান সৃষ্টি করতে হবে যাতে অপরাধীকে সহজেই শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করে আইনের মাধ্যমে বিচার নিষ্পত্তি করা যায়।

ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই মানুষের জীবন পরিচালনা করতে হবে, পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি সংস্থার মাধ্যমে অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধের মাধ্যমে অপরাধে ক্ষতিগ্রস্ততা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সার্বিকভাবে কাজ করে যেতে হবে। 

মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়