ঋণ খেলাপিদের সঙ্গে জামিনদার ও সুবিধাভোগীদেরও কি শাস্তির আওতায় আনা উচিত?
দীর্ঘদিন ধরে দেশের ব্যাংকিং খাত খেলাপি ঋণের ক্যান্সারে জর্জরিত। বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় চেষ্টা-তদবির করেও ঋণের টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। উল্টো ক্রমাগত অনাদায়ী ঋণের বোঝা বাড়ছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর পাশাপাশি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও ঋণের টাকা আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আইন ও নীতি সংস্কারের নানা উদ্যোগের কারণে তাদের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত কমছে। উল্টো চিত্র বাংলাদেশের। এজন্য বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ।
সম্প্রতি প্রকাশিত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) ‘ননপারফর্মিং লোনস ওয়াচ ইন এশিয়া ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ এশিয়ার 'সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার' দেশ। ২০২৩ সাল শেষে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ২০ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সাল থেকে প্রতি বছরই বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৮ শতাংশ, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মতো ২০২১ সাল থেকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার। বাকি দেশগুলোর খেলাপি ঋণ কমেছে। যেমন ভুটানের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ৩ শতাংশ। ভারতের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। মালদ্বীপের খেলাপি ঋণ এই সময়ে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিজ্ঞাপন
তবে ২০২৩ সাল ভিত্তিক ওই প্রতিবেদনের তুলনায় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৩৩ শতাংশ। এর আগে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে বার্ষিক হিসেবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ।
খেলাপি ঋণের হার ও পরিমাণ বাড়ছে কারণ আদায়ের চিত্র করুণ। বাংলাদেশে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা দুর্বল এবং বিভিন্ন সময়ে প্রণীত নিয়ম-নীতিগুলো বছরের পর বছর ঋণ খেলাপিদের সুবিধা দিয়ে গেছে। ঋণ আদায়ে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম কঠোর আইন প্রবর্তন করেছে এবং প্রয়োগ নিশ্চিত করেছে। চীন ও ভিয়েতনামে ঋণ খেলাপিদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। সব ধরনের রাষ্ট্রীয় অধিকার, সুযোগ-সুবিধা এবং বাণিজ্য বন্ধ থাকে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঋণের টাকা ফেরত না দিলে সব সম্পদ জব্দ করা হয়। ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া আদালতে যাওয়ার সুযোগই পান না ঋণ খেলাপিরা। যথাযথ কারণ দর্শাতে পারলে ব্যাংক আদালতে যাওয়ার অনুমোদন দিয়ে থাকে।
বিজ্ঞাপন
তবে এদিক থেকে ভিন্ন বাংলাদেশ। এখানে সব আইন-কানুন, বিধি-বিধান যেন ঋণ খেলাপিদের পক্ষে। বিদ্যমান আইনে সুবিধা প্রদান করা সম্ভব না হলে নানান অজুহাতে নতুন নীতিমালার প্রণয়নের মাধ্যমে ঋণ খেলাপিদের সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। ঋণ খেলাপিদের সুবিধা দেওয়া শুরু হয়েছে মূলত ২০০৯ সালের পর থেকে। ঋণ খেলাপিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের চাপে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়, ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে দেওয়া হয় খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা, ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে দেওয়া হয় বিশেষ ছাড় এবং ২০১৯ সালে ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। এসব ছাড়ের কারণেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আবার নানা আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর এক সার্কুলারের মাধ্যমে ঋণ খেলাপিদের নতুন করে সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। এই সুবিধার আওতায় মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ নবায়ন বা পুনর্গঠন করা যাবে। এতে খেলাপি তকমা কাটানোসহ গ্রেস পিরিয়ড এবং সর্বনিম্ন সুদ হারের তুলনায় ১ শতাংশ কম সুদে ঋণ পরিশোধের সুবিধা ভোগ করবেন ঋণ খেলাপিরা।
আরও পড়ুন
ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলেও বৈশ্বিক উন্নয়ন ও দাতা সংস্থাগুলোর চাপে আইনগত সংস্কার করেছে বাংলাদেশ। ১৯৮৬ সালে অর্থ ও ঋণ নিয়ে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা হয়। এরপর দাতাদের সহায়তায় আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ, সুদ হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে অর্থঋণ আদালত আইন পাস করা হয়, ১৯৯১ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন আর ১৯৯৭ সালে পাস হয় দেউলিয়া আইন। প্রভাবশালীদের প্রভাব বলয়ের কারণে এসব আইনের ক্ষমতা যথাযথ প্রয়োগের সুযোগ না থাকায় খেলাপি ঋণ কমেনি বরং বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে।
বিবিসি বাংলা এবং জাতীয় একটি অর্থনৈতিক ইংরেজি দৈনিকের বাংলা সংস্করণে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলো কঠোরতার অংশ হিসেবে জামিনদার বা গ্যারান্টারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার সাতটি অর্থঋণ আদালতে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ৩১ হাজার ৩০৯ মামলার বিচার চলমান। এসব মামলার সঙ্গে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ জড়িত। এর মধ্যে জামিনদারকেও বিবাদী করা হয়েছে ১০ হাজার ২১১ মামলায়, এই মামলাগুলোর সাথে জড়িত প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। আলোচ্য সময় পর্যন্ত ১ হাজার ১২৯টি মামলার রায় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪০৮টি মামলায় ঋণের গ্যারান্টাররাও বিবাদী ছিলেন। অর্থাৎ আইন অনুসারে গ্যারান্টারদেরও ঋণ পরিশোধের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন মহামান্য আদালত।
ওই প্রতিবেদনে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইমরান আহমেদ ভূঁইয়াকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, “একটি ঋণের বিপরীতে ব্যাংক স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক নেওয়ার পর আর পৃথকভাবে গ্যারান্টার নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তাই এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করা এখন সময়ের দাবি। সোজা কথায় আইন অনুযায়ী যে গ্রহীতা ঋণ নেওয়ার আগে উপযুক্ত বন্ধক দিতে না পারবে, তাকে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ দেবে না। আরেকজনকে গ্যারান্টার বানিয়ে অহেতুক হয়রানির মধ্যে ফেলা একবারেই মানবাধিকার লঙ্ঘন।”
বিদ্যমান দুর্বল আইনি কাঠামোর মধ্যেও ২০০৩ সালের অর্থঋণ আদালত আইনের ৬ এর ৫ ধারায় ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার দায়ভার জামিনদাতার ওপর আসবে বলে উল্লেখ করা আছে। এতে বলা হয়েছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান মূল ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সময় তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা বা তৃতীয় পক্ষ জামিনদারকে বিবাদী করা হবে এবং আদালতের রায়, আদেশ বা ডিক্রি সবার বিরুদ্ধে যৌথ ও পৃথকভাবে কার্যকর হবে। মামলাও সবার বিরুদ্ধে একই সাথে পরিচালিত হবে।
ব্যাংকের অর্থের মূল মালিক সাধারণ আমানতকারীরা। অর্থাৎ ব্যাংকের ঋণের টাকা হচ্ছে ‘পাবলিক মানি’। পাবলিক মানি আদায়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা কোনোভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে পারে না। বরং জনস্বার্থে ঋণ আদায়ে আইনের বিদ্যমান দুর্বলতা দূর করে কঠোরতা আনয়ন করতে হবে। অনেকেই ঋণের টাকা আত্মসাৎ করে স্ত্রী, সন্তান এবং আত্মীয়-স্বজনদের বিলাসী জীবন-যাপন করার সুযোগ দিয়েছেন। গাড়ি, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রিসোর্ট, হোটেল ও শপিং সেন্টারের মালিক বানিয়েছেন। স্ত্রী, সন্তান, ভাইবোন, শ্যালক-শ্যালিকাদের লেখাপড়ার নামে বিদেশে পাঠিয়ে সেখানে অর্থপাচার করেছেন ঋণ খেলাপিরা। বিদেশের মাটিতে আরেক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন ঋণ খেলাপিরা। একসময় ঋণ খেলাপি নিজেও দেশ ছাড়া হয়েছেন। এমন কয়েকজন গ্রাহকের কাছে কয়েক লাখ কোটি টাকা আটকে গেছে দেশের ব্যাংকগুলোর। ঋণের টাকায় বান্ধবীদের দামি গাড়ি, প্লট ও ফ্ল্যাট উপহার দেওয়ার উদাহরণও ভুরি ভুরি।
খেলাপি ঋণ কমাতে সফল দেশগুলোর পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এসেছে। তাদের অনুসৃত নীতির আলোকে নীতি প্রণয়ন ও ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে। ঋণের কিস্তি খেলাপি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীনের মতো ঋণ খেলাপিদের ব্যক্তিগত সব সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ঋণ খেলাপিদের জাতীয় পরিচয়, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও পাসপোর্ট স্থগিত করার বিধান জারি করা জরুরি। মোবাইল, টেলিফোন, ইন্টারনেট, র্যাপিড পাস বন্ধ করতে হবে। ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, অনলাইন ও মোবাইল ব্যাংকিং স্থগিত থাকবে। জামিনদারদের বিরুদ্ধে এই কঠোরতা আরোপ করা প্রয়োজন। বিদ্যমান আইনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো সুবিধাভোগীদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান নেই। ঋণ খেলাপিরা সুযোগ বুঝে ঋণের অর্থ দিয়ে স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের নামে সম্পদের পাহাড় তৈরি করেন। ঋণ খেলাপিদের সম্ভাব্য সুবিধাভোগী নির্ণয়ে আইনি কাঠামো তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। আইনগত সংস্কার করে প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের উচ্চ গতি থেমে যাবে। চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো বাংলাদেশের খেলাপি ঋণও কমতির ধারায় থাকবে। আর দেশের সাধারণ আমানতকারীরাও নিজেদের জমানো অর্থ ফেরত পেতে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বেন না। কঠোর আইনি ব্যবস্থার প্রবর্তন দ্রুতই কাম্য এবং তা অতি দ্রুত হবে বলেই আমরা আশাবাদী।
মো. হারুন-অর-রশিদ : বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিকেশন বিভাগ, এনআরবিসি ব্যাংক পিএলসি
harunjubd@gmail.com