বাংলাদেশে গত বছর থেকে ‘টিকটক’ আলোচনায়। টিকটক কি? সে সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনেও দেশের আমজনতা একটি ধারণা তৈরি করতে পেরেছে। সেটি হচ্ছে একদল অল্পবয়স্ক উদ্ভট দর্শন বালক-বালিকা স্মার্টফোনের ক্যামেরায় ততোধিক উদ্ভট মিউজিক ও ভিডিও নির্মাণ করে। তারপর ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেয়। এই উদ্ভট কর্মকাণ্ডের অসংখ্য ভোক্তা আছে।

ইউটিউবে একেকটি টিকটক ভিডিও দেখেছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাদের আচরণে ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ধরন-ধারণ দেখে আমরা চোখ কপালে তুলেছি। কিন্তু ‘ভোক্তাবাদ’, ‘ভোগবাদ’, বাজারের স্বভাব, ‘চাহিদা-জোগান’ নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি। কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমগুলোও তাদের কাণ্ডকীর্তিকে মোটাদাগে দুই ভাগ করে দেখিয়েছে। একভাগ ‘জাজমেন্টাল’ বা রায়মূলক। যেমন ঢালাও মন্তব্য—‘টিকটক আমাদের যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে’। ‘তারা খুবই খারাপ’ বুঝানোই উদ্দেশ্য। অন্যভাগ ভাব-ভাবনায় ‘দমনমূলক’।

সামাজিকমাধ্যমে ও বিভিন্ন সংবাদের নিচে ঢালাও মন্তব্য আছে—‘টিকটক, লাইকি, পাবজি ইত্যাদি যেকোনো মূল্যে বন্ধ করে দিতে হবে’। যেন এই কাজটি এতটাই সহজ যে চাইলেই বন্ধ করে দেওয়া যায়।

‘পণ্য’কে না চিনলে এই আলোচনা বিফলে যাবে। কার্ল মার্ক্স পুঁজিবাদকে বলেছিলেন, ‘কমোডিটি ফেটিশিজম (Commodity fetishism)’। ‘আমার এই পণ্যটি চাই-ই চাই, যে কোনোভাবেই হোক চাই, এর সর্বশেষ সুবিধাটিও চাই’—খুব সহজে বললে এভাবে ‘কমোডিটি ফেটিশিজম’ বা ‘বস্তুপুজাবাদ’ ধরা যেতে পারে।

টিকটক, লাইকি, পাবজি, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টাম্বলার, টুইটার যা কিছুই বলি না কেন, সবই আসলে পণ্য। ভোক্তা আছে বলেই এসব পণ্য আছে। ব্যাপক চাহিদা তাই জোগানও ব্যাপক।

টিকটক, লাইকি, পাবজি, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টাম্বলার, টুইটার যা কিছুই বলি না কেন, সবই আসলে পণ্য। ভোক্তা আছে বলেই এসব পণ্য আছে। ব্যাপক চাহিদা তাই জোগানও ব্যাপক। বয়স্ক ডায়াবেটিস রোগীর কাছে মিষ্টির চাহিদা নেই, সেজন্য ডায়াবেটিস হাসপাতালের ভেতর মিষ্টির দোকান নেই, জোগান নেই, এমনকি স্বজনরা দেখতে গেলেও মিষ্টি নেন না। ডাক্তার বলেছেন, ‘এটি আপনার জন্য বিষ’। সে জন্য ‘সকল মিষ্টির দোকান বন্ধ করে দিতে হবে’ দাবিটি আপনি জানাতে পারেন না। মিষ্টির আরও কোটি কোটি ভোক্তা তো আছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় থেকে ‘পণ্য’, ‘ভোগবাদ’, ‘চাহিদা-জোগান’ ইত্যাদিতে রাশ টানা যায় না। এটিই বাস্তবতা।

টিকটক, লাইকি, পাবজি অন্যান্য গেইমসহ সবকিছুকেই ভালো কাজেও লাগানো সম্ভব, খারাপ কাজেও। অপরাধীরা ফাঁকফোকর খোঁজে। আইনের মতো জটিল শৃঙ্খল ও শৃঙ্খলার জালকে পর্যন্ত ছিন্ন করার বুদ্ধি আবিষ্কার করে। খবর মিলেছে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় অসংখ্য এনজিও এক মিনিটের উদ্দীপনামূলক ভিডিওর মাধ্যমে শিশুদের পাঠে ও সৃজনশীল কাজে উৎসাহী করে তুলছে।

২০১৯ সালে টিকটক-এর যাত্রা শুরু। এই বছরের জানুয়ারির শুরুতেই ব্যবহারকারী ও ভোক্তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক বিলিয়নে। এখনো টিকটক বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়নি। কিন্তু অন্তর্জালের তথ্যমতে, এই জুনেই তা দেড় বিলিয়ন অতিক্রম করে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে একদল মনোবিজ্ঞানের ছাত্র ভাবছে যে, টিকটক ব্যবহার দ্বারা ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমার বা স্মৃতি বিলোপ রোগের চিকিৎসাই নয়, অটিজম আক্রান্ত ও পড়াশোনায় অমনোযোগী শিশু-কিশোরদের মনোযোগী করা যায় কি না সে রকম পরীক্ষণ চালানো দরকার। কারণ, টিকটক মাত্র ১৫ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট দৈর্ঘ্যের হওয়ায় দর্শক অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে ভিডিওটি দেখে। এর একটি মারাত্মক আকর্ষণী দিক এই যে, দর্শকের মধ্যে এক বৈঠকেই ভিডিওটি দেখে শেষ করার তাড়না তৈরি হয়। ব্যস্ততার কারণে প্রায় দর্শকই লম্বা দৈর্ঘ্যের ভিডিও পরে দেখবেন ভাবেন।

এই বক্তব্যের অর্থ এই নয় যে, আমি টিকটক-এর পক্ষ নিচ্ছি। টিকটক-সংশ্লিষ্টদের দেখা গেল তারা কিশোর গ্যাং-এর সঙ্গে জড়িত। টিকটক ব্যবহারকারী ভয়ংকর নারী পাচার-চক্রের হদিসও মিলল। এর অর্থ কি এই যে, টিকটক নামের অ্যাপটি বাজারের আসার আগে দেশে কখনো নারী পাচারকারীরা ছিল না, কিশোর গ্যাং ছিল না। নিশ্চয়ই উল্টোটিই সত্য যে, টিকটক বাজারে না এলেও অপরাধীচক্র, নারী ও শিশু পাচারকারী, নির্যাতনকারী এবং কিশোর গ্যাং অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহার করে অপকর্ম করে চলছিল।

অপরাধের কৌশল বিচিত্র ও পরিবর্তনশীল হয়। অপরাধীরা নিত্যই কৌশল পাল্টায়। অপরাধীরা হোয়াটসঅ্যাপ, মাইক্রোসফট মিট, গুগল মিট, স্কাইপসহ অসংখ্য ভদ্রস্থ ও প্রাতিষ্ঠানিক সফটওয়ার ব্যবহার করেই যে অপরাধ করছেন না, তারই বা কী নিশ্চয়তা? অপরাধবিজ্ঞানে ‘হোয়াইট কলার ক্রাইম’ বা সাদা পোশাকের অপরাধ নামীয় একটি প্রপঞ্চ আছে। ফাঁস হয়ে যাওয়া পানামা পেপারস-এর মাধ্যমে আমরা জানলাম বিশ্বের সেরা ধনকুবেরগণ পানামা, হাইতি, ত্রিনিদাদ-টোবাগো, ফিজি ইত্যাদি দেশের ব্যাংক ও ঠিকানা ব্যবহার করে ভুয়া অফ-শোর কোম্পানি ফেঁদে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন, কর ফাঁকি দিয়েছেন, অস্ত্র ব্যবসা করেছেন, বিভিন্ন দেশে গোয়েন্দাগিরি করেছেন।

বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের আশঙ্কা বেশি। আমাদের কিশোর-তরুণরা ভুল পথে পা না বাড়াক আমরা সকলেই চাই। কিন্তু তারা কেন বেপথে যাচ্ছে, সেই সত্যের অন্বেষণ না করে বিশ্ববাজারে উচ্চ চাহিদার একটি পণ্যকে দায়ী করা নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়ারই নামান্তর।

কিশোর-তরুণ-তরুণীদের বিপথে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা, পরিবার, স্কুল, ধর্মশালা, অভিভাবকত্ব ইত্যাদির দায় কতোটা? কিশোর তরুণদের সামনে আমরা কি কোনো অনুকরণীয় ব্যক্তি, ঘটনা, ইতিহাস, সমাজ-সংস্কৃতির চর্চার উদাহরণ তৈরি করতে পেরেছি? ভবিষ্যৎ জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা নিয়ে তারা কি অবগত?

যে কিশোরের ঘুম ভাঙ্গে পিতামাতার বা অভিভাবকের এ রকম তিরস্কারে যে, তার নিজের রাস্তা সে নিজে তৈরি করতে না পারলে ভবিষ্যতে না খেয়ে মরতে হবে। তার জন্য রাষ্ট্র কি আইনের ভয় দেখানো ছাড়া কোনো ‘নিরাপত্তা-বলয়’-এর ঘোষণা দিয়েছে কখনো? সে কি দেখছে না শর্টকাট পদ্ধতিতে চোখের পলকে কীভাবে তার প্রতিবেশী তরতর উঠে যাচ্ছে উপরে? সে দেখছে প্রতিবেশীর উত্থানের কারণ সে রাজনীতি করে, অপরাধ কর্মে যুক্ত, সমাজে সকলকে চোখ রাঙানোর ক্ষমতা রাখে, সকলে তাকে ভয় পায়, সমীহ করে। কিশোরের চোখে সেই লোকটিই মডেল। দ্রুত তার মতো হওয়ার চেষ্টায় সে আইন ভাঙবে। টিকটক না পেলে অন্য মাধ্যম ব্যবহার করেই নতুন কৌশলের প্রয়োগ ঘটাবে।

গণযোগাযোগ মাধ্যম গণমানস তৈরি করে। নোম চমস্কি যেটিকে বলছেন, ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কন্সেন্ট’। গণযোগাযোগ মাধ্যমে ‘খবরের ধারাভাষ্য’ আছে, কিন্তু বিশ্লেষণী আলোচনা কোথায়? টক শো’তেও তাড়াহুড়ো এবং অগভীর তাৎক্ষণিক প্রশ্নের অ-দরকারি উত্তরই মেলে বেশি।

মার্কসের আদলে অনেক সমাজচিন্তকরা এখন ‘সেলেব্রিটি ফেটিশিজম’এর বিপদের কথা বলছেন। এই ফেটিশিজম-এর প্রমাণ টিকটক ভিডিওর হোতাদের সুবিশাল সংখ্যার ফ্যান-ফলোয়ার থাকা। সংখ্যাগুলো লাখের উপরে। তারা রাস্তা দখল করে, যান চলাচল ব্যাহত করে ভিডিও করে। কেউ ভয়ে বাধা দিতে যায় না। প্রশ্ন—কীসের ভয়?

টিকটক-সংশ্লিষ্টদের নিজেকে আলাদা দেখানোর সঙ্গে যুক্ত হয় সেলেব্রিটি হওয়ার লোভ। তাই তারা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ, বেশভূষা ও বলন-চলনভঙ্গিকেই বাহন বানিয়ে নেয়।

জনগণ আগে তো ভয় পেত না, তারা কেন মনে করে রাষ্ট্রও তাদের নিরাপত্তা দেবে না? পুলিশও কি ভয় পায়? না পেলে তারা তখন কোথায় থাকে? ভয় পেলে কেন ভয় পায়? তাদের পেছনে কি ভয় পাওয়ার মতো ক্ষমতাধর গড ফিগাররাও যে আছে, সেটি জানে বলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের এড়িয়ে চলে?

যুবক-তরুণদের ফ্যান্টাসি জগতের নায়ক-নায়িকা হওয়ার লোভ থাকে। বর্তমান সময়ে সামাজিক মাধ্যম অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃত পরিচিতি আড়ালে রেখে ‘সেলেব্রিটি ইমেজ’ও তৈরি করা যায়। বিজ্ঞানসম্মত মনোদৈহিক কারণেই কিশোর বয়সীদের স্বভাবে যুক্ত হয় নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা দেখানোর মনোভাব। এটি পরিপূর্ণ ‘ব্যক্তি’ বা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার উদগ্র কামনারই লক্ষণ।

টিকটক-সংশ্লিষ্টদের নিজেকে আলাদা দেখানোর সঙ্গে যুক্ত হয় সেলেব্রিটি হওয়ার লোভ। তাই তারা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ, বেশভূষা ও বলন-চলনভঙ্গিকেই বাহন বানিয়ে নেয়। শ্রেণির আলোচনাটিও আসুক। দেখা গেছে অপরাধ-সংশ্লিষ্ট টিকটকার কিশোর-কিশোরীদের বড় অংশই সমস্যাসংকুল পরিবারের এবং অসচ্ছলতার অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে ওঠা সমাজ-সংসারের সদস্য। উত্তর খুঁজতে হলে এ সবের মাঝেই খুঁজতে হবে, টিকটক-লাইকিতে নয়।

টিকটক-সংশ্লিষ্ট একদল কিশোর-তরুণকে আমরা অন্যরূপে চিনতে শুরু করে লাভ নেই। অনেকে তাদের ‘টিকটক জেনারেশন’ নামকরণও করে বসেছেন। এরকম ঢালাও নেতিবাচকতার কারণে সৃজনশীল ও শিক্ষামূলক ভিডিও তৈরিরত কিশোরটিও বাবা-মা, সমাজ-সংসার, বিদ্যায়তন, বন্ধু মহল হতে বাধা পাবে অথবা নিজেই নিরুৎসাহিত হবে।

বাংলাদেশের সমাজে কিশোর-তরুণ-তরুণীদের কাছে সমাজবাসীদের অনেক সামাজিক প্রত্যাশা। কিন্তু তাদের প্রত্যাশার বাস্তবায়ন কোথায়? টিকটক বন্ধ করা নয়, দরকার শান্তিপূর্ণ গৃহ-পরিবেশ, মানসিক চাপমুক্ত বর্তমানের নিশ্চয়তা, ভবিষ্যতের জীবন-জীবিকায় আশ্বস্তকারী পরিকল্পনা, উন্নতমানের মানবিক শিক্ষা, অলি-গলি-পাড়ায় লাইব্রেরি, ঘরে-বাইরে সুস্থ বিনোদন, ক্রীড়াকর্মের সুযোগ, খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার ইত্যাদিসহ সৃজনশীলতা বিকাশের প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা। মনে রাখা দরকার, দোষ মূলত আমাদের; টিকটক, লাইকি, পাব-জি’র নয়।

ড. হেলাল মহিউদ্দীন ।। অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়