গর্ব আর আশার মাতৃভাষা
ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা খুব আবেগমথিত কণ্ঠে বলি ‘ওরা আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছিলো’। কিন্তু সত্যিই কি তাই? ঘরে বাইরে, মা, বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন বন্ধুর সঙ্গে, বাজারে মাছওয়ালার সঙ্গে বা নৌকার মাঝির সঙ্গে মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলতে তো নিষেধ করেনি কেউ, তারা শুধু রাষ্ট্রভাষা ‘উর্দু’ করতে চেয়েছিল। তাহলে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার কথাটা কীভাবে এলো? কথাটা কি তাহলে মিথ্যা? উত্তর হচ্ছে-না। ভাষার কার্যক্ষমতা বা কার্যকারিতা কমে যাওয়াই মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ার বা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬ হাজার ৭০০টি ভাষায় মানুষ কথা বলে। প্রতি বছর পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে প্রায় ২৫টি ভাষা। ইউনেস্কো ২০১০ সালে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল যে, পৃথিবীতে আড়াই হাজারেরও বেশি ভাষা বিপন্ন, সেই আড়াই হাজার ভাষার তালিকাও তারা প্রকাশ করেছিলো। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০০ বছরে বিশ্বের প্রায় নব্বই শতাংশ ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
বিজ্ঞাপন
ভাষা কীভাবে বিলুপ্ত বা বিপন্ন হয়?
ভাষা বা মাতৃভাষা বিপন্ন হয় এর চর্চা কমে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলে। যখন কোনো একটি ভাষাগোষ্ঠীর তরুণেরা নিজের মাতৃভাষায় স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেয়, যদি কোনো ভাষাগোষ্ঠীর উঠতি প্রজন্ম নিজের ভাষায় কথা বলাকে ‘আনস্মার্ট’ বা অপ্রয়োজনীয় মনে করে-তখন সে ভাষা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশেরই একটি ভাষা রেংমিটচ্যর কথা এখানে বলা যায়। মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকে ১৭শ শতকে খুমি সম্প্রদায়ের রেংমিটচ্যভাষী জনগোষ্ঠীর একটি গ্রুপ বাংলাদেশে আসে। তারা বান্দরবান পার্বত্য অঞ্চলে মাতামুহুরী নদীর উজানে আলী কদমের দুর্গম স্থানে বসতি স্থাপন করে। গত শতকের মাঝামাঝি সময়েও আলীকদম উপজেলা সদর থেকে ১৭-১৮ কিলোমিটার দূরে ক্রাংসিপাড়া ও তৈনখাল উপত্যকায় চার পাঁচটি পাড়ায় শতাধিক রেংমিটচ্যভাষী পরিবারের অস্তিত্ব ছিল।
শত শত বছর ধরেই তারা ধীরে ধীরে ম্রো, খিয়াং প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যেতে থাকেন। ম্রোদের সঙ্গে তাদের সামাজিক ও আর্থিক লেনদেন বাড়তে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ম্রোদের সঙ্গে জুমচাষ এবং বিবাহ বন্ধনের মধ্যে ধীরে ধীরে রেংমিটচ্য ভাষাগোষ্ঠী অভ্যস্ত হতে থাকে ম্রো ভাষায়। ধীরে ধীরে তাদের দৈনন্দিন যাবতীয় চর্চায় নিজেদের মাতৃভাষা রেংমিটচ্যর পরিবর্তে ম্রো ভাষা প্রধান হয়ে উঠতে থাকে।
ষাটের দশকে গবেষক ক্লাউস-ডিয়েটার ব্রাউনস ও লোরেন্স জি লোফলার বাংলাদেশে এসেছিলেন ম্রো জনগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা করতে। সেই গবেষণা নিয়ে পরবর্তীতে তারা একটি বই লেখেন ‘ম্রো: হিল পিপল অন দ্য বর্ডার অব বাংলাদেশ’ নামে। বইটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৯০ সালে। এ বইতে খুব ছোট্ট করে মাত্র দুই বাক্যে লেখা ছিল যে বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদম উপজেলার কয়েকটি পাড়ায় রেংমিটচ্যভাষী জনগোষ্ঠীর কিছু অবশিষ্ট আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাতাত্ত্বিক ও ডর্টমুন্ড কলেজের অধ্যাপক ডেভিড এ. পিটারসন ১৯৯৯ সাল থেকে কুকি-চীন জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের নৃগোষ্ঠীগুলোর ভাষা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি লোফলার ও ব্রাউন্সের বইটি খুঁজে পান এবং সেখানে রেংমিটচ্য ভাষার উল্লেখ পান। রেংমিটচ্য ভাষিক গোষ্ঠীর খোঁজে আলীকদমে অনেক খুঁজেও তখন পিটারসন এই ভাষিক জনগোষ্ঠীর কাউকে পান না। আরাকানেও খুঁজে পাওয়া যায় না রেংমিটচ্যভাষী কাউকে। তখন ধরেই নেওয়া হয়েছিলো যে ভাষাটি বোধহয় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বিশ্বে হাজার হাজার মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেগুলো রক্ষার উদ্যোগ তেমন একটা দেখা যায় না। এক্ষেত্রে বাংলা এবং বাংলাদেশ এক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বায়ান্নতে যে আন্দোলন আর আত্মাহুতির ঘটনা ঘটেছে, তা নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের ইতিহাসে বিশেষ করে ভাষার ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
পার্বত্য চট্টগ্রামেরই তরুণ ইয়াং ইয়াং ম্রো, ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহ ছিল ম্রো জনগোষ্ঠীর ভাষা ও লোকায়ত উপাখ্যানগুলোর প্রতি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রাচ্য ভাষা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করে ম্রো ভাষা, উপকথা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছিলেন। রেংমিটচ্যভাষী কাউকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে পিটারসন অবশেষে ইয়াং ইয়াং ম্রোর শরণাপন্ন হন, তাকে গবেষণা সহকারী হিসেবে নিয়োগ করেন।
ইয়াং ইয়াং ম্রো আলীকদমের দুর্গম পাড়াগুলো ঘুরে ঘুরে মোট বাইশজন রেংমিটচ্যভাষীকে খুঁজে বের করেন তখন। সে ভাষার অনেক শব্দ আর বাক্য অডিওতে রেকর্ড করেন তারা। পরের কয়েক বছরের মধ্যেই ইয়াং ইয়াং ম্রো আরও প্রায় দশজন রেংমিটচ্যভাষীর সন্ধান পান।
কিন্তু মজার কথা হলো, প্রায় গোটা ত্রিশেক রেংমিটচ্যভাষীর সন্ধান পাওয়া গেলেও এই ভাষা ছিল তাদের বাল্যস্মৃতির ভাষা, শৈশবের হারিয়ে যাওয়া ভাষা।
এগুলোতে এখন তারা আর কথা বলেন না। তাদের প্রত্যেকের দৈনন্দিন জীবন এখন ম্রো ভাষায় যাপিত হয়। এই মানুষগুলো নিজেরাও কোনো এক অঞ্চলে একত্রে থাকেন না, বিভিন্ন ম্রো পাড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। ফলে নিজেদের মধ্যেও মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ তাদের নেই তেমন। চর্চার অভাবে ভুলেই যেতে থাকেন।
কোভিড মহামারির কারণে পিটারসন বেশ কয়েক বছর আর বাংলাদেশে আসতে পারেননি, ইয়াং ইয়াং ম্রোও মাঝখানে কয়েক বছর আর খোঁজ রাখতে পারেননি। কোভিড পরবর্তী সময়ে তিনি আবার খুঁজতে গিয়ে দেখেন জনা ত্রিশেক রেংমিটচ্যভাষীর বেশিরভাগই মৃত্যুবরণ করেছে। বাকি আছে মাত্র ছয়জন। তারাও বৃদ্ধ হয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় আছেন। অর্থাৎ এই ছয় বৃদ্ধের মৃত্যুর পর পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে একটি প্রাচীন মাতৃভাষা ‘রেংমিটচ্য’! এভাবেই সারা পৃথিবীতে চর্চার অভাবে হারিয়ে যেতে থাকে মাতৃভাষাগুলো।
একটি রাষ্ট্রের সব কার্যক্রম চলে সেই রাষ্ট্রের অফিশিয়াল দাপ্তরিক ভাষায়। তখন সে রাষ্ট্রের মূল পড়ালেখা চলে সেই রাষ্ট্রভাষায়, অফিশিয়াল কার্যক্রম চলে সেই রাষ্ট্রভাষায়, চাকরির বিজ্ঞপ্তি বা সাক্ষাৎকারও তাই হয় সেই রাষ্ট্রভাষায়। দাপ্তরিক সব কার্যক্রম ও নথি চালাচালিও চলে সেই রাষ্ট্রভাষায়। তাই সেই জনপদের অভিভাবকেরা নিজের মাতৃভাষা বাদ দিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বড় করেন সেই অফিশিয়াল দাপ্তরিক অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষার শিক্ষায়, না হয় সে বড় হয়ে কাজ বা চাকরি করতে পারবে না, তার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন
সেই তরুণেরা তখন রাষ্ট্রীয় ভাষা বা প্রভাবশালী ভাষায় পড়ে, জানে, আড্ডা দেয়, প্রেম করে, স্বপ্ন দেখে… নিজের মাতৃভাষায় কথা বলাটা ধীরে ধীরে তার কাছে ‘ক্ষ্যাত’ মনে হতে থাকে, মাতৃভাষায় কথা বলাটা তার কাছে ‘আনস্মার্ট’ মনে হয়। সে আরও বেশি করে নিজের ‘অচল’ মাতৃভাষাটি ভুলে গিয়ে ‘সচল’ রাষ্ট্রভাষায় আরও বেশি দক্ষ হওয়ার চিন্তায় বিভোর হয়। এভাবে ধীরে ধীরে একটি ভাষা হারিয়ে যেতে থাকে, বিপন্ন হয়ে যেতে থাকে, বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকে।
দেশভাগ পরবর্তী সময়ে বাংলার বদলে যদি উর্দু হতো তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, তাহলে সেই সময় আমাদের অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ সবখানে প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতো রাষ্ট্রভাষা উর্দু। যেহেতু উর্দুভাষীরা ক্ষমতার কেন্দ্রে, ফলে ভবিষ্যৎ জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের অভিভাবকেরা নিজেদের সন্তানকে উর্দুশিক্ষায় বড় করতো।
সেই প্রজন্ম ধীরে ধীরে বড় হতে হতে তাদের দৈনন্দিন জীবনে উর্দুচর্চায় মনোনিবেশ করতো। তাদের আড্ডা, কথা আর গল্পে, প্রেমে আর প্রার্থনায় উর্দুই হয়ে উঠতো প্রধান ভাষা। এভাবে হয়তো একসময় বাংলা ভাষার ব্যবহার কমে যেতে যেতে একসময় দুর্লভ, বিপন্ন বা বিলুপ্তির পথে ধাবিত হতো। যেভাবে প্রতি বছর বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে গোটা পঁচিশেক মাতৃভাষা।
বিশ্বে হাজার হাজার মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেগুলো রক্ষার উদ্যোগ তেমন একটা দেখা যায় না। এক্ষেত্রে বাংলা এবং বাংলাদেশ এক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বায়ান্নতে যে আন্দোলন আর আত্মাহুতির ঘটনা ঘটেছে, তা নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের ইতিহাসে বিশেষ করে ভাষার ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
তার বছর দশেক পরে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী আসামের বরাক উপত্যকাতেও বাংলা ভাষার জন্যই আন্দোলন আর আত্মাহুতির ঘটনা ঘটেছে। অতএব বিশ্বের ভাষিক ইতিহাসে মাতৃভাষা বাংলা এক ঐতিহাসিক অবদান রেখেছে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। আর কোনো ভাষার ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ নেই।
কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরের দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়ে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে আবেদন জানান। সে প্রেক্ষিতে ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে এক সংগঠন গড়ে তোলা হয় যেখানে ইংরেজ, জার্মানসহ বেশকিছু ভাষার লোকজন যোগ দেন। সেই ক্লাব থেকে আবারও আবেদন করা হয় এবং এর পক্ষে জনমত গড়ে তোলা হয়।
এদেশের বড় জনগোষ্ঠী এখন মনে করে তাদের সন্তানেরা আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করবে বড় হয়ে। তাই দেশের অভ্যন্তরে গড়ে উঠছে অসংখ্য ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল। রাস্তায়, রেস্টুরেন্টে দেখা যায় নব প্রজন্মের তরুণ, যুবা কিশোরেরা কথা বলছে, আড্ডা দিচ্ছে, দুষ্টুমি করছে, প্রেম করছে ইংরেজিতে। তারা এখন স্বপ্নও দেখছে ইংরেজিতে।
শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ সেই প্রস্তাবে সমর্থন জানায় এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাবিশ্বে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো। সেই থেকে আজ অব্ধি দিবসটি সারাবিশ্বে পালিত হয়ে আসছে।
কিন্তু সারাবিশ্বে একদিন এই দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হলেই কি পৃথিবীর মাতৃভাষাগুলো রক্ষা পাবে? এখনো তো সারাবিশ্বে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য মাতৃভাষা। শুধু রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতিও এখন আর যথেষ্ট নয়। আবারও বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক।
এদেশের বড় জনগোষ্ঠী এখন মনে করে তাদের সন্তানেরা আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করবে বড় হয়ে। তাই দেশের অভ্যন্তরে গড়ে উঠছে অসংখ্য ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল। রাস্তায়, রেস্টুরেন্টে দেখা যায় নব প্রজন্মের তরুণ, যুবা কিশোরেরা কথা বলছে, আড্ডা দিচ্ছে, দুষ্টুমি করছে, প্রেম করছে ইংরেজিতে। তারা এখন স্বপ্নও দেখছে ইংরেজিতে।
আর শহরের ঘরে ঘরে এখন বাবা মায়েরাও কথা বলছেন ইংরেজিতে, যাতে সন্তানেরা ইংরেজি ভাষায় পোক্ত হয়। ট্রাফিক জ্যামে বিক্রি হচ্ছে ইংরেজি বই, বাংলা বইয়ের কদর নেই। যে দেশের মানুষ নিজের মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম করে জীবন দিলো, সেই দেশের মানুষের একটা বড় অংশ এখন বাংলায় কথা বলাকে যথেষ্ট আধুনিক মনে করে না।
এদেশের মানুষেরই আরেকটা অংশ বাংলার বদলে গড়ে উঠছেন আরবি ভাষায়। সারাদেশে গড়ে উঠেছে স্কুলের চেয়ে বেশি মাদ্রাসা। আরবি হয়ে উঠছে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভাষা। সম্পূর্ণ আরবিতে কথা না বললেও বাংলা বাক্যের মধ্যে প্রবেশ করছে প্রচুর আরবি শব্দ।
এখানেও একটি দারুণ দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য। ইয়াং ইয়াং ম্রো যখন দেখলেন আর কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে রেংমিটচ্য ভাষা। তিনি তখন নিজে সেই ভাষা আয়ত্ত করে নিলেন, সেই ভাষায় বই লিখলেন, ব্যাকরণ তৈরি করলেন আর সেগুলো প্রকাশ করে ম্রো পাড়ায় চালু করলেন রেংমিটচ্য ভাষার স্কুল। যেখানে ম্রো সম্প্রদায়ের শিশুরাও রেংমিটচ্য ভাষা পড়তে শিখলো। এখন প্রতিনিয়তই বাড়ছে রেংমিটচ্যভাষী শিশুর সংখ্যা। যে ভাষা হারিয়ে গিয়েছিলো প্রায়, মাত্র ছয়জন বৃদ্ধ মানুষের মৃত্যুতে যে মাতৃভাষা হারিয়ে যেতে বসেছিল পৃথিবী থেকে, সে ভাষা এখন অন্তত অর্ধশত শিশু কিশোরের মুখে প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। তারা তাদের দৈনন্দিনতায় বাঁচিয়ে রাখছে ভাষাটিকে। এমনকি তাদের মাতৃভাষা রেংমিটচ্য না হওয়া সত্ত্বেও!
এখনো যে মাতৃভাষাগুলো বেঁচে আছে পৃথিবীতে, একটু উদ্যোগ নিলে সে মাতৃভাষাগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব, কার্যকর করে তোলা সম্ভব। এত ত্যাগ তিতিক্ষায় অর্জিত যে রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’ তাকে সঠিকভাবে রক্ষা করতে চাইলেও নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ। কিন্তু সে উদ্যোগ নেওয়ার মানুষের অভাব প্রকট হয়ে উঠছে পৃথিবীতে।
নজরুল সৈয়দ : সংস্কৃতিকর্মী