আন্তর্জাতিক কারারুদ্ধ লেখক দিবস : আমাদের স্মরণ ও শিক্ষা
১৫ নভেম্বর ‘আন্তর্জাতিক কারারুদ্ধ লেখক দিবস’ (Day of the Imprisoned Writers: International Observance)। ১৯২১ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত লেখক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘পেন ইন্টারন্যাশনাল’ ১৯৮১ সাল থেকে এই দিবসটি উদযাপন করে আসছে।
প্রথমে লন্ডন থেকে শুরু হলেও পেনের শাখা বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উদযাপন করা দেশের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের শতাধিক দেশে পেনের অফিস থেকে দিবসটি উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশ পেনও বেশ কয়েক বছর ধরে উদযাপন করছে।
বিজ্ঞাপন
শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক লেখকদের মুক্তমত-চর্চা অবদমনের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। কালে কালে মুক্তমত প্রকাশ করার জন্য, সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কলম ধরার জন্য লেখকরা নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। হয়ে যাচ্ছেন।
সক্রেটিসকে বিষ-পানে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। নিষিদ্ধ হয়েছে হোমারের ওডিসি। বাইবেলের প্রথম অনুবাদক উইলিয়াম টিনডেলকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় সপ্তম হেনরির আমলে। টিনডেলের অপরাধ, তিনি পবিত্র গ্রন্থ ঈশ্বরের ভাষা থেকে গণমানুষের ভাষায় অনুবাদ করেছেন!
বিজ্ঞাপন
তৎকালীন চার্চ শাসিত সমাজে চার্চের পণ্ডিতরা মনে করেছেন সাধারণ মানুষ বাইবেল পড়া শুরু করলে তাদের কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব কমে যাবে। শাসক শ্রেণির ভয়টা মূলত এখানেই। তারা কখনোই চায় না দেশের বৃহত্তর জনগণ প্রশ্ন করতে শিখুক। তাই লেখকরা যখনই সাধারণ মানুষের মধ্যে চিন্তাশীল প্রবণতাকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন, তখনই কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতার কাঠামো কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছেন। লেখকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে রাষ্ট্র, প্রয়োজনে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করেছে সরকার।
তৃতীয় বিশ্বের লেখকদের অবস্থা আরও শোচনীয়। যে ঔপনিবেশিক শক্তি, জ্ঞানে-প্রজ্ঞায় নিজেকে ঈশ্বরতুল্য মনে করেছে, তারাই আবার স্বাধীন কণ্ঠস্বর কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে একাধিকবার গ্রেফতার করেছে। দুইবার জেল খেটেছেন কবি। তার সাতটির মতো বই নিষিদ্ধ করেছে ব্রিটিশ সরকার
এক্ষেত্রে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সর্বশেষ আইসিটি অ্যাক্টের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। এই অ্যাক্টের আওতায় বিগত এক দশকে বেশ কয়েকজন লেখককে গ্রেফতার করা হয়েছে, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘নানা-ধরনের’ অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে লেখক, শিল্পী থেকে শুরু করে অসংখ্য মানুষকে। স্মর্তব্য যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারকৃত লেখক মুশতাক আহমেদ কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। সর্বশেষ গ্রেফতার হওয়া লেখক সোহেল হাসান গালিবের কথাও আমরা স্মরণ করতে পারি। তার বর্তমান অবস্থা আমরা জানি না।
কেউ গ্রেপ্তার হন সরকারি সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বা সরকারি নেতাদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ করার জন্য, কেউ গ্রেফতার হন ধর্ম কিংবা গণ-সেন্টিমেন্টের বিপক্ষে যায় এমন কোনো কথা বলার জন্য। সরকার বদল হলেও সাধারণত এই ধরনের আইনগুলোর পরিবর্তন হয় না, বরঞ্চ নতুনভাবে শক্তি লাভ করে।
মুক্তমনা লেখকদের কোনো সরকারই—বিপ্লবী হোক কিংবা প্রতিবিপ্লবী, ডান হোক কিংবা বাম অথবা মধ্যপন্থা—স্বাধীনভাবে কথা বলতে দিতে চায় না। যে কারণে প্রথাবিরোধী লেখকদের কারাবরণ করতে হয়, এমনকি মৃত্যুদণ্ডের মতো চূড়ান্ত সাজাও ভোগ করতে হয়। এর বাইরেও তাদের নানাভাবে প্রতিহত করা হয়।
ইতিহাস থেকে আমরা দেখি, মলিয়েরের মতো বিখ্যাত নাট্যকারের মৃত্যুর পর শেষকৃত্য হয়নি। তাকে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া সমাহিত করা হয় রাতের অন্ধকারে, তাও ব্যাপটাইজ না করা শিশুদের কবরস্থানে। কারণ তিনি সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানীদের বিদ্রূপ করেছেন। তথাকথিত ধার্মিকদের ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন করার জন্য তার বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছে চার্চ। তার নাটক প্রদর্শনীর ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পার্লামেন্ট। নীতিবাগীশদের অভিযোগেও নিষিদ্ধ হয়েছে তার নাটক।
তৃতীয় বিশ্বের লেখকদের অবস্থা আরও শোচনীয়। যে ঔপনিবেশিক শক্তি, জ্ঞানে-প্রজ্ঞায় নিজেকে ঈশ্বরতুল্য মনে করেছে, তারাই আবার স্বাধীন কণ্ঠস্বর কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে একাধিকবার গ্রেফতার করেছে। দুইবার জেল খেটেছেন কবি। তার সাতটির মতো বই নিষিদ্ধ করেছে ব্রিটিশ সরকার।
দুশো বছর পর ব্রিটিশদের শোষণের হাত থেকে ভারত স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু স্বাধীনতা পাননি লেখকেরা। দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যারাই কলম ধরেছেন, তারাই কোনো-না-কোনোভাবে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছেন মুক্তবুদ্ধি-চর্চার লেখক-বুদ্ধিজীবীরা। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড তারই একটি চূড়ান্ত পরিণতি।
আফসোসের বিষয়, একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও লেখকদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে, তাদের প্রধান কাজ হয়েছে মুক্তমত ও বিরুদ্ধমতকে দমন করা। যেসব লেখক দলীয় চিন্তার বাইরে গিয়ে, সরকারি সিদ্ধান্তের বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করেছেন, ক্ষমতা কাঠামো ও প্রগতিবিরুদ্ধ ধ্যানধারণার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তাদেরই জেলে যেতে হয়েছে, অনেকে দেশান্তরি হয়েছেন, কাউকে কাউকে জীবন দিতে হয়েছে নির্মমভাবে।
আত্মপক্ষ সমর্থনে রাষ্ট্র বা শাসকগোষ্ঠী সবসময় স্বাধীনচেতা স্পষ্টভাষী লেখকদের ‘সীমা লঙ্ঘনকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শাসকগোষ্ঠী তাদের দমন পীড়নের পক্ষে গণমানুষের কাছ থেকে সম্মতি উৎপাদন করেছে। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন চলে আসে, ‘বাকস্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তচিন্তা’ কী? হেটস্পিচ কি ফ্রিডম অব স্পিচ বা ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন-এর ভেতর পড়ে? ‘বাকস্বাধীনতা’ থাকলেই কি ব্যক্তির সব ধরনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত? এমন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আমাদের।
আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে হেটস্পিচকে বাকস্বাধীনতা বলে মনে করি না। কেউ যদি এমন বক্তব্য দেন, যাতে দেশের (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে) সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন বিপন্নবোধ করেন বা তাদের নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা তৈরি হয়, তবে সেই বক্তব্য অনুমোদনযোগ্য হতে পারে না। কারও বিশ্বাসকে কেউ অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করতে পারে না। অর্থাৎ ব্যক্তির ‘মুক্তমত’ প্রকাশ কারও জন্য নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা তৈরি করলে সেটা দায়িত্বশীল আচরণ হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
তবে, গোটা সম্প্রদায় যদি মিথ্যা বা ভ্রান্ত বিষয়ের ওপর চলছে বলে মনে হয়, তাহলে কি একজন ব্যক্তি কোনো ‘সত্য’ আবিষ্কার বা উপলব্ধি করতে পারলে সেটি প্রকাশ করতে পারবেন না? আমরা জানি, কোপারনিকাস যখন পৃথিবীর গোটা বিশ্বাসের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, “…the universe that placed the Sun rather than the Earth at the center of the universe”। বৈজ্ঞানিক সত্য উচ্চারণের জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে জর্দানো ব্রুনোকে। “The universe is infinite and that the stars are just distant suns with their own planets”—এই কথা বলার জন্য প্রচলিত ধর্ম বিরোধিতার অভিযোগে তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
মৃত্যুর আগে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, “To burn is not to refute!” চার্চ কর্তৃক অভিযুক্ত হয়ে গ্যালিলিও ভোগান্তির মধ্য দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এদের মত প্রকাশ সাময়িকভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত না হলেও পরে সেটিই Scientific Revolution-এ বিশেষ অবদান রেখেছে।
‘আন্তর্জাতিক কারারুদ্ধ লেখক দিবস’কে সামনে রেখে এই কথাগুলো স্মরণ করার যথেষ্ট কারণ আছে। ইতিহাসে দেখা যাবে, প্রথাবিরুদ্ধ সত্যভাষী লেখকরাই—যাদের কারারুদ্ধ করা হয় বা করতে চায় শাসকগোষ্ঠী—তারাই পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। তাদের মাধ্যমে সূচিত হয়েছে সর্বমানবিক রাষ্ট্র ও সাম্যবাদী সমাজ কাঠামোর ধারণা। লেখকদের কাজ সেই ঐতিহ্য ও দায়কে মাথায় রেখে কলম ধরা। লেখকশিল্পীরা কোনো দলীয় কর্মী নন, তারা সর্বমানবিক, সর্বপ্রাণবিক মুক্তির কথা বলতে আসেন।
...লেখকদের কাজ সেই ঐতিহ্য ও দায়কে মাথায় রেখে কলম ধরা। লেখকশিল্পীরা কোনো দলীয় কর্মী নন, তারা সর্বমানবিক, সর্বপ্রাণবিক মুক্তির কথা বলতে আসেন।
আমাদের দেশের বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখকদের এই ভূমিকা আরও বেশি প্রত্যাশিত। তাই তরুণ লেখকদের বলতে চাই, রাষ্ট্রচেতনা আর জনচেতনা দিয়ে শিল্পচেতনা গড়ে ওঠে না। বরঞ্চ এ দুটোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলার জন্যই টিকে আছে শিল্পসাহিত্য। একারণেই বলি, পপুলিস্ট কথা বলা লেখকশিল্পীদের কাজ না। লেখকশিল্পী রাজনীতিবিদের মতো নির্বাচনে দাঁড়াবেন না যে তাকে সাধু থেকে চোর সবার ভোট দরকার হবে। তিনি পপুলার ধারণার বাইরে গিয়ে গ্রেটার ট্রুথের কথা বলবেন।
যে ন্যারেটিভকে গণমানুষ বিশ্বাস করে, বাস্তবতা বলে মেনে নেয়, সেই ন্যারেটিভ রাষ্ট্র তৈরি করে, সরকার তৈরি করে, মিডিয়া তৈরি করে, নীতিবাগীশরা তৈরি করেন, ধর্ম তৈরি করে, জাতীয়তাবাদ তৈরি করে। তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে লেখক একটা আখ্যান রচনা করেন যেটা আপাতভাবে বানোয়াট, মানে অবাস্তব; কিন্তু সেটার মধ্য দিয়ে সত্যটা নগ্নভাবে ফুটে ওঠে। লেখকের কাছে ধ্রুব সত্য বলে কিছু হয় না। লেখক হবেন আনবায়াসড ট্রুথ। এই কারণে সব যুগেই সত্যান্বেষী লেখক মাত্রই (রাষ্ট্রের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে) এনার্কিস্ট।
তবে যে রাষ্ট্র লেখকদের মুক্তমত চর্চা ও প্রথাবিরুদ্ধ-চেতনাকে স্বাগত জানায়, সেই রাষ্ট্র একটি মানবিক প্রগতিশীল সমাজ উপহার দেয়। যে সরকার সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার ভেতর দিয়ে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা ও বিরুদ্ধ চেতনাকে মোকাবিলা করে, সেই সরকার একটি বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে কাজ করে।
দিনটি সামনে রেখে আন্তর্জাতিক পেনসহ বিভিন্ন দেশের মুক্তমনা মানুষেরা বিশ্বে মুক্তমতচর্চার জন্য সাজাপ্রাপ্ত লেখকদের সাজামুক্তির জোর আহ্বান জানায়। লেখকরা যাতে নির্ভয়ে তাদের কথা বলতে পারেন সেইরকম পরিবেশ সুনিশ্চিতের জন্য সরকারের কাছে দাবি তোলা হয়। দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, বিমানবিক রাষ্ট্রকাঠামো, যুদ্ধবাজ পলিসির বিরুদ্ধে লেখকদের সংগ্রাম অব্যাহত আছে। সভ্যতার স্বার্থেই তাদের কলমের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে, সরকারকে নিতে হবে।
মোজাফ্ফর হোসেন : কথাসাহিত্যিক