শক্তিশালী সাংবাদিকতার ভিত্তি সুষ্ঠু ও গণমুখী সাংবাদিক সংগঠন
প্রায় ২৮ বছর বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছি। আমার সবসময়ই মনে হয় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই এদেশের সংবাদমাধ্যম এগিয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘মুক্ত সাংবাদিকতা’ এটা শুধুমাত্র শব্দশৈলী মনে হয়।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বেশকিছু স্লোগান দিয়ে পাঠকদের কাছে নিজেকে সত্য, নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করার নিরলস চেষ্টা করতে দেখছি। তেমনি কতগুলো শ্রুতিমধুর আশাব্যঞ্জক শব্দের সমাহার উল্লেখ করছি—‘আমরা জনগণের পক্ষে’, ‘আংশিক নয় পুরো সত্য’, ‘সত্যই সাহস’, ‘সত্যের সন্ধানে নির্ভীক’, ‘অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’, ‘মুক্ত প্রাণের প্রতিধ্বনি’ ইত্যাদি। এই কয়েকটি স্লোগান দিয়ে সব গণমাধ্যমের পজিটিভিটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। বাস্তব চিত্র কি আসলে তাই?
বিজ্ঞাপন
শুধুমাত্র লেখনীর কারণে কিংবা সংবাদ প্রকাশের কারণে কিংবা সরকারের পক্ষাবলম্বন না করার কারণে অনেক সংবাদ মাধ্যমকে ইতিহাসের পাতায় অবস্থান করতে হয়েছে। নানাবিধ অন্যায় অত্যাচারকে নিয়তির পরিণতি হিসেবে মেনে নিতে হয়েছে। সরকার বদলায়, নীতি বদলায় কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শব্দটা সব সরকারই নিজেদের মতো করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে।
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার, সংসদীয় সরকার, গণতান্ত্রিক সরকার, অগণতান্ত্রিক সরকার, স্বৈরতান্ত্রিক সরকার, সামরিক সরকার, এক নায়কতান্ত্রিক সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কত না সরকারের রূপরেখা দেখেছি এই জীবনে। দেখেছি সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে রাতারাতি রূপের পরিবর্তন, দেখেছি সংবাদ মাধ্যমেরও পরিবর্তন। সত্যিই সেলুকাস।
বিজ্ঞাপন
সংবাদ মাধ্যমের সার্বিক চরিত্র যাই থাকুক না কেন সাংবাদিক সংগঠনগুলোর চরিত্র অনেকটা বিপরীতমুখী। সাংবাদিকদের মধ্যে দেশের চলমান রাজনীতির বিভাজন সুস্পষ্ট। কিন্তু জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন (ক্র্যাব) কিংবা ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)-এর নির্বাচনগুলো যেন থাকে সবসময় উৎসবমুখর। যেমন দেখেছিলাম ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রায় ১৫ বছর যাবৎ জাতীয় প্রেস ক্লাব, ডিআরইউ এবং ক্র্যাব-এর নির্বাচনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। নির্বাচন মানেই মহোৎসব, মিলনমেলা। নেতৃত্ব বাছাই একান্ত নিজস্ব ব্যাপার কিন্তু সংগঠন সবার, সংগঠনে দলীয় আধিপত্য বিস্তারের কোনো সুযোগ নেই। যিনি দলীয় আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করেছেন তাকেই দেখেছি দলছুট হয়ে নিবৃত জীবনযাপন করতে কিংবা দেশান্তরিত হতে।
শক্তিশালী সাংবাদিকতার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। তারই উদাহরণ ডিআরইউ, জাতীয় প্রেসক্লাব, ক্র্যাব, ইআরএফসহ সাংবাদিকদের আরও অনেক সংগঠন। নির্বাচনের উৎসবমুখরতা কিংবা বাৎসরিক ফ্যামিলি ডে-তে দেখা যায় অপূর্ব পরিবেশ, যা থেকে জাতীয় রাজনীতিতে যারা যুক্ত, তারা পেতে পারেন পরিচ্ছন্ন সু-বাতাস। জাতীয় রাজনীতিতে অনেক সাংবাদিক যারা পদ-পদবির আশায় নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে ‘মোর দ্যান পলিটিশিয়ান’ সাজতে যেমন সময় নেন না তেমনি প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ফলে নিজেদের আবিষ্কার করেন দলছুট গোষ্ঠীর আস্তাকুঁড়ে।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পেশা বহু সীমাবদ্ধতা, চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি সত্ত্বেও আজও সমাজের বিবেক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এই পেশাদারদের পেশাগত ঐক্য, নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে পেশাজীবী সংগঠনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এর মধ্যে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন (ক্র্যাব) এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইএরএফ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতি বছর বা নির্ধারিত সময়ে এসব সংগঠনের নির্বাচন কেবল কমিটি নির্বাচন নয়—এটি সাংবাদিকতার ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা, পেশাদার পরিচিতি এবং স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত।
এই সংগঠনগুলোর নির্বাচন প্রক্রিয়া সাধারণত স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক এবং সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে অনুষ্ঠিত হয়। মনোনয়নপত্র দাখিল, যাচাই-বাছাই, প্রার্থীর পরিচিতি, ম্যানিফেস্টো উপস্থাপন—সবই চলে একটি নিয়ন্ত্রিত, নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে। সাংবাদিক সমাজ বিভক্ত হলেও নির্বাচনের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পেশাদার সৌহার্দ্য বজায় থাকে। এটি গণতান্ত্রিক স্পিরিটের বহিঃপ্রকাশ, যা দেশের পেশাজীবী সংগঠনগুলোর জন্য উদাহরণ হতে পারে।
নির্বাচন ঘিরে প্রায়ই দেখা যায় উৎসবমুখর পরিবেশ। প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট—সব মিলিয়ে পুরো এলাকা যেন এক ধরনের মিলনমেলায় পরিণত হয়। ব্যস্ত শহরেও সাংবাদিকরা নিজেদের পেশার মর্যাদা রক্ষায় একত্রিত হন। অনেকে বহু বছর পর পুরোনো সহকর্মীদের দেখেন, কথা বলেন, সম্পর্ক নবায়ন করেন।
শুধু ভোট নয়—এটি সাংবাদিক সমাজের এক ধরনের সামাজিক পুনর্মিলনী। প্রতিযোগিতা আছে, কিন্তু তা পেশাদারিত্বের সীমার ভেতর। এখানে উল্লেখযোগ্য যে প্রতিযোগিতা বেশ তীব্র হলেও তা সাধারণত শালীন ও পেশাদার। বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা নিজেদের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন—কর্মস্থলে নিরাপত্তা, কল্যাণ তহবিল, প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক সুযোগ, পেশাগত উন্নয়ন, সদস্যদের ন্যায্য অধিকারের মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। এই সুস্থ প্রতিযোগিতাই সংগঠনগুলো গতিশীল করে।
সব ইতিবাচক দিকের মাঝেও কিছু সমালোচনা অস্বীকার করা যায় না। কিছু সংগঠনে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও অঘোষিত সিন্ডিকেট প্রভাবের অভিযোগ রয়েছে। তরুণ সাংবাদিকরা কখনো কখনো মনে করেন, নেতৃত্বের জায়গা নতুনদের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত নয়। আবার কেউ কেউ বলেন, নির্বাচনের উৎসবমুখরতার চেয়ে বাস্তব সমস্যার সমাধানেই বেশি জোর দেওয়া উচিত। তবে এটিও সত্য—সমালোচনা থাকলেই সংগঠনগুলো পরিণত হয়, গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালী হয়।
ডিআরইউ, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ক্র্যাব ও ইআরএফ—এসব সংগঠনের নির্বাচন শুধু নতুন নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়া নয়; এটি সাংবাদিক সমাজের অন্তর্নিহিত গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতীক। এমন উৎসবমুখর, নিয়মতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রমাণ করে—সাংবাদিকরা শুধু খবর তৈরি করেন না; তারা নিজেরাও গণতন্ত্রকে ধারণ করেন, চর্চা করেন এবং সেই চর্চার মাধ্যমে সংগঠনগুলো আরও শক্তিশালী করে তোলেন।
একটি দেশে সাংবাদিকতা যত শক্তিশালী হয়, গণতন্ত্রও তত শক্তিশালী হয়। আর শক্তিশালী সাংবাদিকতা গড়ে ওঠে শক্তিশালী, সুষ্ঠু এবং গণমুখী সাংবাদিক সংগঠন থেকে—এটাই এসব নির্বাচনের আসল বার্তা।
মো. কামরুল ইসলাম : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, ঢাকা পোস্ট