সশস্ত্র বাহিনী দিবস : গৌরবের ধারায় অটুট অগ্রযাত্রা
২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস। এই দিন বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সশস্ত্র বাহিনী দিবস শুধুমাত্র একটি বার্ষিক আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি একটি জাতির আত্মমর্যাদা, শৃঙ্খলা ও স্বাধীনতার প্রতীক।
এই দিনে তিন বাহিনীর সমন্বিত মুক্তিযুদ্ধ–অভিযানের স্মৃতিচিহ্ন আমাদের সামনে নতুন করে উন্মোচিত হয়। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব যাদের কাঁধে ন্যস্ত, তাদের পেশাদারিত্ব, ঐক্য ও সেবাধর্মিতা স্মরণ করার জন্য দিনটি এক অনন্য সুযোগ।
বিজ্ঞাপন
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২১ নভেম্বরের তাৎপর্য অনিবার্য। এই দিনেই তিন বাহিনীর সম্মিলিত অভিযান শুরু হয়, যা চূড়ান্ত বিজয়ের পথকে বেগবান করে। স্বাধীনতার পর সশস্ত্র বাহিনী নিজেদের পুনর্গঠন, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নতুন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মহাযাত্রায় যাত্রা শুরু করে।
সময়ের পরিক্রমায় বাহিনী শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নয় বরং দেশের উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জাতির আস্থা অর্জন করেছে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী দীর্ঘ সময় ধরে পেশাদারিত্ব ও শৃঙ্খলার অনন্য উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে তাদের স্বচ্ছতা, কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান আজ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষে। বিভিন্ন মহাদেশে শান্তি রক্ষা, মানবিক সহায়তা প্রদান, সংঘাত–উত্তর পুনর্গঠন—এসব ক্ষেত্রে বাহিনীর অবদান আন্তর্জাতিক মহলে গভীর প্রশংসা অর্জন করেছে। দেশের শান্তিরক্ষীরা সাহস, সততা ও পেশাদারিত্বের যে নজির তৈরি করেছেন, তা আজ বাংলাদেশের জন্য একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পদ।
Armed Forces Division (AFD) অনুযায়ী, বর্তমানে ৬,৩৫৯ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী ৮টি চলমান মিশনে নিয়োজিত রয়েছেন। নতুন AFD জার্নাল (২০২৫) বলেছে, বর্তমানে ৬,৯২৪ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী ১২টি দেশে কাজ করছে। তবে অন্য উৎস বলেছে ২০২৫-এ ৬,০০০-এর মতো বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী কাজ করছে প্রায় ১০টি মিশনে।
AFD-এর তথ্য অনুযায়ী, মোট ১,৭১৮ জন নারী (peacekeepers) এখন পর্যন্ত UN মিশনে অংশ নিয়েছেন। বর্তমানে ৩৭৩ জন নারী সদস্য বিভিন্ন মিশনে নিয়োজিত রয়েছেন। UN-এর লক্ষ্য হলো ২০২৫-এ Staff Officer ও Military Observer হিসেবে ২২ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ এবং AFD বলেছে তারা প্রায় ১৮ শতাংশে পৌঁছাতে পারছে।
AFD অনুসারে, বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত ৬৩টি UN শান্তি মিশনে কাজ করেছে। ওই হিসেবে প্রায় ৪৩টি দেশ–এ বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নিয়োজিত ছিল বা আছে। সর্বমোট AFD বলেছে, ১৭৮,৭৪৩ জন সদস্য (সশস্ত্র বাহিনীর) Peacekeeping-এ কাজ করেছে।
AFD-এর ২০২৫ জার্নাল বলেছে, প্রায় ১৬৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী মিশনে আত্মত্যাগ করেছেন এবং ২৭২ জন আহত হয়েছেন। UN Bangladesh (জাতিসংঘ Bangladesh অফিস) তথ্য অনুসারে, বর্তমানে স্মরণযোগ্য হিসেবে বলা হয়েছে ১৬৮ জন শহীদ এবং ২৬৬ জন আহত। এই মুহূর্তে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থায়ন সংকট।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সবসময় জনকল্যাণ ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের পাশে দাঁড়িয়েছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, ভবন ধস, নদীভাঙন-যখনই সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত হয়েছে, তখন বাহিনী জীবন রক্ষায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে।
খবর অনুযায়ী UN-এর বাজেট ঘাটতির কারণে প্রায় ১,৪০০ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীকে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি দেশে ফিরতে হতে পারে। এই চাঁটাই অনেক মিশনে বাংলাদেশের অবদানের পরিমাণকে প্রভাবিত করতে পারে। আগস্ট ২০২৫-এ, থিম হিসেবে “Bangladesh committed to global peace” নিয়ে একটি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সেনাপ্রধান বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত শান্তিরক্ষীরা তাদের দায়িত্ব ‘উচ্চ নৈতিকতা, পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতার’ ভিত্তিতে পালন করছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ‘পেশাদার, মানবিক এবং নিরপেক্ষ’ হওয়া প্রায় একরূপভাবে প্রশংসিত হচ্ছে।
রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা আজ আর কেবল সীমান্ত প্রতিরক্ষা–পরিধিতে সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক বিশ্বের নিরাপত্তা পরিমণ্ডল বহুগামী ও জটিল। সাইবার নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, সমুদ্র সম্পদ রক্ষা, জলবায়ু-বিপর্যয় মোকাবিলা—এসব ক্ষেত্রেই এখন সশস্ত্র বাহিনীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থান, উপকূলীয় জলসীমা এবং বহুমাত্রিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের কারণে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত। এ বাস্তবতায় বাহিনীকে আরও আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও দক্ষ করে গড়ে তোলা সময়ের অপরিহার্য দাবি।
প্রতিরক্ষা বাহিনী আধুনিকায়নের ক্ষেত্রেও সরকার ধারাবাহিক উদ্যোগ গ্রহণ করছে। ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’-এর আওতায় সেনাবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ, নৌবাহিনীতে সাবমেরিন ও ফ্রিগেট অন্তর্ভুক্তি, বিমানবাহিনীর নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমান–সংযোজন—এসব সবই জাতির নিরাপত্তা সক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের সামুদ্রিক এলাকা ও ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা সুরক্ষায় নৌবাহিনী এখন আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে উঠে আসছে। একইভাবে বিমানবাহিনী তার আকাশসীমা রক্ষায় আরও আধুনিক রাডার, সতর্কীকরণ ব্যবস্থা এবং উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন বিমান অন্তর্ভুক্ত করছে।
উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের সামরিক বাহিনী আজ পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, প্রযুক্তি উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং গবেষণা–উদ্ভাবনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ফ্রান্স বা দক্ষিণ কোরিয়ার সশস্ত্র বাহিনী যেভাবে জনসেবা, শান্তি স্থাপন এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের রোল মডেল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে।
বাংলাদেশও সেই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে একটি আধুনিক বাহিনী গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তাদের উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনী যদি পেশাদারিত্ব, শৃঙ্খলা এবং নাগরিক দায়িত্ববোধে সমৃদ্ধ হয়, তবে তারা শুধু প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; বরং রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন–যাত্রার শক্তিশালী সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সবসময় জনকল্যাণ ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের পাশে দাঁড়িয়েছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, ভবন ধস, নদীভাঙন-যখনই সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত হয়েছে, তখন বাহিনী জীবন রক্ষায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির সময়ও তাদের স্বাস্থ্যসেবা, কোয়ারেন্টাইন স্থাপন, লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা রক্ষার ভূমিকা জাতি গভীরভাবে স্মরণ করবে। জনসেবামুখী এই ধারা বাহিনীকে মানুষের আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড় করিয়েছে।
...উন্নত দেশগুলো যেভাবে সাইবার প্রতিরক্ষা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মনুষ্যবিহীন যুদ্ধযান, স্যাটেলাইট নজরদারি এবং ড্রোন প্রযুক্তিকে সামরিক কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করছে, বাংলাদেশও ধীরে ধীরে সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছে।
আজকের দিনে জাতীয় উন্নয়ন, সামরিক কৌশল এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সমন্বয় আরও গভীরভাবে প্রয়োজন। সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়নের পাশাপাশি আরও গবেষণানির্ভর, নৈতিকতাবান এবং দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার ভিত্তি। উন্নত দেশগুলো যেভাবে সাইবার প্রতিরক্ষা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মনুষ্যবিহীন যুদ্ধযান, স্যাটেলাইট নজরদারি এবং ড্রোন প্রযুক্তিকে সামরিক কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করছে, বাংলাদেশও ধীরে ধীরে সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছে। এই প্রযুক্তিগত রূপান্তর সামনের সময়ের জন্য একটি অপরিহার্য বাস্তবতা।
যেকোনো দেশের সশস্ত্র বাহিনী জাতির সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রতীক। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে আমাদের বাহিনীর বিশেষত্ব হলো—তারা একটি যুদ্ধজয়ের ঐতিহ্য নিয়ে পথচলা শুরু করেছে। যে যোদ্ধারা ত্যাগের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিলেন, তাদের উত্তরসূরি হিসেবে আজকের বাহিনীও একই গৌরব ধারণ করে। এ ঐতিহ্যকে শক্তি হিসেবে নিয়ে বাহিনী দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় আরও সক্ষম ভূমিকা পালন করবে-এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের এই তাৎপর্যপূর্ণ দিনে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সৈনিকদের প্রতি শুভকামনা জানাই। আমরা প্রত্যাশা করি, বাহিনীর পেশাদারিত্ব আরও সুদৃঢ় হবে, আধুনিকায়নের অগ্রযাত্রা বহুমাত্রিকভাবে সফল হবে, এবং জনগণের সঙ্গে বাহিনীর সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
বাংলাদেশ একটি উদীয়মান শক্তি; আর তার নিরাপত্তা–স্তম্ভ হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী ভবিষ্যতে হবে আরও সক্ষম, সমৃদ্ধ ও আন্তর্জাতিক মানে সমাদৃত। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব তাদের হাতে অর্পিত এই দায়িত্ব পালনে বাহিনী সবসময় যেমন অটল থেকেছে, ভবিষ্যতেও তেমনি দায়িত্বশীল ও মর্যাদাপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে- এটাই জাতির দৃঢ় বিশ্বাস।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanmahmud.rana@gmail.com