৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কাঁপল দেশ, আরও বড় বিপর্যয় কি অপেক্ষা করছে?
দেশজুড়ে ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানল ২১ নভেম্বর ২০২৫ সকালে। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার এই কম্পনের কেন্দ্র ছিল নরসিংদীর মাধবদী। হঠাৎ ধাক্কায় আতঙ্কিত মানুষ ভবন ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন, কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে লাফিয়ে পড়েন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য ভবনে ফাটল দেখা দেয়। অনেক ভবন হেলে পড়েছে।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে শতাধিক আহত হয়েছেন। গাজীপুরের মেট্রোপলিটনসহ সব উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কুমিল্লা ইপিজেডে আতঙ্কে অনেক শ্রমিক অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ভূমিকম্প তার ভয়াবহতার নিয়ে হাজির হয় বাংলার এই জনপদে।
বিজ্ঞাপন
পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জরুরি কন্ট্রোল রুম চালু করে। বড় আকারের ভূমিকম্প আসছে আমাদের দেশে, এই সতর্ক বাণী অনেক বছর ধরেই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রস্তুতি কি আছে এই দুর্যোগ প্রতিরোধের জন্য? রাষ্ট্রের সার্বিক উদাসীনতা, দুর্নীতি আর জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধের অভাব—সব মিলিয়ে বিপন্নতা গ্রাস করেছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জনপদের অসংখ্য মানুষের।
অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীন নগরায়ন বাড়াচ্ছে ভূমিকম্প ঝুঁকি:
বাংলাদেশের ভূকম্পীয় অবস্থান অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর জনঘনত্ব, অবকাঠামোগত চাপ এবং নিয়ন্ত্রণহীন নগরায়ন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ঢাকার প্রায় ২ কোটি মানুষের বড় অংশ থাকে দুর্বল, অপরিকল্পিত, সেমি-পাকা বা অনানুষ্ঠানিক আবাসনে—যা ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
বিজ্ঞাপন
কয়েক দশকের নগরায়ন যদি বিচার করা হয়, দেখা যাবে ঢাকার বিস্তার ঘটেছে নিম্নাঞ্চল, জলাশয় ও জলাধার ভরাট করে। এসব এলাকায় দালানকোঠা নির্মাণ করা হয়েছে কোনো ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা ছাড়াই।
বড় আকারের ভূমিকম্প আসছে আমাদের দেশে, এই সতর্ক বাণী অনেক বছর ধরেই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রস্তুতি কি আছে এই দুর্যোগ প্রতিরোধের জন্য?
ঢাকার পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে দ্রুত আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে এইসব জলাশয়-জলাভূমি-প্লাবনভূমি এলাকায়। বড় ভূমিকম্প হলে এসব এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকার অর্ধেকের বেশি এলাকা এখন উচ্চঝুঁকির মধ্যে।
চিলি, হাইতি ও তুরস্কের উদাহরণ: শিক্ষা কোথায়?
২০১০ সালে চিলিতে ৮.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রায় ৭০০ মানুষ প্রাণ হারান। একই বছরে হাইতির ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত হন প্রায় ২ লাখ মানুষ। এর কারণ হলো, চিলিতে ১৯৮৫ সালের ভূমিকম্পের পর কঠোর বিল্ডিং কোড প্রয়োগ করা হয়েছিল; হাইতিতে মানা হয়নি বিল্ডিং কোড কোড, না ছিল তাদের তদারকির সক্ষমতা।
২০২৩ সালে তুরস্ক-সিরিয়ায় ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এবং ১.৬ লাখ ভবন বিধ্বস্ত হওয়া দেখিয়ে দেয়—কোনো দেশ যদি পরিকল্পনা-বহির্ভূত নগরায়ন, দুর্বল তদারকি এবং দুর্বল ভবন নির্মাণকে প্রশ্রয় দেয়, তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কয়েকগুণ ভয়াবহ হয়ে ওঠে। অথচ তুরস্কের মতো অনেক সমস্যাই ঢাকার নগরায়ন এ দেখা যায়।
ঢাকার উচ্চ ঝুঁকির বাস্তব চিত্র
রাজউকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে—মধুপুর ফল্টে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানলে ঢাকা শহরে লক্ষাধিক ভবন ধসে পড়তে পারে। দিনের বেলা এমন ঘটনা ঘটলে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের আহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০১৮ সালে রাজউকের আরও একটি জরিপে দেখা যায়—ঢাকার জরিপকৃত ১.৯৫ লাখ ভবনের ৬৭ শতাংশ ভবনই বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে নির্মিত। এর বাইরে সরকারি সংস্থার অধীনে থাকা কমপক্ষে আরও ৩৪২টি ভবন ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত হলেও এদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বেসরকারি মালিকদের অনেকেই বিপজ্জনক ভবন খালি করতে চায় না, আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও কঠোর ব্যবস্থায় আগ্রহী নয়।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই
বাংলাদেশে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি, ২০২০), ঢাকা মহানগরীর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮, ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)সহ একাধিক পরিকল্পনাগত নীতি ও বিধান বিদ্যমান। কিন্তু এসব নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তদারকি দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাব পরিস্থিতিকে অকার্যকর করে তুলেছে।
ভবন নির্মাণ অনুমোদন পদ্ধতিতে এখনো ‘পরিকল্পনা অনুমোদন’ নেই—যা নগর পরিকল্পনার অন্যতম মৌলিক শর্ত। ফলে অনেক এলাকায় স্বেচ্ছাচারীভাবে ভবন নির্মিত হচ্ছে, যেখানে নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুসারে ভবন নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই।
বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর জনঘনত্ব, অবকাঠামোগত চাপ এবং নিয়ন্ত্রণহীন নগরায়ন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ঢাকার প্রায় ২ কোটি মানুষের বড় অংশ থাকে দুর্বল, অপরিকল্পিত, সেমি-পাকা বা অনানুষ্ঠানিক আবাসনে—যা ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
সম্প্রতি ভবন নির্মাণ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় স্থাপত্য নকশা, কাঠামোগত নকশা, অগ্নি-নিরাপত্তা, বৈদ্যুতিক ও প্লাম্বিং নকশা বাধ্যতামূলকভাবে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এগুলো অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে এগুলো কার্যকর ও স্বচ্ছ তদারকি ছাড়া বাস্তবে কোনো কাজে আসবে না।
করণীয় কী?
১. ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব: জরুরি ভিত্তিতে কঠোরভাবে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড ও নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করতে হবে।
বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ) গঠন করে দ্রুত বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
২. নিম্নাঞ্চলে নির্মাণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ: জলাধার, বেসিন এলাকা বা পানি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন স্থান ভরাট করে কোনো সরকারি-বেসরকারি উন্নয়নই অনুমোদন করা যাবে না।
৩. পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর তালিকা প্রকাশ ও উচ্ছেদ: রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত সব বিপজ্জনক ভবন দ্রুত খালি করতে হবে।
৪. ন্যূনতম ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা বাধ্যতামূলক: বহুতল ভবন নির্মাণের পূর্বে মাটির পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক পরীক্ষা করতে হবে।
৫. নাগরিক সচেতনতা: ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত করতে প্রশিক্ষণ, ড্রিল ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।
৬. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত: অনিয়মে যুক্ত কর্মকর্তা, সংস্থা বা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি কার্যকর করতে হবে।
ঢাকা এমন এক শহর যেখানে প্রতিদিন লক্ষাধিক নতুন মানুষ কাজের জন্য আসে, বসবাস করে, পরিবহন ব্যবহার করে, শিশুদের স্কুলে পাঠায়। এখানে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটলে শুধু ভবন ধসবে না—অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা, হাসপাতাল, পানি-বিদ্যুৎসেবা সব কিছুই অকার্যকর হয়ে পড়বে—যা দ্রুত উদ্ধারকে আরও জটিল করে তুলবে।
আমরা যদি এখনই ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড পরিপূর্ণ অনুসরণ, নগর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার না দিই, তবে কোনো সতর্ক সংকেতই আমাদের রক্ষা করবে না।
ভূমিকম্প থামানো আমাদের হাতে নেই—কিন্তু প্রস্তুতি নেওয়া রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। এতে শিথিলতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। না হয় মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো অসম্ভব।
ড. আদিল মুহাম্মদ খান : অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)