নবান্নের উৎসবে মেতে উঠি
বাংলার ঐতিহ্য হলো হাজার বছরের পুরোনো ভাষা, সংস্কৃতি, উৎসব, জীবনযাত্রা, শিল্পকলা এবং লোকসংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ সম্ভার। যেটি নিয়ে আমরা গর্ব করি। এর মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বাউল গান, জামদানি ও মসলিন শাড়ি, নকশিকাঁথা, শীতল পাটি, বৈশাখী মেলা, নবান্ন উৎসব, পৌষ পার্বণ এবং বিভিন্ন ধরনের লোকনৃত্য ও সঙ্গীত।
অন্য দিকে ছয় ঋতুর দেশ হলো বাংলাদেশ, যেখানে বছরে ছয়টি ঋতু যথাক্রমে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত পালাক্রমে আসে। এই ঋতু চক্রের আবর্তে প্রকৃতি ও জীবনে নিয়ে আসে বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের এক অফুরন্ত প্রেম। ঋতু চক্রের আবর্তে ঠিক এই মুহূর্তে আমরা শরৎ পেরিয়ে হেমন্তে অবস্থান করছি এটি শীতের পূর্বাভাসের ঋতু হিসেবে দেখা হয়।
বিজ্ঞাপন
কৃষি ভিত্তিক এবং ষড় ঋতুর দেশে প্রধান ফসল হলো ধান। প্রাচীন বাংলাদেশে মূলত আউশ এবং আমন ধানের চাষ বেশি হতো। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে সেচ-নির্ভর বোরো (ইরি) ধানের প্রচলনের আগে পর্যন্ত এই দুটি ধানই ছিল প্রধান খাদ্য ফসল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে এখন তিনটি ঋতুতে যথাক্রমে আউশ, আমন এবং বোরো ধান চাষ করা হয়।
এর মধ্যে আমন ধান কৃষকেরা এই হেমন্ত ঋতুতে ঘরে তোলে। এই ঋতুতে মাঠে পাকা ধানের সোনালি রঙে মাঠকে সাজিয়ে নেয়। হেমন্তের সকালে হালকা কুয়াশা ও শিশির থাকে। মাঠ ভরা সোনালি ধান যেন কৃষকদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ লাগিয়ে দেয়। কারণ মাঠের সোনালি ধান কৃষকের জীবন ও জীবিকার প্রধান ভরসা।
বিজ্ঞাপন
আনন্দের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে সোনালি ধান ফসল ঘরে তোলার প্রস্তুতি নেয়। নির্বিঘ্নে বহু প্রত্যাশিত ধান ঘরে আনতে পারলে কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। সকালের শিশির আর ধুলো মাখা পথে চাষি আর রাখালের গরুর পাল নিয়ে ক্ষেত আর মাঠে যাওয়ার যে দৃশ্য হেমন্তের মিষ্টি রোদে সকালের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে তা কেবল এই ষড়ঋতুর দেশেই দেখা যায়। যেটি যান্ত্রিকতার ডামাডোলে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ধানের সোনালি রঙ এবং নতুন ধানের মিষ্টি ঘ্রাণে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে গ্রামীণ জনপদ। সেটি বাস্তবে উৎসবে রূপ দিতেই এদেশের অন্যতম উৎসব ‘নবান্ন উৎসব’।
নবান্ন শস্যভিত্তিক একটি লোকউৎসব। ১৯৯৮ সাল থেকে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব উদযাপন শুরু হয়। এই উৎসবটি সাধারণত পহেলা অগ্রহায়ণে পালিত হয়। যা আমন ধান পাকার সময়টাকে নির্দেশ করে। তবে কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় প্রধান শস্য সংগ্রহকে কেন্দ্র করে যেকোনো ঋতুতে এ উৎসব পালিত হয়ে থাকে। অধিক শস্যপ্রাপ্তি, বৃষ্টি, সন্তান ও পশুসম্পদ কামনা এ উৎসব প্রচলনের প্রধান কারণ।
নবান্ন হলো নতুন ধান কাটার পর প্রথম অন্নগ্রহণের উৎসব। ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ হলো ‘নতুন অন্ন’। এখানে অন্ন অর্থ ভাত। এই উৎসব সাধারণত হেমন্তকালেই অনুষ্ঠিত হয়, যখন নতুন আমন ধান পাকে। এটি মূলত একটি ফসল কাটার উৎসব। যেখানে নতুন চাল দিয়ে তৈরি ভাতের স্বাদই অন্যরকম। এই চালের ভাত সাধারণত কিছুটা আঠালো হয়। নতুন চালের ভাত ও পিঠা-পুলি এই উৎসবের ঐতিহ্যবাহী খাবার। যা ফসল ঘরে তোলার আনন্দ এবং নতুন করে বাঁচার অনুভূতি প্রকাশ করে।
আমি শৈশবে এটি দারুণভাবে উপভোগ করেছি। আগের সেসব বিশেষ ধরনের ধান কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং তার জন্য খাদ্য জোগান দিতে অধিক ফলনশীল ধানের জাত ছাড়া আর কোনো বিকল্প না থাকায় ঐতিহ্যবাহী ধানগুলো হারিয়ে গেল। বর্তমানে এই উৎসবের মূল রূপটি কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। যেখানে এটি কেবল একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব হিসেবে পালিত হয় না। সংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য যুক্ত হয়েছে লোকনৃত্য, গান এবং মেলা। ব্যস্ত জীবনের মাঝে একটু আনন্দ ফুর্তির ছোঁয়ায় যেন স্বস্তি এনে দেয়। বিষণ্নতায় ভরা অনেকের জীবনে এটি এক সঞ্জীবনী।
শিশিরস্নাত সকাল, কাঁচাসোনা রোদমাখা স্নিগ্ধসৌম্য দুপুর, পাখির কূজনে ভরা মিষ্টি সন্ধ্যা আর মেঘমুক্ত আকাশে জ্যোৎস্নাস্নাত রাত হেমন্তকালকে যেন আরও আবেগঘন করে তোলে। প্রকৃতিতে এনে দেয় ভিন্নমাত্রা। হেমন্তের এই মৌনতাকে ছাপিয়ে গ্রামীণ জনপদের মানুষের জীবনে নবান্ন প্রবেশ করে এক আনন্দের বার্তা নিয়ে। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের জীবনে অণুঘটকের মতো এনে দেয় সর্বজনীন এক উৎসবের ছোঁয়া।
নবান্ন মানেই চারিদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ, নতুন অন্ন, গ্রামের মাঠে মাঠে চলে ধান কাটার এক অলিখিত উৎসব। এই ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে ঘরে শুরু হয় গ্রামীণ মহিলাদের নবান্ন উৎসব উদযাপনের প্রস্তুতি। গৃহস্থবাড়িতে নতুন ধানে তৈরি পিঠাপুলির সুগন্ধ বাতাসে যেন ভেসে বেড়ায়। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে হেমন্তের এই শাশ্বত রূপ যেন এক লাল সবুজের বাংলাদেশের প্রতীক। বাংলাদেশের কয়েকটি উপজাতিও তাদের প্রধান ফসল ঘরে তোলার পর নবান্ন উৎসব পালন করে।
নবান্ন শস্যভিত্তিক একটি লোকউৎসব। ১৯৯৮ সাল থেকে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব উদযাপন শুরু হয়। এই উৎসবটি সাধারণত পহেলা অগ্রহায়ণে পালিত হয়। যা আমন ধান পাকার সময়টাকে নির্দেশ করে।
সাঁওতালরা পৌষ-মাঘ মাসে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে উদযাপন করে সোহরায় উৎসব। তারা সাতদিন সাত রাত গানবাজনা এবং তাদের তৈরি বিশেষ পানীয় পানের মাধ্যমে এ উৎসব পালন করে থাকে। উসুই উপজাতি অন্নদাত্রী লক্ষ্মীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মাইলুকমা উৎসব পালন করে। জুম চাষি ম্রো উপজাতি চামোইনাত উৎসবে মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাতে সবাইকে ভূরিভোজন করায়। ফসল তোলার পর গারো উপজাতি ফল ও ফসলের প্রাচুর্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে পালন করে পানাহার ও নৃত্যগীতবহুল ওয়ানগালা উৎসব।
নবান্নের সাথে সাথে প্রকৃতি রূপ নিয়ে একটু আলোচনা না করলে রূপময়ী হেমন্ত যে মনে মনে বড্ড কষ্ট পাবে! প্রকৃতির সন্তান হয়ে সেটা কি করা ঠিক হবে? আপনারাই বলুন সেটা ঠিক হবে?
হেমন্তের প্রকৃতি নিয়ে আপনাদের কিছু তথ্য দেই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়—
‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা--
হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা॥’
হেমন্তের কবি জীবনানন্দ দাশ বিখ্যাত ‘বনলতা সেন’ কবিতায় হেমন্তের চিত্র এঁকেছেন। ‘বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান তার আঁকা অসংখ্য ছবিতে বাংলার এই কৃষক, হেমন্ত, অঘ্রাণের রূপটাকেই মহিমান্বিত রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন তার তুলিতে এক গভীর মমতায়।
হেমন্তের নির্মল আকাশে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ে বাংলার এই উর্বর মাটিতে। রাত যত গভীর হয়-হিম হিম মৃদু বাতাসে যেন শীতের ছোঁয়া লাগে। প্রায়শই গভীর রাতে স্তব্ধতা ভেঙে শোনা যায় ডেকে ওঠা পেঁচার ডাক, বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দ গ্রাম বাংলার আদি হৈমন্তী আবহটাকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলে বাংলার অপরূপ প্রকৃতিকে।
হেমন্তে বাংলার প্রকৃতি এবং এই সময়ের শোভাবর্ধনকারী গাছ ও ফুল নিয়ে সংক্ষেপে আপনাদের মনতুষ্টির চেষ্টা করব। হেমন্ত মানেই কিছু কিছু গাছের পাতার বিবর্ণতা। সেই বিবর্ণতারও একটি সুন্দর রূপ আছে। জ্যোৎস্না যেমন আলো ও সৌন্দর্যের প্রতীক, তেমনি আঁধারেরও নিজস্ব এক গভীর, রহস্যময় এবং প্রশান্ত রূপ রয়েছে। যা প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আঁধার কেবল শূন্যতা বা ভয় নয়। এর মধ্যে রয়েছে নিস্তব্ধতা, গভীরতা এবং এক ধরনের আধ্যাত্মিক প্রশান্তি যা আলোতে পাওয়া যায় না।
একইভাবে গাছের সবুজ পাতার যেমন একটি রূপ আছে ঠিক তেমনই বিবর্ণ সবুজ পাতারও আরেকটি মায়াবী রূপ আছে। শান্ত স্নিগ্ধ হেমন্তের প্রকৃতিকে ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে যে, হেমন্তের শুরুতেই গাছের পাতা বিবর্ণ হতে থাকে। কারণ দিনের আলোর দৈর্ঘ্য কমে যাওয়া এবং তাপমাত্রার হ্রাসের কারণে গাছগুলো শীতের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
এই সময়ে গাছের সবুজ পাতার প্রধান রঞ্জক পদার্থ ‘ক্লোরোফিল’ ভেঙে যেতে শুরু করে। ফলে পাতাগুলো সবুজ রঙ হারিয়ে হলুদ, লাল বা বাদামী রঙ ধারণ করে। এটি সবুজ গাছের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যা গাছকে শীতকালে শক্তি সঞ্চয় করতে এবং চরম ঠান্ডা থেকে বাঁচতে সাহায্য করে। শুষ্ক আবহাওয়া এবং কম বৃষ্টিপাতের কারণে প্রস্বেদনের মাধ্যমে পানি হারানোটাকে নিয়ন্ত্রণ করাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
হেমন্তের স্পর্শ পেতেই গাছের পাতায় যেন নববধূর গালে হলুদের ছোঁয়া লাগে। তরুণীর লাজে রাঙ্গা গালের রঙে রাঙিয়ে উঠে গাছের পাতা তথা শীত প্রধান দেশের সবুজ গাছপালা। ঢাকা শহরে ভালো দেখা যায় বড় বড় বৃক্ষের শাখায় বেড়ে ওঠা কিছু ফার্ন জাতীয় পরাশ্রয়ী উদ্ভিদে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং বুয়েটের মাঝখানের রাস্তার দুইধারে শোভাবর্ধন করছে অনেকগুলো শতবর্ষী রেইন ট্রি বা রাত কানা গাছ (Samanea saman)। বিদেশি গাছ বলে অনেকের কাছে অপছন্দের হলেও এটি একটি প্রশস্ত ছাউনিযুক্ত গাছ যার একটি বৃহৎ প্রতিসম ছাতার আকৃতির মুকুট রয়েছে।
উল্লিখিত রাস্তার গাছগুলোর দৃষ্টিনন্দন সবুজ আচ্ছাদন দিয়ে গ্রীষ্মের প্রখর সূর্য তাপ থেকে আমাদের সুশীতল ছায়া দিয়ে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। আবার এই গাছগুলো ঘিরে সৃষ্টি হয় ফার্নের একটা নান্দনিক ভেজিটেশন। এই সময়ে ফার্নের নান্দনিক ভেজিটেশনের সবুজ রঙটি পরিবর্তিত হয়ে সোনালি ধানের মতো হলুদ রঙে পরিণত হয় যেটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
জাপানে হেমন্তের দৃষ্টিনন্দন রূপের কথা উল্লেখ করতে চাই। পশ্চিমা দেশের মতো জাপানও শীত প্রধান দেশ। হেমন্তে সেখানেও পাতার রঙ পরিবর্তন হয়। যাকে জাপানি ভাষায় মোমিজি বলা হয়। মোমিজি উৎসব বলতে জাপানে হেমন্তের সময়ে ম্যাপেল গাছের পাতা ঝরে পড়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার অনুষ্ঠানকে বোঝায়, যা 'মোমিজি' নামে পরিচিত।
এই সময়ে কিয়োটোর আরাশিয়ামা বা মাউন্ট ফুজির লেক কাওয়াগুচিকোর মতো স্থানে বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে পাতাগুলো সবুজ থেকে লাল বা সোনালি বর্ণ ধারণ করে। আবার গিংকো (Ginkgo biloba) গাছের পাতা হলুদ রঙে শোভাবর্ধন করে। প্রাচীনকাল থেকেই চীনা এবং জাপানি মন্দিরের বাগানে রোপণ করা হয়ে আসছে এই জীবন্ত ফসিলের গাছগুলো। আমি যে শহরে ছিলাম সেখানে গিংকো গাছের আধিক্য ছিল। আমি গিংকোকে প্রাণভরে উপভোগ করেছি।
হেমন্তের ফুল নিয়ে কিছু না লিখলে যে, ফুলপ্রেমীদের মনের খোরাক মেটানো যাবে না। তাই তাদের কথাও বিবেচনা করে একটু খোরাক জোগায়। ফুলপ্রেমীদের জন্য এই সময়টা তেমন দৃষ্টিনন্দন না হলেও প্রকৃতি তাদের একেবারে বিমুখ করেনি। এই সময় সাধারণত যেসব ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে ফুলপ্রেমীদের মনের খোরাক জোগায় তার মধ্যে অন্যতম হলো, ছাতিম, দাদমর্দন, বকফুল, গন্ধরাজ, শিউলি, রক্তচিতা, অনন্তলতা, কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, সোনাপাতি, লতাপারুল ইত্যাদি। এর মধ্যে কয়েকটি ফুল নিয়ে সংক্ষিপ্তাকারে নিচে বর্ণনা করা হলো।
নবান্ন মানেই চারিদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ, নতুন অন্ন, গ্রামের মাঠে মাঠে চলে ধান কাটার এক অলিখিত উৎসব। এই ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে ঘরে শুরু হয় গ্রামীণ মহিলাদের নবান্ন উৎসব উদযাপনের প্রস্তুতি।
ছাতিম: এই সময়ে যে কয়েকটি ফুল আমাদের জন্য ফোটে তার মধ্যে অন্যতম হলো ছাতিম (Alstonia scholaris)। অনেকেই এটিকে ছাতিয়ান বলে থাকেন। এটি একটি বড় চিরসবুজ গাছ। ছাতিমের পাতার গুচ্ছে সাধারণত ৭টি করে পাতা থাকে বলেই একে 'সপ্তপর্ণী' নামে ডাকা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে এক আবর্তে পাতার সংখা ৫-৭ এর মত থাকে।
এর ফুল বিশেষ প্রকৃতির অর্থাৎ সবুজাভ সাদা বর্ণের, গন্ধযুক্ত ও গুচ্ছবদ্ধ। হেমন্তে ছাতিমের গন্ধে সুবাসিত হয়ে থাকে চারপাশ। ছাতিমের ফুল সন্ধ্যায় ফোটে এবং রাত্রি বাড়ার সাথে সাথে এর সুবাসও তীব্র হতে থাকে। অনেকদূর থেকেও এই ফুলের গন্ধ অনুভব করা যায়। ছাতিমের ডালপালা ছড়ানোর বৈশিষ্ট্যটিরও একটি স্বকীয়তা আছে।
দাদমর্দন: এই সময়ের আরেকটি ফুল হলো দাদমর্দন (Senna alata)। এটি দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয়, সম্ভবত গায়ানা এবং আমাজন এবং ওরিনোকো অববাহিকার নদীর তীরে এদের আবাসস্থল ছিল। তবে এখন বিশ্বব্যাপী গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। এটি আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং উত্তর আমেরিকার অনেক অংশে প্রবর্তিত এবং প্রাকৃতিকীকরণ করা হয়েছে।
এই ফুলের বিশেষত্ব হলো অনাদরে, পথের ধারে, পরিত্যক্ত জমিতে, খেতের মধ্যবর্তী এবং অনাবাদি স্থানে দাদমর্দন গাছ জন্মায়। এটি মূলত দ্রুত বর্ধনশীল গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। সাধারণত এক থেকে দুই মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। ডালের আগায় ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার খাড়া ডাটায় হলুদ রঙের ফুল নিচ থেকে ওপরের দিকে ফোটে। দেখতে অনেকটা হলুদ মোমবাতির মতো। এজন্য ইংরেজিতে একে candle bush বলা হয়। এর যেমন ফুলের সৌন্দর্য আছে ঠেক তেমনই ভেষজ গুণও আছে যেটির বাংলা নাম দেখলেই বোঝা যায়। বিশেষ করে চর্মরোগে এই গাছ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। তবে দাদ ও পাঁচড়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার্য।
বকফুল: বকফুল (Sesbania grandiflora) একটি শোভাবর্ধনকারী এবং দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। বকফুলের সৌন্দর্য এর সাদা, রক্তলাল, এবং হালকা গোলাপি রঙের ফুলের মধ্যে নিহিত। বকফুল কেবল দেখতেই সুন্দর নয়। এর কলিগুলোও দেখতে পাখির ঠোঁটের মতো হওয়ায় এর সৌন্দর্যের এক অনন্য মাত্রায় পৌঁছে। বকফুলের বিভিন্ন ব্যবহার রয়েছে, যার মধ্যে প্রধান হলো এটি একটি জনপ্রিয় সবজি ও ভেষজ ওষুধ।
সবজি হিসেবে এটি ভাজা (বড়া), তরকারি বা অন্যান্য পদে ব্যবহার করা হয়। এর পাতা ও রস বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। বকফুল কোষ্ঠকাঠিন্য, কৃমি, গ্যাস্ট্রিক আলসার এবং সর্দি-কাশির মতো সমস্যা নিরাময়ে সাহায্য করে। গাছটি দ্রুত বর্ধনশীলের কারণ হলো মাটিতে বসবাসকারী নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী ব্যাকটেরিয়ার সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলীয় নাইট্রোজেন সংবন্ধন করার ক্ষমতা। এই প্রক্রিয়াটি পুষ্টির অভাবযুক্ত মাটিতেও এটিকে বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে। কারণ এটির নাইট্রোজেনের প্রধান উৎস হলো বায়ুমণ্ডল। এটি বিভিন্ন অবস্থার সাথেও খাপ খাইয়ে নেয়।
গন্ধরাজ: গন্ধের রাজা যে ফুল সেটিই হলো গন্ধরাজ (Gardenia jasminoides)। আমাদের দেশে সব মানুষের কাছে অতিপরিচিত একটি ফুল। এই ফুলটির ইংরেজি নাম গার্ডেনিয়া এবং কেপ জ্যাসমিন। গন্ধরাজ ফুলের ইংরেজি নামকরণ করা হয়েছে একজন বিখ্যাত আমেরিকান প্রকৃতিবিদ ড. আলেকজেন্ডার গার্ডেন এর নাম অনুসারে। এ ফুল মিষ্টি ও তীব্র সুগন্ধের জন্য বেশ জনপ্রিয়।
এর আদিনিবাস চীন। এটি গুল্মজাতীয় বহুবর্ষজীবী একটি উদ্ভিদ। গন্ধরাজ ফুলের অনেক উপকারিতা রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ওষুধি গুণাবলী, ত্বকের যত্ন, মানসিক শান্তি প্রদান এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যা উপশম। এর সুগন্ধি তেল সুগন্ধি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় এবং এটি ঐতিহ্যগত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
শিউলি: শিউলি (Nyctanthes arbor-tristis) মানেই শরৎ যেমন সত্য তেমনই এটি প্রস্ফুটিত থেকে হেমন্তকালেও মানুষের মনের খুদা মিটিয়ে থাকে। ছোট বৃক্ষ বা গুল্ম। ইংরেজিতে এ ফুলকে বলা হয় ‘Night-flowering Jasmine’। সুগন্ধি এ ফুলে রয়েছে পাঁচ থেকে সাতটি সাদা বৃত্তি ও মাঝে লালচে-কমলা টিউবের ফুলগুলো রাতে ফোটে, সুগন্ধ ছড়ায় এবং সকালে ঝরে যায়। শরৎ ও হেমন্তকালের শিশিরভেজা সকালে ঝরে থাকা শিউলি অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য তৈরি করে।
‘শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন ভুল।।
রাতের বায় কোন্ মায়ায় আনিল হায় বনছায়ায়,
ভোরবেলায় বারে বারেই ফিরিবারে হলি ব্যাকুল।।’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মুগ্ধ হয়েছিলেন এই শিউলির রূপে।
ফুলের রূপে মুগ্ধ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
‘শিউলি তলায় ভোর বেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।’
আরও লিখেছেন, ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথী কই।’
হেমন্ত বা নবান্নের প্রকৃতি আর রূপের কথা বলে শেষ করা যাবে না, শেষ করতে হবে লেখা। তাই নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠার আহ্বান জানায় সবাইকে।
ড. মিহির লাল সাহা : অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়