বাংলাদেশে অপরাধ এবং জনঅসন্তোষের মাত্রা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। যেমন, রাজধানীতে কয়েক মাসে হত্যাকাণ্ড, ছিনতাই, মব, মগিংয়ের (mugging) ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে; সাধারণ মানুষ রাতে বাইরে যেতে ভয় পায়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ১০ মাসে (জানুয়ারি থেকে অক্টোবর) রাজধানীতে ১৯৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নভেম্বরেও আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে পুরান ঢাকা এবং পল্লবীর দুটি ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে মাসে গড়ে প্রায় ১৯ থেকে ২০টি হত্যাকাণ্ড ঘটছে। [ঢাকা পোস্ট, ১ ডিসেম্বর ২০২৫]

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে একই ধরনের আট শতাধিক ঘটনায় অন্তত ১১৯ জন নিহত হন। আহত সাত হাজার ৪২ জন। এছাড়া সামাজিক অস্থিরতাসহ অন্যান্য কারণেও হত্যার ঘটনা বাড়ছে। এতে জনমনে আতঙ্ক বাড়ছে। [কালের কণ্ঠ, ৩ ডিসেম্বর ২০২৫]

সারা দেশে হত্যাসহ সাত ধরনের অপরাধ বেড়েছে। অন্য ছয়টি অপরাধের মধ্যে রয়েছে—ডাকাতি-দস্যুতা, অপহরণ, নারী ও শিশু নির্যাতন, চুরি, সিঁধেল চুরি ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবর মাসে এই সাত ধরনের অপরাধের ঘটনায় ৫ শতাংশ মামলা বেড়েছে। [কালের কণ্ঠ, ১১ নভেম্বর ২০২৫]

অন্যান্য খবর বলছে, বেপরোয়া ২৩৭ 'কিশোর গ্যাং'; আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং; মব সন্ত্রাস: অশনিসংকেত; আইনের শাসন না থাকায় গণপিটুনি, মব তৈরি বাড়ছে।

উপরের ঘটনাগুলো আমরা দেখবো ক্রিমিনোলজির কয়েকটি প্রখ্যাত তত্ত্বের আলোকে—যেমন শহরের নির্দিষ্ট সময় (রাত বা সন্ধ্যা) যখন জনদৃষ্টি কম, পুলিশ টহল সংখ্যা কম এবং জনগণ কাজ শেষে ঘরে ফিরছে—সেই সময় অনেকেই কাছাকাছি বাজার, সড়ক বা জনসমষ্টিতে যায়। এই ‘নিয়মিত রুটিন’ অপরাধীদের কাছে সুযোগ তৈরি করে। বিশেষ করে গ্যাং বা ছিনতাইকারী যারা অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়।

আর নির্ভরযোগ্য নজরদারির অভাবে—‘capable guardian’ অনুপস্থিত হলে ‘suitable target’ হিসেবে সাধারণ মানুষ ও তার সম্পদ সহজে শিকারে পরিণত হয়। এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে, কেন শহরের নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে অপরাধ সহজ।

যেসব এলাকায় দরিদ্র্যতার হার বেশি, ঘনবসতি, সামাজিক বন্ধন দুর্বল, পরিবার-নিয়ন্ত্রণ কম—সেসব এলাকায় গ্যাং গঠন, অপরাধ প্রবণতা, চাঁদাবাজি, গ্যাং-এর দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, কিশোর গ্যাংগুলো সাধারণত এমন এলাকায় সক্রিয় হয় যেখানে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কম। গণমাধ্যমও বারবার এই গ্যাং-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করছে।

কিশোর গ্যাংগুলো সাধারণত এমন এলাকায় সক্রিয় হয় যেখানে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কম। গণমাধ্যমও বারবার এই গ্যাং-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করছে।

যদি ছোট ছোট অপরাধ যেমন চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মব, মগিং বা অনিয়ম (গুজব, হঠাৎ মূল্যহ্রাস/বৃদ্ধি, অবাঞ্ছিত ভিড়, আইনশৃঙ্খলা শিথিলতা) অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তার ফলে জনমনে মনে হবে ‘নিয়ম/শৃঙ্খলা নেই, সবাই সুযোগ পাবে’; এতে বৃহৎ অপরাধ (দস্যুতা, গ্যাং কালচার, চুরি, হত্যাকাণ্ড) নতুন করে উত্থান পায়।

সাম্প্রতিক অপরাধ বৃদ্ধি—যেমন মব, মগিং, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, গ্যাং সংঘর্ষ—এ তত্ত্বকে সমর্থন করে। অপরাধীরা সাধারণত ঝুঁকি ও লাভের মধ্যে তুলনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। যদি তারা দেখে যে রাতের বেলা মানুষ কম, সিসিটিভি বা পুলিশ নজরদারি কম, জনজীবন বিশৃঙ্খল তখন তারা অপরাধকে ‘লো রিস্ক, হাই রিটার্ন’ হিসেবে বিবেচনায় আনে। গ্যাং, ছিনতাইকারী, মব বা মগকারীরা এমনই পরিকল্পনা করে অপরাধ করে যে, যা বর্তমান গ্যাং-সংক্রান্ত সংবাদে দেখা যায়।

২০২৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, সরকারের নিরাপত্তা পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, রাজধানীর গলিসহ শহরাঞ্চলে চেকপয়েন্ট, টহল ও যৌথ অভিযান বাড়ানো হয়েছে। গ্যাং ও চাঁদাবাজি দমন করতে বিভিন্ন অভিযানে গ্যাং সদস্য গ্রেপ্তার। যেমন গোপালগঞ্জে ৮ গ্যাং সদস্য গ্রেপ্তার।

পুলিশ জানায় যে, তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, গ্রেপ্তার করছে; যদিও ‘অপরাধপূর্ণতর পরিস্থিতি’ এখনো আছে। ‘মব, মগিং, ছিনতাই, হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি, গ্যাং—এসব এখন বেশ ‘রূপান্তরিত অপরাধ’। সংবাদে বলা হয়, প্রথমে গ্যাং বা চাঁদাবাজি হলেও, পরে তারা হত্যাকাণ্ড, অস্ত্রসহ লুট-পাটে প্রবৃত্ত হয়।

কিছু ক্ষেত্রে, পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসন হঠাৎ সাড়া দেয়; ‘কমিউনিটি পুলিশের ঘাটতি’, ‘নিয়মিত টহল-অপর্যাপ্ততা’, ‘তথ্য-সংগ্রহ বা গ্যাং-নজরদারিতে দুর্বলতা’—এমন চ্যালেঞ্জও রয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্যাং দমনে শুধু গ্রেপ্তার নয়, সামাজিক সমস্যার মূলে যেতে হবে, আইন প্রয়োগ এবং সামাজিক পুনর্বাসন উভয়কেই গুরুত্ব দিতে হবে।

উপরের তত্ত্বগুলো এবং প্রতিবেদনগুলো একসঙ্গে দেখালে বোঝা যায়—Routine Activity & Rational Choice Theories ব্যাখ্যা করে কেন শহরের নির্দিষ্ট সময় ও জনবহুল এলাকায় অপরাধ হয়।

Social Disorganization Theory নির্দেশ করে যে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, গ্যাং-সংগঠন এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা অপরাধ প্রবণতা বাড়ায়। Broken Windows Theory বলছে, যদি ছোট অপরাধ ও অগোছালো পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে বড় ধরনের অপরাধ এবং গ্যাং-সংগঠন আরও প্রসারিত হয় এবং পুলিশের দ্রুত প্রতিক্রিয়া, টহল-নিয়ম, উদ্যোগী অভিযান, গ্যাং গ্রেপ্তার, যেভাবে কিছু সংবাদ দেখাচ্ছে—সে কাজগুলো তত্ত্বগতভাবে অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর।

তবে বাস্তবটিতে শুধুই পুলিশি আইন প্রয়োগ যথেষ্ট নয়, সামাজিক পুনর্বাসন, সতর্কতা, কমিউনিটি অংশগ্রহণ, প্রাথমিক প্রতিরোধ ইতিমধ্যেই জরুরি।

অপরাধীরা সাধারণত ঝুঁকি ও লাভের মধ্যে তুলনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। যদি তারা দেখে যে রাতের বেলা মানুষ কম, সিসিটিভি বা পুলিশ নজরদারি কম, জনজীবন বিশৃঙ্খল তখন তারা অপরাধকে ‘লো রিস্ক, হাই রিটার্ন’ হিসেবে বিবেচনায় আনে।

প্রতিটি ওয়ার্ড বা পাড়া-গাঁওতে কমিউনিটি অফিসার, স্বেচ্ছাসেবক, নাগরিক ফোরাম—তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং সিসিটিভি বা নজরদারি। এতে Routine Activity Theory-এর ‘capable guardian’ প্রতিষ্ঠা করা যায়।

কিশোর গ্যাং-এর শিকড় কাটতে হবে অর্থাৎ দরিদ্র, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহে যুবকদের জন্য শিক্ষা, কাজ, কার্যকর ট্রেনিং, সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।

Social Disorganization Theory অনুযায়ী সামাজিক কাঠামো মজবুত করতে হবে। যেকোনো মব, মগিং, চাঁদাবাজি, ছিনতাই বা ভ্যান্ডালিজম হলে দ্রুত পদক্ষেপ; এতে ‘Broken Windows’ ধারা বন্ধ হয়।

কোন এলাকায় গ্যাং সক্রিয়, কোন সময়, কোন ধরনের অপরাধ বেশি হচ্ছে এই ধরনের ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, হটস্পট ম্যাপিং, ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পুলিশি ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে, গুজব বা ভয় না ছড়াতে বলতে হবে। যেকোনো হামলা, চাঁদাবাজি বা সন্দেহ জন্য ঘটনা ঘটলে পুলিশের কাছে জানাতে উৎসাহিত করতে হবে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণমাধ্যমে—হত্যাকাণ্ড, মব, মগিং, গ্যাং কালচার, চাঁদাবাজি, গ্যাং সংঘর্ষ ইত্যাদি দেখায় যে অপরাধ এবং বিশৃঙ্খলা এখন শুধু ঈষৎ একটি স্থানে সীমাবদ্ধ নয়; তা শহর ও গ্রাম উভয়স্থানে ছড়িয়েছে।

এই বাস্তবতা ক্রিমিনোলজির তত্ত্ব (Routine Activity, Social Disorganization, Broken Windows, Rational Choice) দ্বারা বোঝা যায় এবং বিশ্লেষণ করা যায়।

পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্যাং গ্রেপ্তার, টহল বৃদ্ধি, অভিযান ইত্যাদি ক্ষেত্রে সফল হয়েছে কিন্তু পুলিশি আইন প্রয়োগের সঙ্গে সামাজিক পুনর্বাসন, কমিউনিটি অংশগ্রহণ, তরুণদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি, সচেতনতা, নিয়মিত নজরদারি—এগুলো একসঙ্গে না গেলে দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে না।

বাংলাদেশে যদি অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা রোধ করতে হয়, তাহলে শুধু আইন প্রয়োগ নয় সমাজ, অর্থনীতি, যুবসমাজ এবং জনগণের অংশীদারি কাঠামোর ওপর জোর দিতে হবে।

মো. মাজহারুল ইসলাম : সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়