জলবায়ু ন্যায়বিচার উপেক্ষিত : কপ ৩০ ও বাংলাদেশের শূন্য প্রাপ্তি
জলবায়ু পরিবর্তন আজ আর বৈশ্বিক আলোচনার কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়; বাংলাদেশের জন্য এটি একটি প্রতিদিনের বাস্তবতা। বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান নগণ্য হলেও জলবায়ু বিপর্যয়ের অভিঘাত সবচেয়ে বেশি বহন করছে এই দেশই। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ, খরা ও লবণাক্ততার মতো দুর্যোগ এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি, কৃষি ও মানুষের জীবনযাত্রাকে নিয়মিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অথচ এই বাস্তবতার বিপরীতে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের প্রাপ্য জলবায়ু ন্যায়বিচার আজও নিশ্চিত হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে থাকলেও, ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তার অবস্থান বরাবরের মতোই প্রান্তিক।
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য দায়বদ্ধতা, ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক সংহতির প্রধান মঞ্চ। প্রতিশ্রুতি ছিল, যারা ঐতিহাসিকভাবে দূষণ করেছে তারা ক্ষতিপূরণ দেবে, আর যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা সহায়তা পাবে। কিন্তু বাস্তবে একের পর এক COP (Conference of the Parties) সম্মেলন বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য আশ্বাসের বদলে হতাশাই বাড়িয়েছে। এই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ সংযোজন হলো কপ ৩০– যেখানে উচ্চ প্রত্যাশা থাকা সত্ত্বেও জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি আবারও কার্যকরভাবে উপেক্ষিত থেকে গেছে।
বিজ্ঞাপন
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (UNFCCC) আওতায় গত ১০-২১ নভেম্বর ব্রাজিলের বেলেম শহরে কপ ৩০– এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে কপ ৩০– কে ঘিরে আলোচনা শুরু হয়েছে তার অনেক আগেই। সম্মেলনের লক্ষ্য, অভিষ্ট, স্থান নির্বাচন এবং সম্ভাব্য কর্মসূচি— সবকিছুই পরিকল্পিত হয়েছে বহুমাত্রিক রাজনৈতিক, পরিবেশগত ও কৌশলগত বিবেচনায়। সব মিলিয়ে এবারের কপ ৩০– কে ঘিরে প্রত্যাশা ছিল বেশ উচ্চ। কারণ, এটি কেবল আরেকটি জলবায়ু সম্মেলন নয়; বরং বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতিতে একটি ভিন্ন বার্তা দেওয়ার চেষ্টা।
এবারের সম্মেলনের উল্লেখযোগ্য দিক হলো : প্রথমত, সম্মেলনের জন্য ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার কোনো উন্নত শহর নির্বাচন করা হয়নি। বরং কপ ৩০– এর জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ব্রাজিলের বেলেম (Belém) শহর— যার পেছনে রয়েছে গভীর প্রতীকী ও কৌশলগত তাৎপর্য। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা নিজেই এই স্থান নির্বাচনের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেন। বেলেম শহর পরিচিত “আমাজনের প্রবেশদ্বার” হিসেবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাজন রেইনফরেস্ট বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‘কার্বন সিঙ্ক’— যা বিপুল পরিমাণ কার্বন শোষণ করে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
বিজ্ঞাপন
এই বিশাল বনভূমির একেবারে সন্নিকটে সম্মেলনের আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্বনেতাদের সামনে একটি স্পষ্ট বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে— প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা কেবল নীতিগত অঙ্গীকারের বিষয় নয়, বরং এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। বলা যায়, এর মাধ্যমে আমাজনকে বিশ্ব জলবায়ু রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসার একটি সচেতন প্রচেষ্টা করা হয়েছে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বসে প্রকৃতির সুরক্ষা নিয়ে আলোচনা— এই প্রতীকী বার্তার কারণেই অনেকেই কপ ৩০– কে আখ্যা দিচ্ছেন “ফরেস্ট কপ” নামে।
দ্বিতীয়ত, শত শত বছর ধরে আমাজন অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীই মূলত এই বনভূমির প্রকৃত রক্ষক। তাদের জীবনযাপন, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বন সংরক্ষণের সঙ্গে। বেলেমে কপ ৩০ আয়োজনের ফলে এই প্রথম আদিবাসী নেতাদের কণ্ঠস্বর সরাসরি ও তুলনামূলকভাবে শক্তিশালীভাবে আন্তর্জাতিক জলবায়ু আলোচনার কেন্দ্রে পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাদের দৈনন্দিন বাস্তবতা, বন রক্ষার সংগ্রাম এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরাই ছিল এই সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
তৃতীয়ত, বেলেম কোনো অতিআধুনিক বা অত্যন্ত উন্নত নগর নয়। এই শহরে সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বনেতাদের সামনে একটি ভিন্ন বাস্তবতা উপস্থাপন করা হয়েছে— উন্নয়নশীল দেশগুলোর শহরগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ এবং সীমিত অবকাঠামো নিয়ে তারা কী ধরনের বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর ফলে উন্নত দেশগুলোর কাছে জলবায়ু অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং অভিযোজন সহায়তার দাবি আরও বাস্তবসম্মত ও নৈতিকভাবে জোরালো হয়ে উঠেছে।
এছাড়াও, এই সম্মেলনের পেছনে স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তাও নিহিত ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাজনে বন উজাড়ের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্রাজিল ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল। প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা কপ ৩০– এর আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্বকে এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, ব্রাজিল এখন আর সমস্যা নয়— বরং আমাজন সংরক্ষণ ও বৈশ্বিক জলবায়ু নেতৃত্বে একটি দায়িত্বশীল ও সক্রিয় অংশীদার হিসেবে ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত।
তবে নিঃসন্দেহে হতাশাজনক বিষয় হলো— বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ ৩০ সম্মেলনকে অনেক বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদী ইতোমধ্যেই “চরম ব্যর্থতা” হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। “ফরেস্ট কপ” কিংবা “আমাজন বাঁচানোর সম্মেলন” নামে প্রচার করা হলেও, বাস্তবে এই সম্মেলন কোনো বড়ো ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। বরং উচ্চ প্রত্যাশার বিপরীতে এটি শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতির দায় এড়ানোর এক ক্লাসিক উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্মেলনের সবচেয়ে বড়ো বিতর্কের বিষয় ছিল জীবাশ্ম জ্বালানি— কয়লা, তেল ও গ্যাস— ব্যবহার বন্ধের সময়সীমা নির্ধারণ। গত দুই বছর ধরে এই ইস্যুটি আন্তর্জাতিক জলবায়ু আলোচনার কেন্দ্রে থাকলেও, কপ ৩০– এর চূড়ান্ত ঘোষণাপত্রে ‘ফসিল ফুয়েল’ শব্দটি সরাসরি উল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি। সৌদি আরব, রাশিয়া এবং ভারতের মতো বড়ো জ্বালানি উৎপাদনকারী ও ব্যবহারকারী দেশগুলোর চাপের মুখে এই বিষয়টি সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো— এই ধরনের কূটনৈতিক কৌশল আসলে কাকে সন্তুষ্ট করার জন্য? বিশ্বজুড়ে কার্বন-লর্ডদের খুশি রাখা গেলেও, প্রকৃতি কি সত্যিই এতে উপকৃত হবে?
আরেকটি বড়ো ব্যর্থতা হলো— আমাজনের মতো একটি বৈশ্বিক পরিবেশগত সংকটের কেন্দ্রে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে কোনো বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি করা হয়নি। এর পরিবর্তে দেশগুলো কেবল কিছু ‘স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা আমাজনের মতো সংবেদনশীল ও সংকটাপন্ন অঞ্চলের সুরক্ষার জন্য একেবারেই অপর্যাপ্ত বলে মনে করেন জলবায়ু বিজ্ঞানীরা।
আরও একটি অকাট্য প্রমাণ এই সত্যই তুলে ধরে যে, কপ ৩০ সম্মেলনটি কার্যত ছিল এক ধরনের দায়সারা আয়োজন। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের থাকার জন্য বেলেম শহরে পর্যাপ্ত হোটেল সুবিধা না থাকায় কর্তৃপক্ষকে ব্যবহার করতে হয়েছে বিশালাকার ক্রুজ শিপ। সবচেয়ে বড় আইরনি হলো— এই ক্রুজ শিপগুলো নিজেরাই পরিবেশের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। জলবায়ু রক্ষার সম্মেলনে এমন পরিবেশ-ধ্বংসী অবকাঠামোর ব্যবহার আয়োজনের পরিকল্পনাগত ব্যর্থতাকেই প্রকাশ করে।
অব্যবস্থাপনা, এখানেই শেষ নয়। সম্মেলনের শেষ দিনে চূড়ান্ত আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পদ্ধতিগত ত্রুটি এবং তীব্র বাকবিতণ্ডার কারণে কলম্বিয়া ও পানামার মতো দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি তোলে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সম্মেলনটি কার্যত ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এর পাশাপাশি ভেন্যুর কাছাকাছি অগ্নিকাণ্ড, চরম তাপপ্রবাহ এবং নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ প্রতিনিধিদের কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে— যা একটি বৈশ্বিক সম্মেলনের জন্য অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য।
সবচেয়ে বড়ো অসম্মানটি করা হয়েছে সেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গেই, যাদের ঘিরে এই সম্মেলনের প্রতীকী বয়ান তৈরি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এটি হবে একটি “জনগণের সম্মেলন”। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রায় ১,৬০০ জন জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্ট— বড়ো বড়ো কোম্পানির প্রতিনিধি—মূল আলোচনাকক্ষে (Blue Zone) প্রবেশাধিকার পেলেও, সেখানে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ৩৫০ জন আদিবাসী প্রতিনিধি। অর্থাৎ, যাদের ভূমি, জীবন ও ভবিষ্যৎ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে— তাদেরই মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে পরিকল্পিতভাবে দূরে রাখা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, জলবায়ু ন্যায়বিচারের মতো একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও মৌলিক বিষয়ও কপ ৩০– এ কার্যত উপেক্ষিত থেকেছে। উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ১ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের যে রোডম্যাপের কথা বলেছিল, তার কোনো সুস্পষ্ট বাস্তবায়ন পরিকল্পনা কিংবা অর্থের নির্ভরযোগ্য উৎস নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশসহ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো যে আবারও বঞ্চিত হবে— তা নিয়ে সন্দেহের খুব বেশি অবকাশ নেই।
জলবায়ু ন্যায়বিচার (Climate Justice)-এর মূল বক্তব্য খুব স্পষ্ট— যারা বৈশ্বিক দূষণে সবচেয়ে কম অবদান রাখছে, অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা। এই বাস্তবতার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ বাংলাদেশ। বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৪৮ থেকে ০.৫৬ শতাংশ। অথচ জার্মানওয়াচের গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে অন্যতম। অর্থাৎ, যে সংকট তৈরিতে আমাদের দায় প্রায় নেই বললেই চলে, তার সবচেয়ে বড়ো মূল্য আমাদেরই দিতে হচ্ছে।
২০২৪–২০২৫ সালের বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের তথ্য এই বাস্তবতাকে আরও নির্মমভাবে তুলে ধরে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের জিডিপি প্রতিবছর গড়ে ১ থেকে ২ শতাংশ হ্রাস পাচ্ছে; চরম বন্যার ক্ষেত্রে এই ক্ষতি বেড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
ল্যানচেট কাউন্টডাউন ২০২৫ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালে অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ ও চরম গরমের কারণে বাংলাদেশ প্রায় ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে— যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। এর সবচেয়ে বড়ো ভুক্তভোগী কৃষি শ্রমিক ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী।
একই সঙ্গে, উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ১০.৫ লাখ হেক্টর কৃষিজমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়েছে, যার ফলে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩৫ লাখ টন শস্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এই পরিসংখ্যানগুলো স্পষ্ট করে বলে— জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতের কোনো আশঙ্কা নয়; এটি একটি চলমান অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক সংকট।
তাহলে প্রশ্ন হলো— বাংলাদেশের প্রাপ্য আসলে কতখানি? অ্যাকশনএইড-এর ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলোর ঐতিহাসিক কার্বন নিঃসরণের দায় বিবেচনায় বাংলাদেশের ন্যায্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ প্রায় ৫.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, বাংলাদেশের নিজস্ব ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান (NAP) অনুযায়ী, ২০৫০ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বছরে প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। বাস্তবতা হলো— আন্তর্জাতিক জলবায়ুঅর্থায়ন থেকে বাংলাদেশ বছরে পাচ্ছে মাত্র প্রায় ০.৪ বিলিয়ন ডলার, তাও প্রধানত ঋণ হিসেবে।
এতে ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, বরং ঋণের বোঝা আরও বাড়ছে। অথচ জলবায়ু ন্যায়বিচারের মূল নীতিই ছিল— এই সহায়তা হতে হবে অনুদান (grant), ঋণ নয়।
এই প্রেক্ষাপটে পোটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চ-এর পরিচালক জোহান রকস্ট্রমের মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার ভাষায়, “বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, কপ ৩০ একটি চরম ব্যর্থতা।” কারণ পৃথিবী যখন দ্রুত জলবায়ু বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বিশ্বনেতারা কার্যকর সিদ্ধান্তের বদলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার রাজনীতিতেই ব্যস্ত। এর পরিণতি হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় নিজের অবস্থান আরও শক্ত করবে— কিন্তু প্রাপ্তির খাতায়, বরাবরের মতোই, বাংলাদেশের অংশ থেকে যাবে প্রায় শূন্য।
।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।।