অ্যান্টিবায়োটিকসের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি
এমন একটি পৃথিবী কল্পনা করুন তো যেখানে সামান্য নিউমোনিয়া বা ছোট্ট একটা ক্ষত আপনার প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। এটি অবাস্তব বলে মনে হলেও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) খুব নীরবে বিশ্বব্যাপী এই পরিস্থিতি তৈরি করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী ২০১৯ সালে এএমআর সংক্রমণের ফলে ১.২৭ মিলিয়ন মানুষের সরাসরি মৃত্যু ঘটে এবং আরও পাঁচ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। যদি পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকে তাহলে ২০৫০ সাল থেকে প্রতি বছর ১ কোটি মানুষ জীবন হারাবে শুধু ওষুধ কাজ না করার কারণে। ভয়ংকর এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি অত্যন্ত অপর্যাপ্ত।
প্রস্তুতি কেন এত জরুরি
বিজ্ঞাপন
বিশ্বের প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ পেনিসিলিনের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার ফ্লেমিংই বলেছিলেন যে একদিন জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে এবং তা থেকে ভয়াবহ বিপদ হতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক, যা দশকের পর দশক ধরে লাখ লাখ মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবন বাঁচিয়েছে কিন্তু এখন তাদের কার্যকারিতা হারাচ্ছে। এই ওষুধকে ভুলভাবে ব্যবহার করার ফলে এটি ওই অণুজীবগুলোকে শক্তিশালী করে দিয়েছে এবং ওই অ্যান্টিবায়োটিকে আর কাজ হয় না। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রতি ছয়টি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের মধ্যে একটি ইতোমধ্যেই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী। আফ্রিকায় এই সংখ্যা বেড়ে প্রতি পাঁচটির মধ্যে একটিতে পৌঁছেছে।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন রোগ যেমন– যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ: সকল ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। তবে সমস্যাটি কেবল ক্লিনিক্যাল নয়, বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা ড. ফিলিপ ভাজের অনুমান হলো অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রতি বছর ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হতে পারে এবং প্রায় ২৮ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে। কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া অস্ত্রোপচার, ক্যান্সারের চিকিৎসা এবং প্রতিস্থাপন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটি একটি ঐতিহাসিক বিপর্যয় এবং আমাদের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সমস্ত অর্জনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
মনে রাখা দরকার যে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধের কোনো সীমানা নেই। কোভিড ১৯-এর মতো, এটি সব আর্থসামাজিক অবস্থা বা বয়সের মানুষের জন্য হুমকি। তাছাড়া এটি কেবল মানুষের স্বাস্থ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রভাব কৃষি, খাদ্য উৎপাদন এবং পরিবেশেও বিদ্যমান।
জাতিসংঘে বিশ্বনেতাদের পদক্ষেপ
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বিশ্ব নেতারা এএমআর নিয়ন্ত্রণের একটি উচ্চাভিলাষী ঘোষণা দেন। এই ঘোষণায় রয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে এএমআর থেকে মৃত্যু ১০ শতাংশ কমানো, বিশ্বব্যাপী নজরদারি নিশ্চিত করা এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের যুক্তিসংগত ব্যবহার। এতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চমানের নজরদারি তথ্য উপস্থাপন করতে হবে; ৮০ শতাংশ দেশ যাতে সমস্ত ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগজীবাণু পরীক্ষা করে, তা নিশ্চিত করা এবং কৃষিতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের বিশ্বব্যাপী ব্যবহার হ্রাস করা।
বাংলাদেশের অবস্থা ও প্রস্তুতি
আইইডিসিআর ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে ‘জাতীয় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) সার্ভিলেন্স’ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। এর লক্ষ্য হলো, বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের (এএমআর) অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। গত ২৪ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে আইইডিসিআর জানায়, দেশের পাঁচটি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীদের শরীরে ৭১ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৪১ শতাংশের ক্ষেত্রে কোনো ওষুধ কাজ করছে না। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত সারা দেশে মোট যত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়েছে, তার ৫৭ শতাংশই হয়েছে ঢাকায়। ঢাকার পরের অবস্থানে রয়েছে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রংপুর ও সিলেট।
বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন
অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে একমাত্র আইন হলো– ওষুধ ও কসমেটিকস আইন, ২০২৩। এই আইনের ৪০ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্য কোনো ওষুধ বিক্রি দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে এর দণ্ড অত্যন্ত লঘু। এই ধারার লঙ্ঘনে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিলের শাস্তির বিধান রয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় এই সামান্য শাস্তির ভয়ে মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি থেকে বিরত থাকছে না। এ ছাড়াও সারা দেশে যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হলেও এ কারণে এখন পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। অর্থাৎ এ আইনের প্রয়োগ অত্যন্ত দুর্বল, এ কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুটি পদক্ষেপের ওপরে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমটি হলো– অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে একটি শক্তিশালী নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। দ্বিতীয়টি হলো– এই ভয়াবহতা সম্পর্কে দেশব্যাপী মানুষকে সচেতন করা। মানুষ যেন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করে তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক ক্রয় কঠিন দণ্ডনীয় অপরাধ। এএমআর-এর ভয়াবহতা রোধে ইংল্যান্ড, ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে এএমআরকে খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা, মানবদেহে, পশুপাখি, কৃষিতে এর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও ২০৪০ সালের মধ্যে এএমআর-এর সংক্রমণ অন্তত ১০ শতাংশ কমিয়ে ফেলা। এসব পরিকল্পনার আদলে বাংলাদেশের শক্তিশালী আইন ও নীতিমালা করার এখনই উপযুক্ত সময়।
মানুষের আবিষ্কৃত সব অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে গেলে আমরা এমন এক যুগে ফিরে যাব যেখানে যেকোনো রোগেই মানুষ মৃত্যুবরণ করবে এবং যেকোনো রোগই মহামারি বা অতিমারিতে রূপ নেবে। এই ভয়াবহ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের আরও নজরদারি বাড়াতে হবে, শক্তিশালী আইন তৈরি ও কঠোর প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে অ্যান্টিবায়োটিকসের ভয়ংকর রূপ।
অরুপ রতন সাহা : সহকারী অধ্যাপক, আইন ও মানবাধিকার, আরপি সাহা ইউনিভার্সিটি এবং সহকারী অধ্যাপক (অ্যাডজাঙ্কট), আইন ও বিচার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়