আজ সকাল ৬টার দিকে এভারকেয়ার হাসপাতালে বেগম খালেদা জিয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবসান হলো একটি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের। বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছেন। যারা শোক প্রকাশ করতে গিয়ে তার সম্পর্কে দু-একটি কথা বলছেন, তাদের প্রায় সবাই তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে উল্লেখ করছেন। এটি তার প্রধান রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবেও গণ্য করছেন। মূলত বেগম খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে সবসময় স্মরণ করা হবে।

তাকে আপসহীন নেত্রী বলা শুরু হয় ১৯৮৬ সাল থেকে, যখন তিন জোটের সিদ্ধান্তের বিপরীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সামরিক শাসক এরশাদের অধীনে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, আর বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে কার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, সেটা নিয়ে এখনও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা তর্ক করেন বটে; কিন্তু সেই সময়ে বেগম খালেদা জিয়ার এই সিদ্ধান্ত তাকে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এর সুফল তিনি পেয়েছিলেন ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে। সেই নির্বাচনে তার দল বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি বিবেচনায় দেশের বেশিরভাগ বিশ্লেষক মনে করেছিলেন যে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন না, সবাই ভেবেছিলেন আওয়ামী লীগই জিতে যাবে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি।

আপসহীন নেত্রী অভিধার আড়ালে বেগম খালেদা জিয়ার একটি ইতিবাচক দিক চাপা পড়ে যায়—তিনি আপসহীন ছিলেন বটে, কিন্তু গোঁয়ার মোটেই ছিলেন না। আমাদের ইতিহাসে বেশ কয়েকবার তিনি আপস করেছেন; তবে সেই আপস ছিল দেশের কল্যাণে এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের উত্তরণের স্বার্থে। তার প্রথম আপস ছিল সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী, যার মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন করা হয়। আরেকটি আপসের কথা তো আমরা সবাই জানি—নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন। এছাড়া আরেকটি আপসের ঘটনার কথা এখানে বলছি, যেটা এমনিতে ছোটখাটো মনে হতে পারে কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সেটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

আপনাদের মনে থাকার কথা, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনটি জোট যুগপৎ আন্দোলন পরিচালনা করছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলীয় জোট (যা পরে আট দলীয় জোটে পরিণত হয়), বিএনপির নেতৃত্বে সাত দলীয় জোট এবং বাম দলগুলোর পাঁচ দলীয় জোট। এই আন্দোলনের ফলে সেনাশাসক এরশাদের পতন হয়। সবাই সম্মত হন যে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে এবং তিনি অনতিবিলম্বে একটি সাধারণ নির্বাচন দেবেন। সংবিধানে তখন রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদও রাজি হলেন একটি শর্তে—নির্বাচনের পর তাকে আবার তার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরিয়ে নিতে হবে। সবাই রাজি হলেন। শর্ত অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলেন, তার জায়গায় নিযুক্ত হলেন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন। তারপর পদত্যাগ করলেন এরশাদ। ব্যাস শাহাবুদ্দিন আহমেদ রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেন, নির্বাচন দিলেন এবং সেই নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হলেন খালেদা জিয়া। 

এরপর শাহাবুদ্দিন আহমেদ তাড়া দিচ্ছিলেন প্রধান বিচারপতি পদে ফেরত যাওয়ার জন্য। তখন বেগম খালেদা জিয়ার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। প্রথমত, তিনি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার চালিয়ে যেতে পারতেন। সেই সময় শেখ হাসিনার তুলনায় বেগম জিয়া ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় এগিয়ে ছিলেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দিলে তিনিই হতেন রাষ্ট্রপতি এবং পুরো সরকার হতো তার অধীন। দ্বিতীয় বিকল্প ছিল সংসদীয় সরকারে ফেরত যাওয়া, যার জন্য প্রয়োজন ছিল সংবিধান সংশোধন।

আওয়ামী লীগ নীতিগতভাবে সংসদীয় সরকারের পক্ষে, ৭২-এর সংবিধানে তাই ছিল। অন্যদিকে, বিএনপির নীতি ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পক্ষে। সংসদীয় পদ্ধতিতে গেলে জিয়াউর রহমানের নীতি থেকে সরে যাওয়া হয়। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আওয়ামী লীগের প্রস্তাব গ্রহণ করবেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংসদে একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী পাস হয়। এটি ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। দেশের ইতিহাসে সরকারি দল ও বিরোধী দল মিলেমিশে সংবিধান সংশোধন করার ঘটনা আর সম্ভবত ঘটেনি। দেশে গণতন্ত্রে উত্তরণের স্বার্থে তিনি দলীয় নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপস করে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমনকি আজকের চরম বৈরিতার মধ্যেও আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা গণতন্ত্রে উত্তরণে বেগম খালেদা জিয়ার এই সিদ্ধান্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছিল, শুরুতে বেগম খালেদা জিয়া তা সমর্থন করেননি। কিন্তু তিনি তার অবস্থানে গোঁয়ারের মতো স্থির থাকেননি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই ব্যবস্থা গণতন্ত্রের জন্য জরুরি। ফলে ছিয়ানব্বইয়ের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর তিনি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।

সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুতর বিষয় না হলেও, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বিচারক নিয়োগের প্রশ্নে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ আপস করেছিলেন। সংবিধানে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ গ্রহণ করা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের সঙ্গে আলোচনা না করেই কিছু নাম প্রস্তাব করে। এতে সুপ্রিম কোর্ট বারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের আপত্তি ছিল। ড. কামাল হোসেন, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ও শামসুল হকের মতো নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আইনমন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজ। বারের নেতারা প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, বিচারপতি নিয়োগের আগে আপনার প্রয়োজন ছিল প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করা। প্রধানমন্ত্রী আইনমন্ত্রীকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। আইনমন্ত্রী বললেন, ‘না, আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই, তবে একটা প্রথা প্রচলিত আছে।’ খালেদা জিয়া বারের নেতাদের বললেন, তিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলাপ করে তবেই নিয়োগ চূড়ান্ত করবেন, এর আগে কোনো নিয়োগ হবে না। পরে তিনি নিজের পছন্দের কিছু নাম বাদ দিয়ে প্রধান বিচারপতির প্রস্তাবিত নামগুলো গ্রহণ করেন। এই ছোট আপসটি বিচার বিভাগে স্বৈরাচারের সুযোগ কিছুটা হলেও বন্ধ করেছিল।

বেগম খালেদা জিয়া আজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তার জীবন থেকে আমরা যেমন আপসহীনতা শিখেছি, তেমনি এটাও শিখেছি যে আপসহীনতা মানে গোঁয়ার্তুমি নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সঠিক সময়ে সঠিক প্রশ্নে আপস করতে না পারলে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয় এবং গণতন্ত্র বিঘ্নিত হয়। একজন গৃহবধূ থেকে আসা সাধারণ একজন মানুষ, যিনি খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি, তিনিও রাজনীতির এই গভীর সত্যটি বুঝতে পেরেছিলেন। এই শিক্ষাটি যেন আমরা ভুলে না যাই। আমরা তাকে আপসহীন নেত্রী বলবো ঠিকই, কিন্তু তার জীবনের সেই ‘সমঝোতার শিল্প’ যা তিনি রাষ্ট্রের স্বার্থে প্রয়োগ করেছিলেন, তা-ও যেন আমাদের স্মরণে থাকে।

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতির সমর্থক হওয়া আপনার জন্য জরুরি নয়। কিন্তু তার ঘোর বিরোধী হয়েও কেন তাকে আমরা শ্রদ্ধা করবো? কারণ, একজন আপসহীন নেতা হয়েও বৃহত্তর স্বার্থে কীভাবে ‘আপস’ নামক রাজনৈতিক কলাটি প্রয়োগ করতে হয়, সেই শিক্ষাটি তার জীবন থেকে নেওয়া যায়।

ইমতিয়াজ আহমেদ, অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট