অর্থে-বিত্তে গরিব এইরকম কেউ যদি হঠাৎ জ্যাকপট বা লটারি জিতে কোটিপতি হয়ে যায়, তাহলে কী হবে? এত টাকা কীভাবে খরচ করবে, কোথায় রাখবে, কাকে দেবে তা ভেবে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আজীবন গরিব হওয়ার কারণে মানুষের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য পেয়ে আসা মানুষ যখন হঠাৎ জ্যাকপট পায় তখন সে যে আর গরিবের দলে নেই সেইটা দেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এর ফলে ভুল করার সম্ভাবনা তৈরি হয়, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যা খুবই স্বাভাবিক।

গরিব কেবল অর্থ-বিত্ত কম থাকার কারণেই হয় তা কিন্তু না, জ্ঞান-বুদ্ধি কম থাকাটা আরও বড় গরিবি। জ্ঞান-বুদ্ধিতে গরিব এমন কেউ যদি কারো দান দক্ষিণায় হঠাৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ পেয়ে যায় তাহলেও তার মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশে এখন দুটোই হচ্ছে। অর্থাৎ যে অযোগ্য, সে সেইটা পেয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ভিসি পদটা এখন এভাবেই দেওয়া হয়।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় মানে অনেক বড় কিছু। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এইটা বিশাল। কারণ আমার জানা মতে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসিদের মতো ক্ষমতা পৃথিবীর আর কোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির নেই। যেহেতু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সকল ক্ষমতা একজন ভিসির মাঝে কেন্দ্রীভূত, সেহেতু ভিসি নিয়োগে আমাদের আরও অনেক মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু হয়েছে উল্টো।

সম্প্রতি দেশের ১১ জন ভিসির দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে, যাদের এই বিশাল ক্ষমতাকে ধারণ করার যথেষ্ট জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সততা ও ব্যক্তিত্ব ছিল না। তারা ভিসি পদটি অর্জন করেননি বরং জ্যাকপট পাওয়ার মতো ভিসি হয়েছেন। এই যে ক্ষমতা আর অযোগ্যতার বিশাল ফারাক, এটাই সকল সমস্যার মূল।

এত ক্ষমতা কীভাবে ডিসচার্জ করতে হয় তা তারা জানেন না। আবার একই সাথে জানার চেষ্টাও করেন না। ভিসি হওয়ার পর তাদের একটাই মিশন। সেটি হলো নিয়োগ কর্তা ও তাদের দল এবং দলীয় লোকদের কীভাবে সার্ভ করা যায় সেইদিকে পুরো মনোযোগ রাখা।

ভিসি হওয়ার পর তাদের একটাই মিশন। সেটি হলো নিয়োগ কর্তা ও তাদের দল এবং দলীয় লোকদের কীভাবে সার্ভ করা যায় সেইদিকে পুরো মনোযোগ রাখা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহান তার শেষ কর্মদিবসেও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিশাল জনবল নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আগামী অন্তত ৩০ বছরের জন্য কিছু জঞ্জাল রেখে গেলেন।  

পুরো মেয়াদ জুড়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি করে নিজের মেয়ের জামাইকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য যোগ্যতা শিথিল পর্যন্ত করেছেন। এমনকি একজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন যে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হওয়ারই যোগ্য ছিল না। তার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে পোষ্য কোটায় ভর্তি হয়েছেন। তারপর আবার যে প্রথম বিভাগে পাস করেননি, উল্টো যে ১৪ জন শিক্ষার্থী দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছিলেন সেখানেও তার অবস্থান ১০-এ। এখানেই শেষ না। আবার তিনিই তার বিভাগে একমাত্র শিক্ষার্থী যে কি না অনার্সের একটি কোর্সে ফেল করেছেন।

মজার বিষয় হলো, এই শিক্ষার্থী অনার্সে ফলাফল খারাপ করায় মাস্টার্সে থিসিস গ্রুপে যাওয়ারই সুযোগ পাননি। এইরকম একজনকে  উপাচার্য এম আবদুস সোবহান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। অধ্যাপক সোবহান গত ৬ মে যে ১১ জন শিক্ষককে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে গেছেন, তাদেরই একজন হলেন এই ইন্দ্রনীল মিশ্র। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদভুক্ত ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন।

শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় না। সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার শিকার হন। ভিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকাকে নিয়ম বানিয়ে ফেলেছিলেন অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ। বর্তমান অনলাইন ক্লাসের মতো ঢাকায় বসেই রংপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদের দায়িত্ব সেরে ফেলেছেন। 

এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা কোনো না কোনো কারণে কোনো না কোনো সময় মিডিয়াতে নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। এর কারণ হলো ক্ষমতা এবং যোগ্যতার বিশাল ফারাক। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর কোথাও ভিসিরা সংবাদমাধ্যমে আসেন না।

খোঁজ নিয়ে দেখবেন, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, এমআইটি বা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী তাদের ভিসির নামই কখনো শোনেনি। কারণ উপাচার্যরা প্রশাসনিক কাজ করেন। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে তাদের সরাসরি কোনো ভূমিকা নেই। শিক্ষক নিয়োগে মূলত যেই বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ হবে সেই বিষয়ের শিক্ষক এবং ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি রাখা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসিকে ধরে নেওয়া হয় শিক্ষা, জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞায় অতুলনীয়। সম্ভাব্য এইরকম একজন মানুষকে মাপবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা? এইটা কি কল্পনা করা যায়?

যেমন কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ কমিটির সদস্য ছিলেন আমার এক ছাত্র। তিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি। সেই কমিটিতে অন্য যারা ছিলেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বিভাগীয় প্রধান, বিভাগের যে বিষয়ে অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল সেই বিষয়ের একই বিভাগের ২ জন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক, বিভাগের বিষয়ের কাছাকাছি এমন বিষয়ের অন্য বিভাগের একই বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন শিক্ষক। নিজ বিভাগের অন্য একজন অধ্যাপক যার সাথে যেই বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ হবে সেই বিষয়ের সাথে তার গবেষণার মিল খুবই কম। এই শেষোক্ত সিনিয়র অধ্যাপককে মনোনীত করা হয় মূলত নিয়োগের মান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। 

আমাদের সকল বিভাগের সকল নিয়োগ বোর্ডে উপাচার্য কিংবা প্রো-উপাচার্য থাকবেনই। যেই বোর্ডে উপাচার্য থাকেন সেখানে অন্যদের মতামত কতটা গুরুত্ব পাবে সেটা বলাই বাহুল্য। এটাই উপাচার্য নির্বাচনে রাজনীতিকরণের সবচেয়ে বড় কারণ। সরকার বুঝে গেছে এই একজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসিকে ধরে নেওয়া হয় শিক্ষা, জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞায় অতুলনীয়। সম্ভাব্য এইরকম একজন মানুষকে মাপবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা? এইটা কি কল্পনা করা যায়? সারা বিশ্বে ভিসি নিয়োগের জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি সার্চ কমিটি করা হয়, যার সদস্য হন আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক এবং পণ্ডিত ব্যক্তি। যারা সম্ভাব্য ভিসিদের কাছ থেকে একটি করে সিভি চাইবেন, ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়কে কিভাবে গড়বেন তার একটি স্টেটমেন্ট চাইবেন এবং অবশ্যই সম্ভাব্য প্রার্থীদের গবেষক হিসেবে উচ্চমান সম্পন্ন হতে হবে।

আমাদের ৪৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের কতজনের গুগল স্কলারে তাদের গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা, সাইটেশন সংখ্যা, h-ইনডেক্স ইত্যাদি আছে? খোঁজ নিলে দেখা যাবে বড়জোর কয়েকজনের ক্ষেত্রে এসব পাওয়া যাবে। যারা নিজে গবেষক না তারা অন্যদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করবেন কীভাবে? কীভাবে শিক্ষকদের গবেষণা করতে বলবেন?

সরকার যদি সত্যি সত্যি আমাদের উচ্চশিক্ষার মানের উন্নতি চায় তাহলে উচিত সত্যিকারের স্কলারদের নিয়োগ দেওয়া। এই কথা বললে অনেকেই পাল্টা যুক্তি দেয় আমাদের দেশের বাস্তবতায় কেবল ভালো শিক্ষক এবং গবেষকদের নিয়োগ দিলে প্রশাসন চালাতে পারবেন না। কারণ, এইখানে ছাত্রনেতা, শিক্ষক নেতা, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নেতা ও নানা সংগঠনের আন্দোলন ইত্যাদি ম্যানেজ করতে হয়।

এখন সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে রাজনীতি ইঞ্জেক্ট করে সমস্যা সৃষ্টি করবে, আবার সেই সমস্যার অজুহাত দিয়ে ভালো শিক্ষক এবং গবেষককে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিদেন না। বাহ্! আসল সমস্যা হলো আমাদের জনগণ ভালো সরকার নির্বাচিত করে না, সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভালো প্রশাসক নিয়োগ দেয় না, প্রশাসকরা ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেয় না, শিক্ষকরা ভালো জনগণ তৈরি করে না। এই দুষ্ট চক্রেই আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে আছে প্রাণের বাংলাদেশ।


ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়