জনস্বাস্থ্যের দিক দিয়ে বাংলাদেশ একটা ভয়াবহ সময় অতিক্রম করছে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল। এই ঘোর সংকট অতিক্রম এবং ভবিষ্যতে এমন দশায় আবারও পুনঃপতন থেকে রেহাই পেতে চাইলে দরকার কিছু জাতিগত আত্ম উপলব্ধির। যে প্রক্রিয়ায় আমরা এই মহামারির নতুন ঢেউয়ের শিকার হলাম, তার চাইতে ভালো বিবরণ মিলবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষুদ্র একটা বিদ্রূপাত্মক কবিতাতে—
‘বজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ
আমার গর্জনে বলে মেঘের গর্জন,
বিদ্যুতের জ্যোতি বলি মোর জ্যোতি রটে,
মাথায় পড়িলে তবে বলে—বজ্র বটে!’ (কণিকা / প্রত্যক্ষ প্রমাণ)

আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অর্থাৎ জনগণের স্বাস্থ্যের বিষয়টাকে যারা দেখভাল করেন, তাদের এর চাইতে ভালো বিবরণ কোথায় মিলবে? তাদের কাছ থেকে আমরা সর্বদা শুনে এসেছি, সব ঠিক আছে, টিকা তৈরি আছে, যত টিকা লাগবে তত টিকা কেনা হবে, চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছি, নার্স আসছে, অতগুলো বেড করোনা বেডে রূপান্তরিত করেছি। কিন্তু কখনোই আমরা ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে শুনতে পাইনি এই আলাপ, ঠিক কি প্রস্তুতি দরকার? ঠিক কোথায় কত ঘাটতি? যা আছে বা যা হচ্ছে, তা অপ্রতুল কি না?

বলা যায়, আজকে আমরা যে দশায় পৌঁছেছি, তার নীতিগত দায়দায়িত্ব বাংলাদেশের শাসকদের, কিন্তু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষদেরই এর পুরোটা দায় বহন করতে হচ্ছে। প্রতিদিনের মৃত্যু, যন্ত্রণা এবং ছুটোছুটির যে চিত্র আমরা দেখছি, তা ভয়াবহ। এর চাইতে কম ভয়াবহ নয় মহামারি কালের বেকারত্ব, অনিশ্চয়তা, ক্ষুধা ও উদ্বেগ।

ফলত, সব ঠিক আছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে যারা আত্মপ্রসাদে ভুগেছিলেন, তারা আজও যদি কার্যকর কোনো বাধা বা প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়েই চালিয়ে যেতে পারেন, করোনার মহামারি আপন গতিতেই তার ক্ষয়ক্ষতি চালাবে। ভবিষ্যতেও এমন সকল গর্তেই আমাদের পতন হবে। প্রস্তুতি বলে কোনো কিছু আমাদের থাকবে না।

এটা সত্য যে, করোনা সামলাবার অভিজ্ঞতা কোনো দেশেরই ছিল না। ফলে ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, চীনের মতো আরও কিছু উদাহরণ বাদ দিলে বাকি গোটা দুনিয়াই বলতে গেলে ঠেকে ঠেকেই করোনা মোকাবিলা শিখেছে। কিন্তু কেউ কেউ আছেন, তারা ঠেকেও শিখতে রাজি না। বিশেষ করে উপমহাদেশের দুই প্রতিবেশীর দম্ভের উদাহরণ দেওয়া যায়। এ বছরের ২৮ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বক্তৃতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বেশ গর্ব নিয়েই জানালেন যে, বিশেষজ্ঞদের অনুমান ব্যর্থ হয়েছে।

আজকে আমরা যে দশায় পৌঁছেছি, তার নীতিগত দায়দায়িত্ব বাংলাদেশের শাসকদের, কিন্তু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষদেরই এর পুরোটা দায় বহন করতে হচ্ছে।

ভারত করোনাকে পরাস্ত করে গোটা দুনিয়াকে রক্ষা করেছে করোনার বিপদ থেকে। শুধু এটুকুই নয়, ভারতে এরপর অনুষ্ঠিত হলো কুম্ভ মেলা। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনে বিজেপির বিজয় নিশ্চিত করতে ৮ ধাপে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলো সকল প্রতিবাদ সত্ত্বেও, যাতে মোদি এবং অমিত শাহ বারবার এসে সবগুলো অঞ্চলে সভা-সমাবেশ-জনসংযোগ করতে পারেন। ফলাফল ভারতের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বিশেষজ্ঞদের অনুমান সঠিক প্রমাণ করে ভারতে করোনাতে ‘সরকারিভাবে’ এ পর্যন্ত ৪ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, প্রকৃত সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হওয়ারই সম্ভাবনা আছে।

শাসকদের মিথ্যা অহমিকা, কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতা, দলীয় স্বার্থকে জাতীয় রাজনীতির চাইতে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার ফলাফলটা এভাবে জনগণকেই মূলত ভোগ করতে হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের মাঝে গোড়া শাসক বলে পরিচিত যোগী আদিত্য নাথের রাজ্যে অজস্র মানুষের মৃতদেহের সৎকারও করা যায়নি বলে সেগুলোকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বড় নৌকা যেদিকে যায়, ছোট নৌকাও সেদিকেই ধায়। নরেন্দ্র মোদির এই করোনা জয়ের অহমিকা আমরা বাংলাদেশেও দেখেছি। যেভাবেই হোক, করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আগের ধরনগুলো বাংলাদেশে ব্যাপক হারে বিস্তার লাভ করেনি। কোনো গবেষণা হয়নি কীভাবে, কেন সেটা সীমিত থেকেছে। কিন্তু করোনা রোধে অতি সীমিত বা বলা চলে ন্যূনতম বন্দোবস্ত করেই এই মৃত্যুর হার কম থাকাকে একটা অতিকায় সাফল্য হিসেবে দেখানো হয়েছে দৈনিক পত্রিকায়, টেলিভিশনের টক শো’তে। মোসাহেবরা শত মুখে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ করোনা রোধে একটা বিশ্বের বিস্ময়।

কর্মফল তার পাওনা চুকিয়ে নিতে আমাদের সামনে হাজির হয়েছি কি না, আমরা জানি না। পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। প্রতিদিনই ঘনিষ্ঠজনদের আক্রান্ত হওয়ার ও মৃত্যুর সংবাদ পাচ্ছি। আবার, সত্যিই এমনও হতে পারে যে প্রতিবেশী দেশটিরও তুলনায় অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি করেই এ দফার করোনাও বিদায় নেবে। যদিও এটাতে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশে যতগুলো করোনার প্রকোপ দেখা দিয়েছে, তার মধ্যেএবারের সংক্রমণের ধরন ও মাত্রা বহুগুণ বেশি। এটা প্রধানত কেবল পর্যবেক্ষণ থেকেই বলতে হচ্ছে, এগুলো নিয়ে সত্যিকারের কোনো কার্যকর ও প্রতিনিধিত্বমূলক গবেষণা ও অনুসন্ধান একদমই হয়নি। এবারেরও যদি আমরা রেহাই পাই, পরেরবারও পাবো, এমন কোনো কথা নেই। পরেরবার খুব দূরে, তাও কেউ বলতে পারছে না। নিত্যনতুন করোনার প্রকরণ দেখা যাচ্ছে দুনিয়া জুড়ে।

মহামারি শুধু স্বাস্থ্যের সমস্যা না। মহামারির অর্থনৈতিক দিকটিও প্রবল। দরিদ্র ও কম আয়ের মানুষদের খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ না নিলে কার্যকর সামাজিক দূরত্ব প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। বরং বলা যায়, সেরকম একটা লকডাউন মানুষ মানবে না এবং এটা বলতে কোনো দ্বিধার কারণ দেখি না যে, মানুষের পেটে ভাতের ব্যবস্থা না করে যেমন কোনো কার্যকর লকডাউন সম্ভব না, তেমনি কোনো লকডাউন আরোপ করার রাজনৈতিক সাধ্যও সরকারের আসলে নেই। এই বিষয়টি উপলব্ধি না করে অনেকেই লকডাউন লঙ্ঘন করবার জন্য মানুষকে দোষারোপ করছেন। আসলে ব্যক্তিগত গাড়িওয়ালা কেউ কেউ যেমন গাড়ির নিরাপদ আড়াল থেকে লকডাউন উপভোগ করতে রাস্তায় নেমে সড়কে যানজট বাধিয়ে দিয়েছেন, তার বিপরীতে লকডাউন ভাঙার দায়ে হাজত খাটা, জরিমানা দেওয়া অধিকাংশ মানুষই আসলে খেটে খাওয়া গরিব লোক।

সামরিক বাহিনী নামিয়েও ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থির মানুষকে ঘরে বেধে রাখা যাবে, এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি ভবিষ্যতে তাই একটা ভয়াবহ দুই মুখী সাপের মতো এগিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে, করোনা সংক্রমণ আরও বাড়লেও ক্ষুধা, দরিদ্র মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করবে। মানুষের রাস্তায় নামা ঠেকাবার সাধ্য নাই বলে সংক্রমণ আরও বাড়বে। সাপের দুটি মাথায় পরস্পরকে আরও বিষধর ও আরও প্রলম্বিত করবে। 

মহামারি শুধু স্বাস্থ্যের সমস্যা না। মহামারির অর্থনৈতিক দিকটিও প্রবল। দরিদ্র ও কম আয়ের মানুষদের খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ না নিলে কার্যকর সামাজিক দূরত্ব প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।

একদিকে এমন একটা পরিস্থিতি তার গভীরতার স্বীকৃতি দাবি করে, একটা তাৎক্ষণিক জাতীয় কর্মসূচি দাবি করে, কীভাবে ঘাড়ের ওপর চলে আসা এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়, সে বিষয়ে একটা সম্মিলিত ভূমিকা জাতীয় ভিত্তিতে কীভাবে নেওয়া যায়, দেশবাসীকে যথাসম্ভব রক্ষা করা যায়। তাৎক্ষণিক এই কাজগুলোর মাঝে অন্যতম হওয়া প্রয়োজন জাতীয় ভিত্তিক একটা করোনা প্রতিরোধ কর্মপরিষদ গঠন, যার নেতৃত্বে থাকবেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ, পরিসংখ্যানবিদ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদরা।

গোটা আমলাতন্ত্র ও প্রশাসন তেমন একটা কর্মপরিষদের অধীনস্থ হয়ে কাজ করলেই কেবল সব চাইতে কম ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে করোনার দুর্যোগ অতিক্রম করা সম্ভব। সেটার পক্ষে প্রধান বাধা এই যে, এটা করা মানে স্বীকার করে নেওয়া যে, এটা একটা যুদ্ধপ্রায় পরিস্থিতি এবং বর্তমান সরকার ও তার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ব্যর্থ হয়েছে জনগণের জীবন ও অর্থনীতির নিরাপত্তা দিতে। সমস্যা সেইখানেই।

প্রয়োজন স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর। যারা বিপদের মুখেও বিপন্ন জনপদগুলোতে সেবা দিতে রাজি আছেন। রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে লকডাউনের মুখে বাড়িতে বাজার পৌঁছে দেওয়া, শুশ্রূষা, সামাজিক দূরত্ব কায়েমে অসচেতন মানুষদের বাধ্য করাটা যাদের দায়িত্বের অংশ হবে।

একই সাথে যেটা করা দরকার সেটা হলো, আমাদের গবেষণার সবটুকু সক্ষমতা ব্যবহার করে কতগুলো প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। এই প্রশ্নের মাঝে অন্যতম হলো, যাদের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তাদের ঝুঁকি কতখানি? তারা কি কাজে নামতে সক্ষম? কতদিন কার্যকর থাকছে সেটা? গণহারে গোটা দেশে বেশ কয়েক দফায় বিবেচনাহীন লকডাউন দিয়ে বলা যায় আমরা জনগণের সকল পুঁজি, সঞ্চয় ও ঋণ করার সামর্থ্যকে ইতিমধ্যেই খরচ করে ফেলেছি। ফলে এই প্রশ্নটা বহু মানুষের জন্যই জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন।

প্রতিবার কি আমরা কেবল আগুন নেভানোর কাজই করব? ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে চাপা পড়া আহত বা নিহতদের বের করে আনাই আমাদের একমাত্র কাজ হবে? নাকি জনস্বাস্থ্যের শক্তিশালী একটা বুনিয়াদ বানাতে চাই আমরা? আমাদের বরং দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশ্নগুলোকে আরও গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনা দরকার।

কেন দুনিয়ার মাঝে আমাদের দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা এত কম? কেন নার্সদের সংখ্যায় আমরা গরিবতম দেশগুলোর চাইতেও পিছিয়ে আছি? কেন আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা গোটাটাই আমলাতন্ত্রের হাতে কুক্ষিগত? কেন উপজেলা পর্যায়ে কোনো আইসিইউ নেই? কেন গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত? নগরের বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠী নয় শুধু, প্রান্তিক/আদিবাসী সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনা নেই কেন? কেন, কীসের অভাবে আমাদের ধনী ও ক্ষমতাবান সম্প্রদায়কে চিকিৎসার জন্য প্রতিবারই বাইরে যেতে হয়?
দীর্ঘমেয়াদের সেই কাজটাই রাজনীতির কাজ, দেশ গড়ার কাজ। জনস্বাস্থ্যবিদ, নিবেদিত চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবী রাজনীতিমনস্ক তরুণরা সেই কাজের অগ্রণী হতে পারবেন। অস্বাস্থ্যকর / অবমাননাকর / অপমানজনক একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতে পারবেন।

ফিরোজ আহমেদ ।। প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং রাজনীতিক