করোনাভাইরাস নতুন হলেও এখন আর নতুন বলা যাচ্ছে না। ২০২০ সালের মার্চে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে পার হয়েছে আরও একটি বছর। করোনা খুব সহসায় চলে যাবে এমন কোনো পূর্বাভাস নেই কারও কাছে। অর্থাৎ, এই করোনাকে সাথে নিয়েই চলতে হবে আমাদের সবার। অথচ এখনো আমরা এই অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবিলায় কোনো সঠিক ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার দেখা পাইনি। একদমই অপরিকল্পিতভাবেই চলছে করোনা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি।

করোনা আসার পর একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমার জানা নেই সেই কমিটি সরকারকে কোনো কার্যপ্রণালি বা রোডম্যাপ যাই বলি না কেন সেটি দিয়েছে কি না। একদিকে জীবিকার লড়াই অন্যদিকে জীবন বাঁচানোর চিন্তা, এই দুইয়ের সমন্বয়ে কেমন করে সামনের দিনে করোনার প্রকোপকে ঠেকানো যাবে সেটি নিয়ে কোনো আলোচনা এখনো আমাদের সামনে আসেনি।

সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রলায়ের কার্যক্রম দেখলে মনে হয় যেন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। করোনা শুরু হওয়ার পরই আমরা জানতে পারলাম স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থার কথা। হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা কতটা সেটিও এখন আমাদের কাছে পরিষ্কার। অথচ এখনো এই সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কী কী করা যেতে পারে নেই সেই কার্যক্রম। 

একদিকে জীবিকার লড়াই অন্যদিকে জীবন বাঁচানোর চিন্তা, এই দুইয়ের সমন্বয়ে কেমন করে সামনের দিনে করোনার প্রকোপকে ঠেকানো যাবে সেটি নিয়ে কোনো আলোচনা এখনো আমাদের সামনে আসেনি।

লকডাউন নিয়েও চলছে সিদ্ধান্তহীনতা। কিছুদিন বলা হচ্ছে কঠোর লকডাউন, আবার বলা হচ্ছে কিছুটা শিথিল থাকবে। কঠোর লকডাউন বলা হলেও খোলা ছিল গার্মেন্টস ও অন্যান্য কলকারখানা। তাহলে সেটি কেমন করে কঠোর লকডাউন হতে পারে? ঈদকে সামনে রেখে একটি বিশাল অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় আমরা জানি। অনেক কৃষক তার সমস্তটা বিনিয়োগ করে গরু/ছাগল লালন পালন করে কেবলমাত্র কোরবানির সময় বিক্রি করে কিছু লাভ করবে বলে। এ সবইতো আমাদের জানা। কোনো কিছুই অজানা নয়। তাহলে লকডাউন দেওয়া বা শিথিল করা সবকিছুর একটা সমন্বয় কেন নেই?

আবার একথাও সত্য যে, ঈদের সময়ে মানুষের চলাফেরাকে আমরা আটকাতে পারছি না। ২০২০-২০২১ সালের মোট তিনটি ঈদে আমরা দেখেছি মানুষের ঢল কেমন করে রাস্তায় নামে। ক্ষুধার্ত মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব নয়। সরকার তার পক্ষ থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করতে।

বিভিন্ন খাত ধরে ঘোষণা করা হচ্ছে প্রণোদনা। কিন্তু এই প্রণোদনার অর্থ বাস্তবে সঠিক মানুষগুলোর হাতে পৌঁছাচ্ছে কি না এই জায়গাটিও স্বচ্ছতার সাথে পরিচালিত করা যাচ্ছে না। গার্মেন্টস খাতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়েছিল সেটির কত ভাগ শ্রমিকের কপালে জুটেছে সেই হিসাবটি কিন্তু এখনো পরিষ্কার না।

করোনাকালীন গার্মেন্টস খাতে ক্ষতির হিসাবটি নিলেই বাস্তবচিত্রটি কিন্তু পরিষ্কার হয়ে যাবে। ক্রেতার সংখ্যা কমেছে না বেড়েছে সেটিও নিশ্চয়ই অজানা নয়। অথচ এই গার্মেন্টস মালিকরা নিজেরা কোনো দায়দায়িত্ব নিতে রাজি না। পরিবহন খাতেও চলছে অপরিকল্পিত কার্যক্রম।

সরকারের একার পক্ষে কখনোই এই বিশাল সংখ্যক মানুষের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। আমাদের সরকারের সেই আর্থিক সক্ষমতা নেই। তার জন্য দরকার ছিল বেসরকারি খাতের মালিকদেরকে উৎসাহিত করা যেন, তারা তাদের নিজ নিজ সেক্টরের মানুষগুলোকে ছাঁটাই না করে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। 

ভ্যাকসিন কোথা থেকে আসবে, কেমন করে আসবে, কখন আসবে বা কতদিনে আমরা সকল মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পারব সেইসব নিয়ে থাকা দরকার ছিল একটি পরিষ্কার দিক নির্দেশনা।

দিনের পর দিন লকডাউন দিয়ে দেশকে বন্ধ রেখে আমরা বাঁচতে পারবো না। আবার লকডাউনের বিকল্প কোনো উপায়ও আমাদের জানা নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো ভ্যাকসিনেশনের দিকে নজর দিচ্ছে। আমাদের সরকারও আন্তরিক এই দিকটিতে কিন্তু ভ্যাকসিনের প্রাপ্তিতেও রয়ে গেছে আশঙ্কা। ভ্যাকসিন কোথা থেকে আসবে, কেমন করে আসবে, কখন আসবে বা কতদিনে আমরা সকল মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পারব সেইসব নিয়ে থাকা দরকার ছিল একটি পরিষ্কার দিক নির্দেশনা। অথচ এই জায়গাটিও লেজেগোবরে অবস্থায় আছি আমরা।

আসলে করোনা আসার পর আমরা উভয় সংকটে আছি। এই সংকট মোকাবিলায় যদি সামনে পরিষ্কার কোনো করণীয় না থাকে তাহলে এর থেকে উত্তরণে আমরা আরও হাবুডুবু খাব। প্রথম থেকেই দরকার ছিল একটি সুচিন্তিত ‘রোডম্যাপ’। আমরা আমাদের জনগণকে জানি ও চিনি, তাদের প্রয়োজনকে জানি, রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের ক্ষমতাটুকুও জানা আছে আমাদের।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র আমাদের সামনে পরিষ্কার। এমন অবস্থায় কোন জায়গাটিকে কখন, কেমন করে ফোকাস করতে হবে বা কোথায়, কখন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে এমন একটি করণীয় যতদিন না আমাদের সামনে থাকবে ততদিন আমরা সরকারের সমালোচনা করেই যাব আর সরকারও জনগণের চাহিদাকে পূরণ করতে ব্যর্থ হবে।

সময় এখনো চলে যায়নি। এখনো সময় আছে। আমাদের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসে আগামীর দিনগুলোতে কেমন করে অর্থনীতি, জীবন, জীবিকা ও করোনাকে সামলে রাখব সেই পরিকল্পনাটি নিতে হবে।

লীনা পারভীন ।। কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট