করোনার ছোবলে সারা পৃথিবী ক্ষত-বিক্ষত। আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। অন্যদিকে করোনা প্রতিরোধের কারণে মানুষ এখন স্বেচ্ছাবন্দি। লকডাউন, বিধিনিষেধ, প্রতিষ্ঠান বন্ধ, চলাচল নিয়ন্ত্রণসহ বহুবিধ কারণে মানুষ ব্যাপক ক্ষতির শিকার। এই ক্ষতি জীবনের প্রতিটি স্তরকে পরিব্যাপ্ত করেছে। করোনার মতো কালান্তক বৈশ্বিক মহামারির কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মানুষ সব ধরনের ক্ষয়ক্ষতি মেনে নেয়। কিন্তু একই যাত্রায় যদি বিভিন্নজনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ফল ফলে তখন কেমন হয়? করোনা প্রতিরোধী কার্যক্রমে এরকম বৈষম্য সৃষ্টি করা হলে মানুষ ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়। নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে গৃহীত পদক্ষেপে এরকম পক্ষপাতিত্ব সাধারণ মানুষকে ভেঙে দেয়।

করোনা যুদ্ধে গৃহীত সব কাজকে একত্রে করোনা ব্যবস্থাপনা বলা হয়। এর দুটি অংশ। একটি হলো প্রতিরোধী কার্যক্রম। যার লক্ষ্য হচ্ছে করোনার বিস্তারকে থামিয়ে দেওয়া বা প্রতিহত করা। স্বাস্থ্যবিধি, চলাচলে বিধিনিষেধ, লকডাউন, টিকা প্রদান ইত্যাদি হচ্ছে প্রতিরোধী কার্যক্রমের মূলভিত্তি।

অন্যটি হচ্ছে চিকিৎসা প্রদান। টেস্ট, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, হাসপাতালে ভর্তি ইত্যাদি হলো চিকিৎসার অংশ। করোনা ব্যবস্থাপনার প্রতিটি কার্যক্রম স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে সমাজবিজ্ঞানের সাথে সমন্বয় করে গৃহীত হয়। এর ন্যায্যতার ভিত্তি হচ্ছে দুটি। প্রথমটি হলো, সিদ্ধান্ত হবে বিজ্ঞানসম্মত। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হবে পক্ষপাতহীন। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশের করোনা ব্যবস্থাপনার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক।

করোনা যুদ্ধে গৃহীত সব কাজকে একত্রে করোনা ব্যবস্থাপনা বলা হয়। এর দুটি অংশ। একটি হলো প্রতিরোধী কার্যক্রম। যার লক্ষ্য হচ্ছে করোনার বিস্তারকে থামিয়ে দেওয়া বা প্রতিহত করা।

মহামারি প্রতিরোধের মৌলিক নীতি হচ্ছে, মহামারি কবলিত জনপদ বা বিদেশ থেকে কোনো ব্যক্তিকে দেশে প্রবেশ করতে না দেওয়া। প্রবেশ করতে দিতে বাধ্য হলেও তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ‘আলাদা’ রাখতে হবে। তাদের শরীরে মহামারির জীবাণু থাকলে সেটা এই সময়কালে প্রকাশ পাবে অথবা জীবাণু মরে যাবে। এই নির্দিষ্ট সময় কালকে ইংরেজিতে ‘কোয়ারেন্টাইন’ বলা হয়। এই নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে দেশের মানুষের অধিকার।

২০২০ সালের ১৪ মার্চ করোনা কবলিত ইতালি থেকে এয়ার এমিরেটস’র একটি ফ্লাইট ঢাকায় অবতরণ করে। এই ফ্লাইটের ১৪২ জন যাত্রীকে নিয়মানুযায়ী ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখার কথা। সেটা না করে অত্যন্ত তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে তাদের বাড়ি পাঠানো হয়। এটা ছিল স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিরোধী পদক্ষেপ। ঐ একই মাসের ২৬ তারিখে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। তখন করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বগামী। আসন্ন বিপর্যয় এড়াতে মানুষজনকে ঘরে রাখা দরকার। এজন্যই সাধারণ ছুটি। কিন্তু সেই সময় গণপরিবহন চালু রাখা হয়েছিল। ফলে সাধারণ মানুষ উৎসবের মেজাজে দল বেঁধে গাদাগাদি করা অবস্থায় গ্রামের বাড়ি যায়। এতে পুরো অবস্থাটি ‘করোনার বিস্তার সহায়ক’ হয়ে উঠে।

কিছুদিন পরের কথা। তখন গণপরিবহন বন্ধ। সাধারণ ছুটি চলছে। গার্মেন্টস মালিকদের আয়-রোজগার ও মুনাফার কথা ভেবে হঠাৎ করে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বাড়ি থেকে ডেকে আনা হলো। অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে তারা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম বিভিন্ন শহরে আসে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হয়। তখন সেই শ্রমিকদের পত্রপাঠ আবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল। হায় এ-যুগের শ্রম দাস! এই স্বাস্থ্যবিধি-বিরুদ্ধ জনচলাচলের কারণে করোনা ছড়িয়ে পড়ার একটি অতি অনুকূল পরিবেশ পেল।

করোনা ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হচ্ছে টেস্ট করা। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে মাত্র দুই হাজার পরীক্ষার কিট নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ দেশবাসীকে জানাল তারা করোনা লড়াইয়ে ‘পূর্ণ প্রস্তুত’। ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা অন্যায়। সাধারণ মানুষ তখন করোনা টেস্ট করতে অনেক আগ্রহী। টেস্টের জন্য তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে। সে সময় কর্তৃপক্ষ টেস্ট সংকোচনের কৌশল গ্রহণ করে। করোনা টেস্টের জন্য দুইশত টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সাথে থাকে আরও কিছু শর্ত। করোনার কশাঘাতে অর্থনৈতিক দুর্দশায় নিপতিত মানুষ তখন টেস্ট বিমুখ হতে শুরু করে। এসময়ে মানুষের মধ্যে অসহায়ত্ব ও নিয়তি- নির্ভরতা ভর করতে শুরু করে।

ততদিনে মানুষ জেনে গিয়েছে করোনার মৃত্যু-আঘাত থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হচ্ছে টিকা নেওয়া। বিপুল প্রতীক্ষা শেষে দেশে করোনার টিকা এলো। টিকা নেওয়ার জন্য অনলাইনে সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন করতে হবে। কারা অনলাইনে নিবন্ধন করতে সক্ষম? যারা অনলাইন প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ, যাদের অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস বা কম্পিউটার আছে কেবল তারাই নিবন্ধন করতে সমর্থ হবে। যারা যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারে দুর্বল, যাদের কম্পিউটার বা অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস নেই, যেসব প্রান্তিক ও নিম্নবিত্তের মানুষ যারা কোনোদিন অনলাইনে কোনো কাজ করেনি তারা নিশ্চিত ভাবেই নিবন্ধন করতে পারবে না। অর্থাৎ অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে টিকা বৃত্তের বাইরে রাখা হলো।

বিত্তবান, শিক্ষিত, প্রযুক্তি-দক্ষ ও সুবিধাভোগী মানুষদের টিকা নেওয়ার পালা শেষ হওয়ার পর এখন অনলাইন নিবন্ধন থেকে সরে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিষয়টি দেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিককে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার শামিল।

করোনা সংক্রমণের বেপরোয়া ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরার জন্য একটি স্বীকৃত এবং প্রমাণিত পদ্ধতি হচ্ছে ‘লকডাউন’। এর মাধ্যমে জনচলাচলকে নিয়ন্ত্রিত করে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের ধারাবাহিকতায় বাঁধা দেওয়া যায়।

টিকা নেওয়ার জন্য অনলাইনে সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন করতে হবে। কারা অনলাইনে নিবন্ধন করতে সক্ষম? যারা অনলাইন প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ, যাদের অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস বা কম্পিউটার আছে কেবল তারাই নিবন্ধন করতে সমর্থ হবে।

বাংলাদেশে সরকারিভাবে লকডাউন শব্দটি ব্যবহার করা হয় না। তার বদলে ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ বলা হয়ে থাকে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর বিধিনিষেধ বা লকডাউনের বেশ কয়েক ধরনের নাম ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে। যেগুলো মূলত—শব্দ-চাতুর্য মাত্র। এসবের কোনো প্রায়োগিক সফলতা নেই। লকডাউন বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা সাধারণ মানুষের হাস্যরসের খোরাকে পরিণত হয়েছে।

লকডাউনের সময় জরুরি সেবা বা দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজন দরকারি সুরক্ষা সহকারে অবশ্যই তাদের কাজ চালিয়ে যাবে। তবে যারা জরুরি সেবার সাথে যুক্ত নয় তাদেরকে কাজ বা অফিস করতে হবে না। সম্ভব হলে অনলাইনে অফিসের কাজ সম্পন্ন করবে। বিশেষ প্রয়োজনে যদি এদের কাউকে কাজে লাগানো হয় তবে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দিতে হবে।

দেশে গত ২৩ জুলাই থেকে চলমান লকডাউনকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। হঠাৎ করে লকডাউনের অষ্টম দিন সন্ধ্যায় রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস ও শিল্পকারখানার মালিকদের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের জানানো হলো, পরদিন সকাল থেকে প্রতিষ্ঠান খোলা। তারা যেন যথাসময়ে কর্মক্ষেত্রে হাজির থাকে। গণপরিবহন বন্ধ। শ্রমিকরা আসবে কীভাবে? তাদের নেতারা জানাল-‘যেভাবে পারে আসবে’। ব্যস, কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব শেষ।

পরদিন দেশ এক অবর্ণনীয় অমানবিক দৃশ্য দেখল। নানাধরনের যানবাহনে কোরবানির পশুর মতো গাদাগাদি করে শ্রমিকরা তাদের কর্মস্থলে ফিরে আসে। স্বাস্থ্যবিধি, লকডাউন সব উধাও। স্রষ্টার উদ্দেশ্যে উৎসর্গের জন্য কোরবানির পশু আনা হয়। এই আধুনিক শ্রম দাসদের আনা হলো কারখানা মালিকদের লোভ ও লাভের যূপকাষ্ঠে উৎসর্গ করার উদ্দেশ্যে। সেই দৃশ্য ২০২১ সালের পৃথিবী প্রত্যক্ষ করল। অবশ্য পরে তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে ১৬ ঘণ্টার জন্য গণপরিবহন চালু করার অনুমতি দেওয়া হয়। কতিপয়ের মুনাফার জোয়ারে ভেসে গেল শ্রমজীবী মানুষের জীবনের নিরাপত্তা এবং লকডাউন চলাকালে দেশবাসীর ত্যাগের সকল ফলাফল।

বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচারের প্রতীক হচ্ছে ‘লেডি জাস্টিসিয়া’। যার দুই চোখ বাঁধা এবং হাতে তুলাদণ্ড। এর সরল অর্থ হলো, ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণের সময় কারো মুখের দিকে না তাকিয়ে ন্যায়কে ন্যায় আর অন্যায়কে অন্যায় বলতে হবে। এটাই হচ্ছে ‘ন্যায্যতা’। যখন ন্যায্যতা লঙ্ঘিত হয় তখন মানবিকতার তুলাদণ্ডের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়।

করোনা মহামারি প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তের সমাজ বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবায়ন হলো ন্যায্যতা। এর অন্যথা হলে এবং কাউকে সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভিন্ন কিছু করলে সেটা হয় অন্যায্য এবং অন্যায়। অন্যায্যতা বিপুল অনিষ্টের জন্মদাত্রী।

ডা. লেলিন চৌধুরী ।। চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ