ছবি : সংগৃহীত

একটা গবেষণার কাজে আড্ডা দিতে এলেন মিতি আপা। আমার সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক। গবেষণার কাজে, ‘আড্ডা দেওয়া’—এমন করে অনেক গবেষকরা বলবেন না। কিন্তু মিতি আপা বলেছেন।

মিতি আপা বলেন, আমার এই শিক্ষকের এমন করে বলাটা, আরেক শিক্ষকের সাথে খুব মিল। মিল হবে না কেন? রক্ত তো কথা বলে! এটিএন নিউজে মিতি আপা আমার রুমে ঢুকেই, আবার দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, পাশের রুমটা মিশুকের ছিল, তাই না রে?

মিশুক মুনীর আমার শিক্ষক। ব্রডকাস্ট সাংবাদিকতায় যিনি গুড জার্নালিজমের সংজ্ঞাটা পোক্ত করার জন্য কানাডার রিয়েল নিউজের ‘ডিরেক্টর নিউজ অপারেশন্স’র দায়িত্ব ছেড়ে এসেছিলেন।

আরও পড়ুন : অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার যেখানটায় আমরা এগোতে পারিনি

১০ বছর আগে তিনি পাশের ছোট্ট রুমটাতে জায়গা নিয়েছিলেন। মিশুক মুনীর, কুররাতুল-আইন-তাহমিনা মিতির কাজিন ভাই, বন্ধু। এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকর্মীও তারা দুজন।

২০১১ সালে মিশুক মুনীর যখন এটিএন নিউজের সিইও, তখন মিতি আপা বেশ ক’বারই এসেছিলেন। নিউজ রুম ভর্তি, এই দুই ভাইবোনের ছাত্রছাত্রী। কারো কাছে মিতি আপা বেশি প্রিয়, কারো কাছে মিশুক স্যার।

সে সময়ই সিইও মিশুক মুনীর ঘোষণা করলেন, এটিএন নিউজে ট্রেনিং হবে। ফিচার লেখার কৌশল। ব্রডকাস্টের জন্য গবেষণার টেকনিক নিয়েও পড়াবেন মিতি। সাথে টেকনোলজি, ছবি-সাউন্ড-আলো আর স্ক্রিপ্টের মিশেলে কী করে একটা টিভি প্যাকেজেও প্রাণ সঞ্চার করা যায়, সেটা তো সার্বক্ষণিক পাশে থেকে শেখাবেনই মিশুক স্যার। স্যার বলতেন, মিতির ব্রডকাস্ট ল্যাঙ্গুয়েজটা দারুণ, আমাদের ভাষা—আমাদের কানের জন্য লেখার ভাষা।

আরও পড়ুন : গণমাধ্যম ততটাই সাহসী, যতটা তার সম্পাদক 

১০ বছর আগের সেই দিনটায় ফিরে গেলাম যেন। সবাই খুব খুশি। কাজ করছি আর শিখছি। যেখানে যেটা মিশুক স্যার দেখছেন, সেটাই এটিএন নিউজের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করছেন। স্টাইল, এথিকস, মানবিকতা। ২৪ ঘণ্টাই বিশ্ববিদ্যালয়।

২০১১ সালে মিশুক মুনীর যখন এটিএন নিউজের সিইও, তখন মিতি আপা বেশ ক’বারই এসেছিলেন। নিউজ রুম ভর্তি, এই দুই ভাইবোনের ছাত্রছাত্রী। কারো কাছে মিতি আপা বেশি প্রিয়, কারো কাছে মিশুক স্যার।

এখানে দেয়ালে দেয়ালে প্রচলিত টিভি চ্যানেলের মতো টিভি স্ক্রিন, মনিটর, এডিট প্যানেল। আবার একটু স্পেস পেলেই বসে যাচ্ছে হোয়াইট বোর্ড। একজন রিপোর্টার বা ভিডিও এডিটরকে যেই ধরলেন স্যার... ওমনিই তার ভুল, ভালো দিক সবটা বোর্ডে লিখে দিতেন বা লিখিয়ে নিতেন। মিশুক স্যার ক্লান্তিহীনভাবে বলতেই থাকতেন। আমি তার অবসেসড শ্রোতা।

সাংবাদিকতা বিভাগে মাস্টার্সে ২৯ টি ক্লাস নেওয়ার কথা ছিল, আমাদের সেই সময়কার ‘ওয়েস্টার্ন হিরো মিশুক মুনীরের’। নিয়েছিলেন মাত্র ৩ টি। ক্লাসের বাইরে আমার সাথে মিশুক স্যারের প্রায়ই দেখা হতো। আমি তখন ভোরের কাগজের রিপোর্টার, আর স্যার তখন বিবিসি টেলিভিশন, চ্যানেল ফোর, এপিটিএন এসব ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ার জন্য কাজ করে দিতেন।

আরও পড়ুন : সাংবাদিকতায় নারীর চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা 

রেগুলার পলিটিক্সের বাইরে সোশ্যাল ইস্যুগুলোতে যেহেতু ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ার আগ্রহ, আর আমিও আমার রিপোর্টার ক্যারিয়ার শুরু করেছি হিউম্যান স্টোরি—সোশ্যাল ইস্যু দিয়ে, তো একই অ্যাসাইনমেন্টে স্যারের পাশাপাশি থাকতাম। কতবার ক্যামেরার পেছনে মিশুক স্যারের হেলপারগিরি করেছি...

স্যার সে সময়ই মাইক্রোফোন ধরা, রেকর্ডের সময় হু হু আওয়াজ না করা, কালার ব্যাকগ্রাউন্ড, সেট আপ, ঠিকঠিক লোক চিনে ইন্টারভিউর জন্য অ্যাপ্রোচ কত কিছু নিয়ে কথা বলতেন। আমি শুনতাম, তার বাধ্যগত ছাত্রী হয়ে।

জোগালিগিরি শেষ হলে স্যার অট্টহাসিতে বলতেন, দেখো বিনা পয়সায় কত কিছু শিখলা! আমি বলতাম, স্যার আমি তো কাগজে কাজ করি, এতসব দিয়া আমি কী করুম! আবারও হাসতে হাসতে স্যার বলতেন, কে জানে! জীবনের ধন কি ফেলা যায়?

আরও পড়ুন : বাকস্বাধীনতা একটি সংস্কৃতি 

ক্লাসে বন্ধুদের কাছে স্যারের এসব গ্রামার নিয়ে কথা বললে, ওরা আমাকে পাত্তাই দিত না। বলতো ‘ধুর, উনি হইলো ক্ষেপিস্ট। খ্যাপ মাইরা বেড়ায়, আমাগো ক্লাস নেয় না... পরীক্ষা কি দিমু কিচ্ছু বুঝি না... আর উনি আছে মিশুক স্যার লইয়া!’

আমার আক্ষেপ স্যারের ক্লাস না পাওয়া নিয়ে। সে আক্ষেপটা মেটাতেই হয়তো এটিএন নিউজে স্যারের সাথে লেগে থাকতাম। হাতে একটা নোটবুক, আর পেন্সিল। স্যার যেটা মুখে বলেন সেটা লিখি, যেটা বোর্ডে লেখেন—সেটাতো লিখিই।

এটিএন নিউজে প্রায় সব জায়গায় হোয়াইট বোর্ড আর মার্কার। ফ্লোরে ফ্লোরে গিয়ে, ব্রডকাস্ট এথিকস থেকে ক্লিনিং ইস্যু বা ট্রান্সপোর্ট রোটা ইউজার ফ্রেন্ডলি করার লেকচার- নোট।

স্যার সে সময়ই মাইক্রোফোন ধরা, রেকর্ডের সময় হু হু আওয়াজ না করা, কালার ব্যাকগ্রাউন্ড, সেট আপ, ঠিকঠিক লোক চিনে ইন্টারভিউর জন্য অ্যাপ্রোচ কত কিছু নিয়ে কথা বলতেন। আমি শুনতাম, তার বাধ্যগত ছাত্রী হয়ে।

রুলস দেখে বন্ধু কাজী নাজমুল আলম তাপস রাগ করে আমাকে বলতো, ‘এ্যাঁ...আনছে একটা পাগলা প্রফেসর, আর নিজেতো খ্যাচখ্যাচানি হেডমিস্ট্রেস... টেলিভিশন চ্যানেল না-কি ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুম, বুঝতে পারি না। এভাবে বাংলাদেশে চ্যানেল চলবো?’

আরও পড়ুন : প্রত্যাশা বেশি বলেই সমালোচনা বেশি 

তাপসের সাথে শাসিয়ে ঝগড়া করতাম, ‘হ্যাঁ ক্লাসরুম। তুইতো বইসা বইসা ঝিমাস! ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুম দেইখ্যাই স্যার কিছু কয়না!’
১০ বছর পরে মিতি আপা তার গবেষণার জন্য নানান কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন। কোড অব কন্ডাক্ট। লিখিত স্টাইলশিট, জেন্ডার নীতিমালা, ছুটি, প্যাটার্নিটি লিভ, রিক্রেয়শন লিভ, প্যাকেজিং, প্রোডিউসিং, নিউ মিডিয়া এথিকস, লাইভ রিপোর্টিং-এর রুলস, প্রাইভেসি, বেতন কাঠামো, বিজ্ঞাপন নেওয়ার এথিকস নানান কিছু। 

ওই যে... স্যারের পিছুপিছু হেঁটেছি নয় মাস। যতক্ষণ মিশুক স্যার এটিএন নিউজ রুমে থাকতেন বা সরকারি নীতিনির্ধারণী মিটিংএ... সেই শোনা, নোট করা, মাথায় নেওয়া থেকে মিতি আপার সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। এসবের কোনো ডিকশনারি, বাঁধানো বই বা লিখে, ছাপিয়ে রাখা কাগজ নেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। কিন্তু, গুরুমুখী বিদ্যা যেটুকু মাখায়, তা দিয়েই পর্দায় ঘোষণা দিয়ে আমরা বলি—‘আমরা লাশের ছবি, বীভৎসতা দেখাই না।’

আরও পড়ুন : মিডিয়া যেখানে দাঁড়িয়ে 

ব্রেকিং নিউজের অশ্লীল প্রতিযোগিতায় এটিএন নিউজ নেই। অন্য গণমাধ্যমের মতো ফকির আলমগীরকে ব্রেকিং নিউজে অন্তত দশ বার মারেনি এটিএন নিউজ। পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া ফুটেজে কখনো নির্লজ্জভাবে এক্সক্লুসিভ ব্যান্ড লাগানোর শিক্ষা মিশুক স্যারের নয়। বিজ্ঞাপন দিয়ে মুখ ঢেকে দেওয়া, সংবাদ পাঠিকাকে হারপিকের শাড়ি পরানোর মতো অসুস্থ লোভ, মিশুক স্যারের করে দেওয়া পর্দায় নেই।

সাধারণ মানুষের অসাধারণত্বের ব্যাকরণ নিয়ে একদম বাংলাদেশের আবেগের পর্দাটা হোক একটি টিভি চ্যানেলের পর্দা, সেটাই হোক মিশুকের গুড জার্নালিজম। এটিএন নিউজ টিমে যারা, গুরুকে গুরুত্ব দিয়ে কাজে আছি তাদের কাছে, মিশুক মুনীর একটি একটি নীতিমালার শিরোনাম। ব্রডকাস্ট সাংবাদিকতার স্টাইলশিট।

মুন্নী সাহা ।। প্রধান নির্বাহী সম্পাদক, এটিএন নিউজ