ছবি : সংগৃহীত

‘জঙ্গিবাদ’ শব্দটি শুনলে বা দেখলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ৯/১১-এর সেই মর্মান্তিক টুইন টাওয়ার হামলার চিত্র যেখানে ২৯০০-এর বেশি নিরীহ প্রাণকে জঙ্গিদের নির্মমতার শিকার হতে হয়েছিল।

বাংলাদেশের ভেতরে উৎপাদিত জঙ্গিবাদের কিছু ভয়াবহতার প্রত্যক্ষ উদাহরণ ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা, ২০০১ সালে রমনার বটমূলে বোমা হামলা, ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালে সিরিজ বোমা হামলা, ২০১৬ সালের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা যেখানে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেকখানি ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।

যদিও এসবই নতুন কিছু নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর দৌরাত্ম্য। এরপর নব্বইয়ের দশক থেকে হরকত-উল-জিহাদ-আল-ইসলাম (হুজি), হিযবুত তাহরীর, জেএমবির মতো ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর মানুষ হত্যার মহড়া। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, নব্য জেএমবির কয়েকটি ইউনিট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার অভিপ্রায় হয়েছিল যার ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পেয়েছি ধর্মের নামে ব্লগার ও বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা।

বর্তমানেও তারা আইএসের দক্ষিণ এশিয়া শাখা থেকে বিভিন্নভাবে সহায়তা পেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের সংগঠনগুলোর প্রচার, প্রচারণা করার চেষ্টা করছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের সরকার পতনের মাধ্যমে আফগানিস্তানের মতো একটি ইসলামিক রাষ্ট্র গঠন ও শরিয়া মোতাবেক দেশ পরিচালনা যেটি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার মূলমন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত।

জঙ্গিবাদের মতো ভয়াবহ ব্যাধি নিরসনে বেশকিছু পদক্ষেপ বর্তমান সরকার গ্রহণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের সূচক-২০২০-এ মোট ১৬৩টি দেশের মধ্যে ৩৩তম স্থানে অবস্থান করেছে বাংলাদেশ।

জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে অ্যান্টি টেররিজম অ্যাক্ট পাস করে এবং হলি আর্টিজান হামলা পরবর্তী ২০১৬ সালে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) গঠন করে।

জঙ্গিবাদের মতো ভয়াবহ ব্যাধি নিরসনে বেশকিছু পদক্ষেপ বর্তমান সরকার গ্রহণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের সূচক-২০২০-এ মোট ১৬৩টি দেশের মধ্যে ৩৩তম স্থানে অবস্থান করেছে বাংলাদেশ। তবে এসব পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। এই প্রেক্ষাপটে পরিতুষ্টির পরিধি সীমিত। জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদের মতো মহামারি সৃষ্টিকারী ভাইরাস দমনের জন্য বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গড়ে তোলা অতি আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

জঙ্গিবাদ একটি আদর্শ এবং একটি বৈষয়িক সমস্যা। স্থানীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক অসন্তোষ ছাড়াও বৈশ্বিক উগ্র ধারণা, ধর্ম বিদ্বেষ বা দর্শন জঙ্গিবাদ প্রলুব্ধ করে। বাংলাদেশে সেটা মোকাবিলার বহুমুখী প্রচেষ্টার মূল হিসেবে হামলা বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ‘hard approach’ নীতি গ্রহণ করে। যদিও তিন বছর বাংলাদেশে বড় কোনো হামলা হয়নি, কিন্তু ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন জঙ্গি ঘটনাগুলো তাদের কৌশল পরিবর্তনের একটি অংশ হতে পারে এবং জঙ্গিরা সেই দুর্বলতার সুযোগেই থাকে।

আমি মনে করি, কঠিন উপায়ে মিলিটারি কর্মকৌশলের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ স্থায়ীভাবে দূর করা যায় না, একই সাথে অবক্ষয় ও পুর্নবাসন (Deradicalization and Rehabilitation) কর্মসূচির মাধ্যমে জঙ্গিদের পরিবার ও সমাজে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা করা দরকার। তরুণ ও যুবকরা কেন জঙ্গিবাদে ঝুঁকছে সেই কারণগুলো খুঁজে বের করে সেই সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন।

সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকরী ভূমিকা বরাবরই অপরিসীম একজন সন্তানের মনস্তাত্ত্বিক গঠনের জন্য। সর্বপ্রথম যে নিয়ামকের ভূমিকা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি, সেটি হলো পরিবার। কারণ পরিবার একটি শিশু তথা মানুষের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

একজন মানুষ তার জীবনের প্রাথমিক শিক্ষাগুলো পরিবার থেকেই পেয়ে থাকে। তাই পরিবারের সদস্যদের উচিত সন্তানের উপর যথাযথ তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়তা করা।

জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রচারণা ও নিয়োগের ধরণ পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তারা তরুণ সমাজকে টার্গেট করেই তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে, কারণ একটি দেশের তরুণরাই সেই দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে প্রধান হাতিয়ার। সেই তরুণ সমাজকে যদি সহিংসতা ও উগ্রবাদী মনোভাবে কলুষিত করা যায় তাহলে সেই দেশের ভবিষ্যৎ ও উন্নয়ন ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব এবং জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব। 

জঙ্গিবাদ প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অর্থায়ন। আমাদের দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর জন্য অর্থায়ন আসে মূলত মধ্য-এশিয়ার কয়েকটি দেশ থেকে বিভিন্ন এনজিও অথবা হুন্ডির মাধ্যমে।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনস্বীকার্য, কারণ এদেশের জঙ্গিবাদী কার্যক্রম মূলত ধর্ম কেন্দ্রিক ও ধর্মীয় উগ্রবাদ নির্ভর। হলি আর্টিজান হামলার পর বাংলাদেশের ধর্মীয় সংগঠনগুলো ফতোয়া দিয়েছিল যেখানে ১ লক্ষ ইসলামিক চিন্তাবিদ স্বাক্ষর করেছিল এবং বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ৭০ হাজার মসজিদে প্রতি শুক্রবার জঙ্গিবাদ বিরোধী খুতবার আয়োজন করা হয়েছিল। এগুলো অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ, কিন্তু এগুলো সবসময় চলমান রাখতে হবে।

সেই সাথে ধর্মের সঠিক মর্মার্থ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কারণ জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই, তারা ইসলাম ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও সহিংসতার সৃষ্টি করার মাধ্যমে তাদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করে।

জঙ্গিবাদ প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অর্থায়ন। আমাদের দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর জন্য অর্থায়ন আসে মূলত মধ্য-এশিয়ার কয়েকটি দেশ থেকে বিভিন্ন এনজিও অথবা হুন্ডির মাধ্যমে। এছাড়াও মানি লন্ডারিং জঙ্গিবাদের অর্থ জোগাতে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। তাই এধরনের অর্থ প্রবাহে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে আরও সজাগ ও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।

জঙ্গিদের অর্থায়ন বন্ধ করে দিতে পারলে তাদের মেরুদণ্ডে বিশাল আঘাত আসবে যেটি পরবর্তীতে তাদের বিলুপ্তিতে অন্যতম পাথেয় হবে বলে আমি মনে করি।

তাছাড়া, বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ দমনে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশিং অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমি মনে করি। তার কারণ হিসেবে, কমিউনিটি পুলিশিং-এর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা একটি সমাজে কী হচ্ছে না হচ্ছে, কেউ সন্দেহজনক কাজ করছে কি না, এমনকি সেসব ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে পুলিশ ও সমাজের সদস্যরা পরস্পরের সহযোগী হিসেবে কাজ করে যেটি জঙ্গিবাদসহ যেকোনো অপরাধ দমনেই মূল ভূমিকা পালন করে বলে আমি মনে করি।

খন্দকার ফারজানা রহমান ।। চেয়ারম্যান, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়