গ্রিক পুরাণ মতে, ‘প্যান্ডোরা’ ছিলেন অগ্নিদেবের তৈরি প্রথম নারী। তাকে একটি গোপন বাক্স দেওয়া হয়েছিল এবং তাকে তা খুলতে বারণ করা হয়েছিল। সমস্ত অশুভ আত্মা সেই বাক্সে আবদ্ধ ছিল। কিন্তু প্যান্ডোরা তার কৌতূহলের কাছে হেরে গিয়ে বাক্সটি খুলে ফেলে। মন্দ আত্মারা তখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। 

সেই প্যান্ডোরার বাক্স যেন আবার খুলল, আর তাতেই শোরগোল সারা বিশ্বে। বিষয়টা কী? সোজা কথায়—আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মোটা টাকা কর ফাঁকি দিচ্ছেন স্বয়ং রাষ্ট্র নেতারা এবং মহারথী রোল মডেলরা। কম করে ১২টি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান এ দোষে দোষী বলে দাবি করেছে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া ‘প্যান্ডোরার পেপারস’।

প্রতিবেদন বলছে, কর ফাঁকি দিতে রাষ্ট্রপ্রধানরা, রাজনীতিক এবং নানা অঙ্গের সেলেব্রিটিরা বিদেশি একাউন্টে ঘুরপথে অর্থ চালান করছেন। একইভাবে বিদেশে বেনামে বহু মূল্যবান বাড়ি, সম্পদও কিনেছেন কর বাঁচিয়ে।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন, সিপিআইয়ের আন্তর্জাতিক অঙ্গসংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) সম্প্রতি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কর দুর্নীতির যে খতিয়ান প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে জড়িয়েছে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা, প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা এবং প্রথম সারির রাজনীতিবিদ, এমনকি খেলোয়াড়ের নাম। তাদের মধ্যে রয়েছেন জর্ডানের রাজা, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী, ভারতের শীর্ষ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ক্রিকেট লিজেন্ড শচীন টেন্ডুলকার ও পাকিস্তানের শীর্ষ রাজনীতিক। এই গোপন অনুসন্ধানে যুক্ত ছিলেন বিশ্বের ৬০০ জন সাংবাদিক। মোট ১৪টি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা থেকে এক কোটি ১৯ লক্ষ নথি প্রকাশ্যে আনেন এই সাংবাদিকেরা।

২০১৪ সালে লাক্সলিকস (LuxLeaks), ২০১৬ সালে পানামা পেপারস (Panama Papers) এবং ২০২১ সালে প্যান্ডোরা পেপারস (Pandora Papers)। আইসিআইজে কর্তৃক পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের পর এগুলো সামনে এলো। শত শত রাজনীতিবিদ, অভিজাত ব্যক্তি, ধর্মীয় নেতা, তারকা এবং মাদক ব্যবসায়ীরা সম্পত্তির তথ্য উন্মোচন করেছে এসব তদন্ত। এরা সমুদ্র তীরবর্তী রেস্তোরাঁ, বিলাসবহুল জাহাজ এবং বড় ভবনসহ নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছেন।  

কর দুর্নীতির যে খতিয়ান প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে জড়িয়েছে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা, প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা এবং প্রথম সারির রাজনীতিবিদ, এমনকি খেলোয়াড়ের নাম।

ভারতের প্রায় ৬০০, পাকিস্তানের ৭০০ ব্যক্তির নাম এসেছে এই প্যান্ডোরা পেপারস-এ। ভারতের সিবিআই তদন্ত শুরু করেছে। পাকিস্তানের যেসব নেতা-মন্ত্রীর নাম এই কর দুর্নীতি-কাণ্ডে জড়িয়েছে, তাদের বরখাস্ত করার দাবি জানিয়ে ইতিমধ্যেই ইমরানের উপর চাপ তৈরি করতে শুরু করেছেন দেশের বিরোধীরা।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কেন এই অনুসন্ধানে অংশ নিল না? বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত ব্যবসায়ীর নাম এসেছে নেপালের গণমাধ্যমের রিপোর্টে। তবে প্যান্ডোরা পেপারসে এখন পর্যন্ত সেই একজন ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশির নাম প্রকাশিত হওয়ার কথা শোনা না গেলেও বাস্তবতা হলো, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ বাড়ছে।

২০২০ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্রাংক বা ফ্রাঁ, স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। অর্থ পাচারের এধারা অব্যাহত আছে। 

উন্নত জীবনের খোঁজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে অভিবাসী হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। এরা কষ্ট করছেন, দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। তবে একটি গোষ্ঠী আছে যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে ও নীতিনির্ধারণী জায়গায় অবস্থান করে অর্থ পাচার করছেন।

২০২০ সালে কানাডা সরকারের বরাতে পত্রিকাগুলো প্রতিবেদন করেছিল যে, পাঁচ বছর ধরে প্রতি বছর তিন হাজারের অধিক বাংলাদেশি কানাডায় স্থায়ী বসবাস করছেন। আর ২০০৬ সাল থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত কানাডায় পিআর পেয়েছেন ৪৪ হাজার ১৮৬ জন বাংলাদেশি। বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী কোটায় কানাডায় পিআর সুযোগ যারা পেয়েছেন, তাদের একটা অংশ মূলত দুর্নীতি, ঘুষ, ব্যাংক লুট, প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের মতো অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় এ বিনিয়োগ করেছেন।

দেশ থেকে নেওয়া দুর্নীতি ও লুটের টাকায় সেখানে বিলাসী জীবনযাপন করছেন তারা। কানাডায় অভিবাসন নিয়ে থাকা এসব দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছেন সেখানকার বাংলাদেশিরা।

বাংলাদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া বহু ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিক তাদের স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন কানাডায়। তাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে সেখানে বাংলাদেশের ‘বেগমপাড়া’। ‘অর্থ পাচার’ ও ‘অর্থ লুট’ করে কানাডায় বা অন্যদেশে সম্পদ গড়ার তালিকায় ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন আমলারা। খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বলেছেন এবং বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও আমলারা সম্পদের হিসাব না দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন। 

বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী কোটায় কানাডায় পিআর সুযোগ যারা পেয়েছেন, তাদের একটা অংশ মূলত দুর্নীতি, ঘুষ, ব্যাংক লুট, প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের মতো অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় এ বিনিয়োগ করেছেন।

দুর্নীতি আর অদক্ষতায় ডুবে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আজ এই অবস্থায় পৌঁছেছে যে, তাদের ঠেলা ধাক্কা দিয়ে কাজ করাতে হয়। সত্যি বলতে কি, দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন থেকে কাজ করার অনীহায় থাকা আমাদের সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের কারণে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

আমাদের উন্নয়ন স্পৃহা জেগেছে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক নেতৃত্বে, অথচ জনপ্রতিষ্ঠানগুলো সেই স্তরে নিজেদের নিতে পারছে না। এই কাজ না করার মানসিকতা তৈরি হয়েছে অবাধ দুর্নীতি থেকে। সুশাসনের প্রধান অন্তরায় এই দুর্নীতি। 

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুর্নীতি আমাদের দেশের অর্থনীতিকে কোনো এক অজানা গহ্বরে নিয়ে যায় তা নিয়ে সবাই শঙ্কিত। একইভাবে শঙ্কিত প্রকল্প দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য, কর দুর্নীতিসহ নানা অনিয়ম নিয়ে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগের পরিবর্তে লুটেরাদের নানা সুবিধা দেওয়ার আয়োজনই বেশি করতে দেখি আমরা। একটা কথা মানতেই হবে, দুর্নীতি এবং নীতিহীনতা যদি একটি সমাজে প্রকট হয়ে উঠে তখন সামাজিক পরিসরটি দখল করে নেয় অপরাধীরা। দুঃখজনক হলেও সেটাই ঘটছে বাংলাদেশে। 

প্যান্ডোরার নথিতে বাংলাদেশের নাম না থাকলেও সবাই জানেন যে, এদেশে দুর্নীতি ব্যাপক হার আছে এবং অর্থ সম্পদ পাচারের আয়োজনটাও বেশ বড়। আমরা চাই দুর্নীতির এই ঋতুটা বদলাক। 

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি