শরতের পেঁজা পেঁজা মেঘ, কাশবন, শিউলি ফুল, ঢাকের ধ্বনি, চণ্ডীপাঠ, দেবীপক্ষ, ধূপের গন্ধ, বাতাসা-মুরালি, প্রতিমা দর্শন, শাঁখারীপট্টি, গোপীবাগের গলি ঘুরে মিলেমিশে আমার পূজা দর্শন শুরু। ঈদ, পূজা, বড়দিন বা বৌদ্ধ পূর্ণিমা আমাদের মিলিত প্রাণের কলরবের উৎস।

বড়দিনে রূপার বাসায় কেক কাড়াকাড়ি, বৌদ্ধ পূর্ণিমায় লাবনীদের সাথে ফানুস ওড়ানো, পূজায় গণেশ মামার বাড়িতে প্রতিদিন সময় কাটানো, রোজায় আমাদের বাড়িতে ইফতার আর সবাই মিলে ঈদের দুপুরে একত্রিত কলকাকলির মাঝেই জেনেছিলাম আমরা এক। সেই ছেলেবেলায় ধর্ম যার যার, উৎসব সবার—এই স্লোগানে আমি বুঝে নিয়েছিলাম এই স্বাধীন দেশ আমাদের সবার।

দুর্গাপূজার সময়কাল দীর্ঘ হওয়ায় একসাথে সময় কাটানোটাও দীর্ঘ হতো। গণেশ মামার বাড়ি প্রায় প্রতিদিনই পূজা উৎসবের ঠিকানা ছিল। কাছ থেকে মণ্ডপ দেখা, আরতির তালে নেচে ওঠা, সিঁদুর খেলা আর প্রসাদের জন্য অপেক্ষার মুহূর্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত।

দুর্গাপূজার সময়কাল দীর্ঘ হওয়ায় একসাথে সময় কাটানোটাও দীর্ঘ হতো। গণেশ মামার বাড়ি প্রায় প্রতিদিনই পূজা উৎসবের ঠিকানা ছিল। কাছ থেকে মণ্ডপ দেখা, আরতির তালে নেচে ওঠা, সিঁদুর খেলা আর প্রসাদের জন্য অপেক্ষার মুহূর্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত।

আমরা শুধু উৎসবেই এক হতাম না, শোকেও একসাথে কাঁদতাম। আমার নানীর মৃত্যুদিনে দেখেছিলাম কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দিরের বিশুদ্ধানন্দ কাঁদতে কাঁদতে প্রার্থনা করছিলেন। গণেশ মামার মা হাড়ি ভর্তি রান্না করে নিয়ে এসেছিলেন। নানীকে কবর দেওয়ার সময় সবাই মিলে গোরস্থানে গিয়েছিলেন। আমরা এক ছিলাম। শোকে, দুঃখে, আনন্দ, প্রাপ্তি বা সাফল্যে। শক্তিশালী আবেগে আমাদের পথচলা হতো। 

সে সময়গুলো ওয়াজ, বয়ান বা ফতোয়ার প্রচলনে চলতো না। আমরা নিজ ধর্ম পালনের অভ্যাস পরিবার থেকেই শিখেছি। অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা তাই রক্তে মিশে গেছে। ধর্ম পালন এবং ধর্মীয় উৎসব উদযাপন একদম ভিন্ন ধারায় প্রচলিত ছিল।

উৎসব পালনে ভিন্নতার প্রকাশ শুরু হতে থাকে যুদ্ধাপরাধী আন্দোলনের সময় থেকে। শাহবাগে প্রতিবাদে মশাল জ্বালানো, মোমবাতি ধরানোতে অগ্নিপূজা বা ব্লগার মতামতে নাস্তিক উপাধি, ধীরে ধীরে গ্রাস করা হয়েছে তৃণমূলের মানুষকে।

টিপ দেওয়াতে হিন্দুয়ানি, শহীদ মিনারে ফুল অর্পণে মূর্তিপূজা এমনকি শিশুদের মাঝেও স্কুলে হিজাব না পরে আসলে তাকে অন্য ধর্মের বলে তিরস্কার হরহামেশা হচ্ছে।

উগ্র মৌলবাদে ধ্বংস হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থাও। শিশুদের পাঠ্যবই থেকে হিন্দু বা প্রগতিশীল লেখকদের ছড়া বা লেখা সরানো হয়েছে, ‘অ’-তে অজগর বাদে অজু অথবা ‘ও’-তে ওল বদলে হয়েছে ওড়না। 

আমরা নিজ ধর্ম পালনের অভ্যাস পরিবার থেকেই শিখেছি। অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা তাই রক্তে মিশে গেছে।

আজকাল রোজার সময় মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয় হিন্দু রেস্তোরা থেকে ইফতার সংগ্রহ না করবার জন্য। মূর্তি ধ্বংস করা হচ্ছে বছর জুড়ে। এমনকি জাতির পিতার একটি ভাস্কর্যে হামলা চালানো হয়েছিল গত বছর।

নাসিরনগর, রামু বা অভয়নগরে সংখ্যালঘুর ওপর হামলার মতো অঘটনে প্রতিবাদ করার মতো মানুষ, প্রতিনিয়ত কমে আসছে। এখনকার সুশীল সমাজ বা রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। ইতিহাস, সংস্কৃতি নিয়ে তাদের আগ্রহ কম। কারণ সেখানে ভোট নেই!
সারা জীবনের অভ্যাসবশত শরৎ এলেই পূজা উৎসবের সুর বাজে প্রাণে। আকাশবাণীতে চণ্ডীপাঠ, দেবীপক্ষ বা দেবী ঘোড়ায় চড়ে আসছেন না হাতিতে তা জানবার জিজ্ঞাসা আমাদের মাঝেই আবর্তিত হয়ে আছে। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ স্লোগান ঝাপসা দেখায়। কেন যেন মনে হয় ‘ধর্ম যার যার, উৎসবও তার তার’ হতে আর বেশি দেরি নেই। 

যুদ্ধাপরাধী বিচার মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি মাইলফলক হিসেবে ইতিহাস রচনা করলেও, আমরা হারিয়েছি আমাদের স্বাধীন হওয়ার প্রথম আকাঙ্ক্ষা। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণির বিভেদ ভুলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি স্বাধীন ভূখণ্ড আমাদের উপহার দেওয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশ তার কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে একসাথে নিয়ে পৃথিবীর বুকে এক অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে দৃষ্টান্ত হব তাই। অথচ আমরা প্রজন্মকে শেখাই কালো পিঁপড়া মুসলমান, ভালো তাই কামড় দেয় না আর লাল পিঁপড়া হিন্দু, খারাপ তাই কামড় দিলে ব্যথা পায় সবাই। 

আমি হাল ছাড়তে নারাজ। একতার দৃঢ় বিশ্বাস মনে বপন করি প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। সমষ্টিগত মিলিত প্রাণের কলরবে আমরা আবারও এক হয়ে গেয়ে উঠব—আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। শুনতেই হেসে উঠবে শরৎ আকাশ, নেচে বেড়াবে মেঘের ভেলা।

শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা