মাতৃভূমিকে কে না ভালোবাসে! তবুও প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনুভূতিগুলো একটু অন্য রকম। রুটিনে বাঁধা প্রবাস জীবনে ধুলোমাখা বাংলার মতো সকাল-বিকেল, যখন তখন চায়ের দোকানের আড্ডা যেমন নেই, তেমনি সুখ-দুঃখ, উৎসব আমেজে পাড়া-পড়শির হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসাও খুঁজে পাওয়া ভার। সবকিছুতেই সময়ের তাড়া নিয়ে দৌড়ঝাঁপ যখন নিত্যসঙ্গী, সেই সময়ে করণিক জটিলতা যেমন মনের দুঃসহ যন্ত্রণাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় আবার দেশমাতৃকার যেকোনো সুসংবাদ সকল যাতনার তাৎক্ষণিক অবসান ঘটিয়ে হৃদয়, মনের আনন্দকেও বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে।

ওয়ালমার্ট, হাডসন বে, টমি হিলফিগার এর মতো মেগা শপগুলোয় স্তরে স্তরে সাজানো বাংলাদেশি পণ্যের শেলফগুলোতে ক্রেতার ভিড় দেখে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মনে যেমন আনন্দের শিহরণ জাগে, ঠিক তেমনি নিজের টাকায় নির্মিত পদ্মা সেতুর কথা শুনে গর্বে বুক ভরে যায়।

রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, মাইনাস তাপমাত্রার হাড়কাঁপানো শীতকে উপেক্ষা করে অর্জিত ডলার, রিয়াল দেশে পাঠিয়েও মনের আনন্দে দেশকে নিয়ে কল্পনার জাল বুনে। প্রবাসের অফিস, আদালত, ব্যবসা, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আচার-আচরণে বিস্মিত হয়ে রাত জেগে এই মানুষগুলোই আবার আফসোস করে- নিদেনপক্ষে আমার দেশের এয়ারপোর্টে আর প্রবাসে বাংলার দূতাবাসের মানুষগুলো যদি এমন হতো!

দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের ভূমিকা অগ্রগণ্য হলেও কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে এমন সকল দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাই রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রাখছে।

এখনো আমাদের বিমানবন্দর, প্রবাসের মিশনগুলোর বিভিন্ন সেবা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। হাসিমুখে সেবা দানের সংস্কৃতিটি আজও আমাদের দেশে গড়ে উঠেনি।

সরকারের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দায়িত্বশীলরা প্রবাসীদের এই অবদানকে স্বীকার করলেও সেবা আর সম্মানের প্রশ্নে অগ্রগতি নিতান্তই সামান্য। এখনো আমাদের বিমানবন্দর, প্রবাসের মিশনগুলোর বিভিন্ন সেবা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। হাসিমুখে সেবা দানের সংস্কৃতিটি আজও আমাদের দেশে গড়ে উঠেনি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সেবার জগতেও একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। হরহামেশাই আমাদের বৈদেশিক মিশনের কর্মকর্তাদের সেবার প্রশ্নে নানা অভিযোগ শোনা যায়।

বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন করেও কাউকে পাওয়া যায় না। অগত্যা পেলেও সেবাপ্রার্থীর কথা শুনতে চান না। মহাশয় সুলভ আচরণে মনে হয়, মিশনে কর্মরত কর্তাব্যক্তিরা যেন প্রভু হয়ে ভৃত্যদের শাসন করতে এসেছেন। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের ওয়েভ রিভিউ আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মন্তব্যগুলো পড়লে এমন হতাশার ভুরি ভুরি প্রমাণ মেলে। জনবলের তুলনায় সেবাগ্রহীতার আধিক্য, অর্থনৈতিক ও কারিগরি সক্ষমতার অভাব নাকি মানসিকতার দৈন্যতা, কোনো অজ্ঞাত কারণে ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রাপ্য সেবা নিয়ে অভিযোগ তুলছেন, এর কারণ অনুসন্ধানে মনোযোগী হতে আরও বিলম্ব কেন?

হতাশা আর অভিযোগের মাঝেও আশার আলো আছে। শুধুমাত্র ইচ্ছা শক্তি দিয়ে প্রবাসের একটি মিশনকে যে সত্যিকারের সেবাকেন্দ্রে পরিণত করা যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কানাডার টরেন্টোতে অবস্থিত ‘বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল’।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন করেও অপর প্রান্ত থেকে জবাব না পাওয়ার অভিজ্ঞতা যখন আমাদের সামনে, অগত্যা জবাব পেলেও কঠোর প্রভুসুলভ আচরণে অপর প্রান্তের রূঢ় ও কর্কশ আচরণে সেবাগ্রহীতারা যখন ভারাক্রান্ত, এমন চিত্রের বিপরীতে সর্বনিম্ন সময়ে কল রিসিভের নিশ্চয়তা, হাস্যবদনে সেবাগ্রহীতার সন্তুষ্টি অর্জনের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার চিত্রকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বললে অত্যুক্তি হবে কি?

সেবা নিয়ে অভিযোগ করলে কর্তার অসন্তোষের অসংখ্য দৃষ্টান্ত যে সময়ে আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, এর বিপরীতে গুগল আর ফেসবুকের রিভিউ দেখে অসন্তুষ্ট সেবাগ্রহীতার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে সমস্যা সমাধানের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাকে সেবার জগতে অনন্য দৃষ্টান্ত বললে বাড়িয়ে বলা হবে কি?

সর্বোচ্চ তিন কর্ম দিবসের মধ্যে যে কনস্যুলার সেবাটি সম্পন্ন হওয়ার কথা, সেটি ত্রিশ দিনেও শেষ হয় না। সমস্যা সমাধানে নির্ভরযোগ্য কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে প্রবাসে খেটে খাওয়া মানুষগুলো যখন গলদঘর্ম হয়, এমন দুঃসহ অবস্থার বিপরীতেও টরেন্টোর বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল অফিস ডাকযোগে প্রেরিত আবেদন প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আবেদনকারীকে ই-মেইল কনফার্মেশন পাঠায়।

যেকোনো সময়ে অনলাইনে আবেদনের বর্তমান অবস্থান দেখার সুযোগ তো আছেই, পাশাপাশি অতিরিক্ত তথ্যের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আবেদনকারীর সঙ্গে তাৎক্ষনিক যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দের বিষয়, কোনো আবেদন বিধি অনুযায়ী প্রত্যাখ্যাত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিনয়ী ও পরামর্শ সুলভ আচরণে সেবাগ্রহীতা সন্তুষ্ট চিত্তেই প্রিয় দেশের কন্স্যুলার সেবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

শুধুমাত্র ইচ্ছা শক্তি দিয়ে প্রবাসের একটি মিশনকে যে সত্যিকারের সেবাকেন্দ্রে পরিণত করা যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কানাডার টরেন্টোতে অবস্থিত ‘বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল’।

একটি কনস্যুলেট জেনারেলের অফিস যেখানে সেবা গ্রহণ করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মন্তব্য করেন, ‘আন্তরিকতার সাথে এমন দ্রুত ও সহজ সেবা কল্পনাতীত’, ‘মাত্র পনেরো মিনিটে তিনটি পাসপোর্টে এনভিআর’, ‘মাত্র দু’ঘণ্টায় পাঁচ জনের ভিসা’—এমন আরও অনেক অনেক প্রশান্তির বার্তা! যে কনস্যুলেটর ৫৬জন সেবাগ্রহীতার মতামত পর্যালোচনায় দেখা যায় ৯২.৮৫% সেবাগ্রহীতা কনস্যুলেট সার্ভিসে দারুণভাবে মুগ্ধ, ৭.১৫% সেবাগ্রহীতা প্রাথমিকভাবে কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও স্বয়ং কনসাল জেনারেল তাদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। এমন একটি বাংলাদেশি কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসকে ‘বাংলাদেশি সেবার আন্তর্জাতিক মান’ বললে বোধকরি মোটেও অতিশয়োক্তি হবে না।

অর্থনৈতিক আর নানা সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব দৃশ্যমান অগ্রগতির সাথে সাথে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবায় আরও মনোযোগী হওয়া যখন সময়ের দাবি, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে টরেন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল- সেবার জগতে নিঃসন্দেহে এক অনন্য মডেল।

কনস্যুলার সেবায় এমন সাফল্য অর্জনে সুদক্ষ একঝাঁক কর্মকর্তাদের সমন্বিত উদ্যোগের পাশাপাশি নিশ্চয় কোনো দিক-নির্দেশক দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব আড়ালে থেকে কাজ করেছেন। যারা সেবা নিয়েছেন, ভবিষ্যতে সেবা নিতে পারেন আর যারা বাংলাদেশের কনস্যুলার সেবা নিয়ে আহাজারি করছেন সবার পক্ষ থেকেই বলতে চাই, টরেন্টোকে অনুসরণ করে যদি দেশে দেশে আমাদের বৈদেশিক মিশনগুলো তৎপর হয়ে উঠে নিশ্চয়ই সেদিন বেশি দূরে নয় যখন প্রশান্তির সুরেই আমরা বলব, ‘বাংলাদেশের কনস্যুলার সেবাও এখন আন্তর্জাতিক মানের’।

মো. মাহমুদ হাসান ।। কলামিস্ট ও গবেষক