দেশে করোনার সংক্রমণ ক্রমশ কমে আসছে। শনাক্তের পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও কমছে। এ অবস্থায় গত ১৯ আগস্ট থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে প্রায় সমস্ত কিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। এতে করোনা জর্জরিত বন্দি জনপদে হঠাৎ যেন মুক্তির বাতাস বইতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার ঘোষণাও এসেছে।

মানুষজন মহানন্দে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। তাদের আনন্দের বন্যায় ভেসে গিয়েছে মাস্ক, টুটে গিয়েছে স্বাস্থ্যবিধি। এখন প্রায় সর্বত্র স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত।

মানুষজন মহানন্দে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। তাদের আনন্দের বন্যায় ভেসে গিয়েছে মাস্ক, টুটে গিয়েছে স্বাস্থ্যবিধি। এখন প্রায় সর্বত্র স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত। দিনে দিনে লোকজনের মধ্যে মাস্ক পরার প্রবণতা কমে আসছে। জনসাধারণকে মাস্ক পরতে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে যারা উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য করবে সেই কর্তৃপক্ষের আচরণে শৈথিল্য প্রকট। এমতাবস্থায় দেশের করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে ধাবমান? পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

ঢেউয়ের উঠা নামার গতিতে করোনার সংক্রমণ ধারা চলতে থাকে। প্রথমে রোগীর সংখ্যা খুব কম থাকে। তারপর বাড়তে শুরু করে এবং সংক্রমিতের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে একসময় চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। এটাকে সংক্রমণ-সূচকের চূড়া বলা হয়। এরপর সংক্রমণ ক্রমশ কমতে থাকে এবং একপর্যায়ে বেশ কমে যায়। একনাগাড়ে তিন সপ্তাহ সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের কম থাকলে তখন করোনা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়।

করোনার মতো মহামারি শুরু হলে রোগটির একটি ‘অনুমিত ভবিষ্যৎ চিত্র’ তৈরি করা হয়। সংক্রামক রোগতত্ত্ব বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী এই চিত্রটি তৈরি করা হয়ে থাকে। এরপর আসে রোগটিকে প্রতিরোধের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর ছড়ানো এবং মানুষের শরীরে প্রবেশ করার প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে প্রতিরোধ কৌশল নির্মাণ করা হয়।

করোনার ক্ষেত্রে ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি এবং শ্বাসের বাতাসে বের হওয়া তরল কণার সাথে করোনাভাইরাস বের হয়। সুস্থ মানুষ শ্বাসের সাথে সেই বায়ুবাহিত ভাইরাস টেনে নেওয়ার মাধ্যমে করোনা আক্রান্ত হয়। তাই করোনা প্রতিরোধের প্রধান কৌশল হলো আক্রান্ত এবং সুস্থ উভয় ধরনের মানুষের নাক-মুখ মাস্ক দিয়ে ঢেকে দেওয়া।

করোনা রোগীর হাঁচি, কাশি বা শ্বাসের বাতাস কোনো স্থানে সরাসরি পড়তে পারে। সেখানটায় হাত দিয়ে স্পর্শ করে সেই হাত নাক, মুখ বা চোখে না লাগানো। সাবান বা ইথানল (৭০%)-এর সংস্পর্শে করোনাভাইরাস মরে যায়। তাই বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া বা হাতে স্যানিটাইজার লাগাতে বলা হয়।

একজন মানুষ হাঁচি বা কাশি দিলে যে জলকণাবাহী বাতাস বের হয়ে সেটা তিন থেকে ছয় ফুট দূরে যেতে পারে। এজন্য করোনাকালে একজন মানুষ থেকে আরেকজনের দূরত্ব ছয়ফুট হলে ভালো হয়, নিদেনপক্ষে তিন ফুট হওয়া বাধ্যতামূলক।

করোনা প্রতিরোধের এই তিনটি পদক্ষেপকে একত্রে স্বাস্থ্যবিধি বলা হয়। এই স্বাস্থ্যবিধিগুলো করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে কতটা কার্যকর? শুধুমাত্র মানসম্পন্ন মাস্ক সঠিকভাবে পরার মাধ্যমে করোনার আক্রমণকে শতকরা ৯৭-৯৮ ভাগ ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব। আর সবগুলো বিধি ঠিকমতো পালন করলে প্রায় শতভাগ করোনা মুক্ত থাকা যায়।

করোনা প্রতিরোধের কার্যকর স্থায়ী কৌশল হচ্ছে—মানুষের শরীরে করোনা প্রতিরোধী সুরক্ষা শক্তি তৈরি করা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘ইমিউনিটি’ বলা হয়। করোনা টিকা দেওয়ার মাধ্যমে এই ইমিউনিটি তৈরি করা হয়।

এখন পর্যন্ত দেশে প্রায় পাঁচ শতাংশের মতো মানুষকে করোনার দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। কেবলমাত্র দুই ডোজ টিকা নিলেই একজন ব্যক্তির শরীরে প্রত্যাশিত সুরক্ষা শক্তি তৈরি হয়। আমাদের লক্ষ্য হলো, দেশের আশি শতাংশ মানুষকে টিকা প্রদান করা। টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে—বেশি মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে আগে টিকা প্রদান করা।

আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে ষাটোর্ধ্ব মানুষেরা। এদের অধিকাংশের দেহে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনির জটিলতার মতো এক বা একাধিক রোগ রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এখন পর্যন্ত দেশে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরাই সবচেয়ে কম টিকা পেয়েছেন। এদের চেয়ে বেশি টিকা পেয়েছেন চল্লিশ থেকে ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সীরা এবং তাদের চেয়েও বেশি পেয়েছেন চল্লিশের কম বয়সীরা। অর্থাৎ যাদের জন্য সুরক্ষা বেশি দরকার এখন পর্যন্ত তারাই বেশি অরক্ষিত।

মাস্ক পরার বিষয়টিকে দেশে নীতিগতভাবে সর্বাধিক জোর দেওয়া হয়েছে। মাস্ক পরাকে অভ্যস্ততার অংশ করতে হলে জনসাধারণকে উৎসাহিত, উদ্বুদ্ধ এবং বাধ্য করার প্রক্রিয়া যুগপৎভাবে জারি রাখতে হবে। একইসাথে অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে মাস্ক প্রদানের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
এখন পর্যন্ত দেশে এই কাজগুলো কাঠামোবদ্ধ এবং সংগঠিতভাবে করা হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও উদ্যোগহীনতা লক্ষণীয়। ফলে মানুষ দিনে দিনে মাস্ক পরার কথা ভুলে যাচ্ছে। কেউ কেউ এটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা শুরু করেছে।

একজন মানুষ হাঁচি বা কাশি দিলে যে জলকণাবাহী বাতাস বের হয়ে সেটা তিন থেকে ছয় ফুট দূরে যেতে পারে। এজন্য করোনাকালে একজন মানুষ থেকে আরেকজনের দূরত্ব ছয়ফুট হলে ভালো হয়, নিদেনপক্ষে তিন ফুট হওয়া বাধ্যতামূলক।

মাস্ক পরলে, স্বাস্থ্যবিধি মানলে করোনার ঊর্ধ্বগতির রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়। একইভাবে স্বাস্থ্যবিধির সঠিক চর্চার মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের নিম্নগামীতার গতিকেও ত্বরান্বিত করা যায়।

করোনার সংক্রমণ দিনে দিনে কমছে। লোকজন যদি মাস্ক না পরে, স্বাস্থ্যবিধি না মানে তাহলে কী হতে পারে? দুটি ব্যাপার ঘটতে পারে। প্রথমটি হলো, এখন যে হারে করোনা কমছে সে হারটি দিনে দিনে কমতে থাকবে। এতে করোনাকাল কেবলই প্রলম্বিত হবে। ফলস্বরূপ জীবনহানি, স্বাস্থ্যহানি ও সম্পদহানির অঙ্ক শুধু বাড়তে থাকবে।

দ্বিতীয়ত, করোনার সংক্রমণে আবার ঊর্ধ্বগতি আসবে। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাবে। হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়া ভিড় তৈরি হবে। দেশের সমস্ত কাজকর্ম আবার স্থবির হয়ে পড়বে। জনজীবন নতুন করে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় আক্রান্ত হবে। অর্থাৎ আবার সকলকে ঘোর দুঃসময়ের মুখোমুখি হতে হবে।

এখন পর্যন্ত আমরা খুব অল্পসংখ্যক মানুষকে টিকা দিতে পেরেছি। ফলে স্বাস্থ্যবিধিই আমাদের মূল ভরসা। কিন্তু বর্তমানে সবার মধ্যে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানা ও মানানোর ব্যাপারে ব্যাপক শৈথিল্য ও উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। এর ফল ভয়াবহ হতে পারে। এ অবস্থা চলমান থাকলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী চার থেকে ছয় সপ্তাহ পরে দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি শুরু হতে পারে এবং আট থেকে দশ সপ্তাহ পরে সেটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।

অনাগত এই বিপর্যয়কর অবস্থা রোধ করতে হলে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে কোনো ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশের আশি শতাংশ মানুষকে টিকা প্রদানের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ের চেয়েও কার্যকর।

ডা. লেলিন চৌধুরী ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ