নৈরাজ্য এক ধরনের গৃহযুদ্ধ, তার বলি সবসময় সাধারণ মানুষ। পরিবহন খাতে যে নৈরাজ্য অনাদিকাল থেকে বিরাজমান তার ভিকটিম অতি সাধারণ মানুষ, কারণ এগুলো তারাই ব্যবহার করে। সরকারি আমলা, মন্ত্রী, এমপি বা বড় ব্যবসায়ী এমনকি সাধারণ মানের রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদেরও এগুলো সইতে হয় না, কারণ তারা গণপরিবহন ব্যবহার করেন না।

উচ্ছৃঙ্খলতা ও নৈরাজ্য ছাড়া বাংলাদেশের গণপরিবহন সম্পর্কে আর কোনো শব্দ আসে না। কোথাও বেপরোয়া মত্ত চালক পথচারীর গায়ে গাড়ি তুলে দিচ্ছে তো কোথাও ছোট গাড়িকে মেরে চলে যাচ্ছে, কোথাও বা নিজেরাই মুখোমুখি।

রাজনীতির দুর্বত্তায়ন নিয়ে অনেক আলোচনাই হয়, কিন্তু পরিবহন খাতের দুর্বৃত্তদের হাত থেকে নাগরিককে রক্ষা করার কোনো প্রচেষ্টা কোথাও দৃশ্যমান নয়। কেবল উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, শৃঙ্খলা রক্ষকদের যে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার প্রাথমিক ক্ষমতাটুকুই নেই সেটা এবার ডিজেলের দাম বাড়ার পর পরিবহন মালিকদের আচরণেই স্পষ্ট হয়েছে।

অঘোষিতভাবে ধর্মঘট করে তারা জনগণকে জিম্মি করেছে এবং সরকার দু’দিন মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে রেখে পরিবহন মালিকদের দাবি মেনে নিয়েছে এবং বেশিই মেনেছে। যতটা তেলের দাম বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি ভাড়া বেড়েছে। 

কিন্তু ওদের নৈরাজ্য থামেনি। সরকার যা বাড়িয়েছে তার চেয়ে বেশি নিচ্ছে, মানুষকে মারধর করছে এমনকি ঢাকা শহরে বাসের ভেতর ছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে। এখন সংকট হাফ ভাড়া।

প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা পথে নামছে, কোথাও না কোথাও তাদের সাথে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ হচ্ছে এবং গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা চুপ।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে বাস ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণার পর থেকেই পরিবহনে হাফ ভাড়া নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সাংঘর্ষিক অবস্থা চলছে।

প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা পথে নামছে, কোথাও না কোথাও তাদের সাথে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ হচ্ছে এবং গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা চুপ। কারণ সেই যে বললাম, এই শিক্ষার্থীরা অতি সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়ে। নীতি যেখান থেকে নির্ধারিত হয় তাদের সন্তানরা চলাফেরা করে বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে। 

আইনগতভাবে হাফ ভাড়ার বিষয়টির কোনো ভিত্তি নেই—এমনটাই বলতে চায় সংশ্লিষ্ট মহল। কিন্তু বাংলাদেশের, বিশেষ করে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে এটি একটি চিরায়ত প্রথা।

সড়ক পরিবহন আইনে বলা আছে, সরকার অংশীজনদের সাথে কথা বলে গণপরিবহনের বাড়া ঠিক করবে। এর অর্থ হলো সরকার ঠিক করবে। শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের আদেশটিও সরকার ঠিক করে দিতে পারে যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘বাস কার্ড’ নামে আছে। 

প্রথা কোনো কোনো দেশে আইন হিসেবেই বিবেচিত হয়। এই যে বলছি প্রথা, তার প্রমাণ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ২২/১১/২০২১ তারিখে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্র হিসেবে তিনি নিজেও অর্ধেক ভাড়া দিয়েছেন। তিনি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, তখন বাসগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিত। মন্ত্রী আরও বলেন, বাস কোম্পানি শিক্ষার্থীদের দাবি বিবেচনা করতে পারে। মন্ত্রী যখন বিবেচনার কথা বলেন, তখন আমরা তার কাছে আশা করি তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি আদেশ জারির ব্যবস্থা করবেন। 

২০১৫ সালের অক্টোবরে বিআরটিসির কার্যালয়ে বাস ডিপো ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে এক বৈঠকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমি এই মুহূর্ত থেকে নির্দেশ দিচ্ছি, রাজধানীতে চলাচলরত বিআরটিসির পাশাপাশি অন্যান্য পরিবহনেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেবে। আর না নিলে দায়ী পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

এরপর ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনে তোলপাড় হলো গোটা দেশ। সে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি, যা সরকার বাস্তবায়ন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেখানেও একটি দাবি ছিল, ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। 

পুরনো ছাত্র নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাসে হাফ ভাড়ার প্রচলন ষাটের দশকেই। এই বাস মালিকরা যখন শিক্ষার্থী ছিলেন তারাও হাফ ভাড়া দিয়েছেন। পড়ুয়ারা তাই বলছে, আইনগত ভিত্তি না থাকলেও হাফ ভাড়া তাদের অধিকার। 

২০১৫ সালে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমি এই মুহূর্ত থেকে নির্দেশ দিচ্ছি, রাজধানীতে চলাচলরত বিআরটিসির পাশাপাশি অন্যান্য পরিবহনেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেবে। আর না নিলে দায়ী পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

হাফ ভাড়া নিয়ে আন্দোলন বহুদিনের। দেশ স্বাধীন হওয়ারও আগের। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐতিহাসিক ১১ দফা দাবি আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনকে বেগবান করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ঘোষিত এ ১১ দফা দাবির একটি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া রাখা।

দাবির ১ (ঢ) দফা অনুসারে, ‘ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের আইডেন্টিটি কার্ড দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কন্সেসনে (ছাড়ে) টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও কন্সেসন দিতে হইবে’। বাস ভাড়া সম্পর্কে ধারাটিতে বলা হয়েছে, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের মতো পূর্ব পাকিস্তানেও বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যেকোনো স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলে বাস যাতায়াতেও শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেসন (ছাড়) দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও আধা সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেসন দিতে হইবে’। 

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর, এরপর সরকার বদলেছে অনেকবার। কিন্তু এরকম একটি ঐতিহাসিক দাবি কেন বাস্তবায়ন হলো না, তার একটা জবাব আসা দরকার।

শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিয়ে চূড়ান্ত কোনো আইন কিংবা সিদ্ধান্ত কোনোটাই আসে না, অথচ নিয়মিত এ নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের সাথে ছাত্রদের তর্কাতর্কি হচ্ছে।

২০১৫ সালে সেতুমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিলেন সেটাও কেন বাস্তবায়ন হলো না, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। পরিবহন মালিকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, সরকার আদেশ দিলে তারা মানতে বাধ্য। দেশ ও জাতি আজ সেই আদেশের প্রতীক্ষায়। দেশ এত উন্নয়ন করল, শিক্ষার্থীদের একটা সাধারণ দাবি বাস্তবায়ন করলে নিশ্চয়ই অবনমন হবে না।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি