করোনা মহামারির প্রভাবে বিশ্বজুড়ে শিল্প-বাণিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়লেও ই-কমার্স খাতের ব্যাপক প্রসারে তা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধির বেড়াজালে আবদ্ধ মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটার মাধ্যম হিসেবে ই-কমার্স দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের কাছে দ্রুত পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। এই সুযোগে কিছু সুযোগসন্ধানী অতি মুনাফা লোভী উদ্যোক্তা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান খুলে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ও লোভনীয় প্রস্তাবের ফাঁদ পেতে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা শুরু করে। এ ধরনের প্রতারণার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য, সততা ও বিশ্বস্ততা নিয়ে জনমনে দ্বিধা ও সংকটের সৃষ্টি হয় যাকে বাংলাদেশে ই-কমার্সের মতো একটি উদীয়মান খাতের ভবিষ্যৎ বিকাশের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

গ্রাহকের আস্থা ও বিশ্বাসকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা ও বেড়ে ওঠা ই-কমার্স খাতের বর্তমান বিশৃঙ্খল অবস্থা নিরসন করে ভবিষ্যৎ পথচলাকে মসৃণ করার লক্ষ্যে উদ্যোক্তা ও সরকারের পক্ষ হতে করণীয় কয়েকটি পদক্ষেপ আজকের লেখার আলোচ্য বিষয়।

ই-কমার্স নিয়ে জনসাধারণের মাঝে যে আশঙ্কা ও অনাস্থা তৈরি হয়েছে তা দূর করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে এ খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক সাফল্য ও দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার সক্ষমতা অনেকাংশে নির্ভর করে গ্রাহকের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের উপর, যা একটি প্রতিষ্ঠানের অদৃশ্য বা অস্পর্শনীয় সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের আলোকে ই-কমার্স ব্যবসাকে অন্যান্য প্রচলিত ব্যবসা হতে পৃথকভাবে বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য ব্যবসায়ের আর্থিক সক্ষমতা বিচারে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে তার স্থায়ী ও স্পর্শনীয় সম্পত্তি।

বাংলাদেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক মডেল ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এ খাতের উদ্যোক্তারা গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধিতে যতটা মনোযোগী ছিলেন গ্রাহক সেবার মান নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে ব্যবসায়ের সুনাম অর্জনে ততটাই উদাসীন ছিলেন।

অন্যদিকে ই-কমার্সসহ অপরাপর প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসায়ের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো অস্পর্শনীয় সম্পত্তি (যেমন সুনামও গ্রাহকের আস্থা) সৃষ্টি ও সংরক্ষণের দক্ষতা। গ্রাহকদের সর্বোত্তম মানের সেবা প্রদানের মাধ্যমেই ব্যবসায়ের সুনাম ও গ্রাহকের আস্থা অর্জিত হয়।

বাংলাদেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক মডেল ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এ খাতের উদ্যোক্তারা গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধিতে যতটা মনোযোগী ছিলেন গ্রাহক সেবার মান নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে ব্যবসায়ের সুনাম অর্জনে ততটাই উদাসীন ছিলেন।

অস্বাভাবিক মূল্য ছাড়ের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হলেও সকল গ্রাহককে তাদের চাহিদামতো নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অল্প সময়ে অধিক মুনাফা অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় কতিপয় উদ্যোক্তা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে গ্রাহকদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন যা এই খাতের সকল প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ও নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

ই-কমার্স খাতে গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোক্তাদের গ্রাহক সেবার মান নিশ্চিতকরণে আরও উদ্যোগী হতে হবে। মূল্য ছাড়ের মধুর লোভে যে সকল মৌমাছি গ্রাহকেরা আকৃষ্ট হয় তাদের অধিকাংশই প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী গ্রাহকে পরিণত হয় না। তাই ক্রয়মূল্য বা উৎপাদন মূল্যের থেকে কম দামে পণ্য বিক্রয় করে অল্প সময়ের জন্য বিশাল সংখ্যক গ্রাহককে আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ভিত্তি ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করে। তাই উদ্যোক্তাদের মূল্য ছাড়ের সংস্কৃতি পরিহার করে গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী গ্রাহক তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে।

গ্রাহকের যেকোনো অভিযোগ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে প্রয়োজন সাপেক্ষে তদন্ত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। উদ্যোক্তাদের সততা ও নৈতিকতার সাথে ব্যবসা পরিচালনায় আগ্রহী হতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে যে, সাফল্যের সহজ কোনো রাস্তা নেই।

দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ও লাভজনক একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হলে ব্যবসায়ের নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে গ্রাহকের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হতে হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন প্রতারণামূলক বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে না পারে তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী ও কার্যকর আইনি কাঠামো।

অনেক সময় ব্যবসায়ের স্বতন্ত্র প্রকৃতি ও কার্যক্রমের বৈচিত্র্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করতে হয় ঐ ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণের উপযোগী বিশেষ আইন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালিত হয় সুনিয়ন্ত্রিত আইনি কাঠামোর মধ্যে। আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশে ই-কমার্সের যাত্রা শুরু হয় কোনো ধরনের আইনগত বাধ্যবাধকতা ছাড়াই।

ই-কমার্স মূলত কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন ও বাস্তবায়ন নিয়ন্ত্রিত হয় ১৯৩০ সালের পণ্য বিক্রয় আইন দ্বারা। এই আইনে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়পক্ষের দায়িত্ব ও অধিকার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আইনে অনলাইন লেনদেনকে পণ্য বিক্রয়ের চুক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। যার ফলে অনলাইন লেনদেন নিয়ন্ত্রণে এই আইন কার্যকর নয়।

নীতিগত, আইনগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিকাশের গতিকে ত্বরান্বিত করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের মতো বিশাল জনগোষ্ঠীর এই বাজার অচিরেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

প্রসঙ্গত আইনটি অনেক পুরনো ও আইনের অনেক ধারা অন্যান্য বিশেষ আইন দ্বারা রহিত হওয়ায় ই-কমার্সের মতো আধুনিক ও নতুন ধরনের ব্যবসার জন্য এটি এখন আর প্রযোজ্য নয়। এছাড়াও ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে বিশেষভাবে প্রণীত ২০০৯ সালের ভোক্তা সংরক্ষণ আইনেও অনলাইন লেনদেন সম্পর্কিত কোনো ধারা যুক্ত করা হয়নি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ই-কমার্স ব্যবসায়ের জন্য উপযুক্ত নয়। তাই সরকারের উচিত হবে প্রচলিত আইনগুলোকে সংস্কার করে ই-কমার্সের মতো নতুন, প্রযুক্তিনির্ভর ও উদ্ভাবনী ব্যবসাগুলোকে নিয়ন্ত্রণের উপযোগী করে তোলা অথবা সম্পূর্ণ নতুন আইন প্রণয়ন করা। এছাড়াও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো একটি সংস্থাকে ক্ষমতাসহ তদারকির দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে।

দেশের সকল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের আওতায় আনার পাশাপাশি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়েবসাইট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং ব্যবসাসংক্রান্ত সকল প্রয়োজনীয় তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে ও প্রতারিত গ্রাহকদের আটকে যাওয়া টাকা যতটা সম্ভব তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজগুলো যত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হবে গ্রাহকের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কারণে সমগ্র ই-কমার্স খাত নিয়ে সাধারণ জনগণের মাঝে যে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে তা এই খাতের বিকাশের পথকে সাময়িকভাবে কণ্টকাকীর্ণ করেছে। বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতকে ঘিরে সম্ভাবনার যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে তার সুফল পেতে হলে এ খাতের সাথে জড়িত সকল পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে পথের কাঁটা (জনমনে সৃষ্ট আস্থার সংকট) দূর করতে হবে।

প্রয়োজনীয় নীতিগত, আইনগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিকাশের গতিকে ত্বরান্বিত করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের মতো বিশাল জনগোষ্ঠীর এই বাজার অচিরেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর সেই সাথে বাধাপ্রাপ্ত হবে দেশের উদ্যমী ও মেধাবী তরুণ-তরুণীদের নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন ও সাধ। তাই ই-কমার্সকে ঘিরে সাময়িক যে জটিলতা তৈরি হয়েছে তাকে দীর্ঘায়িত না করে যত দ্রুত সম্ভব সকল পক্ষের স্বার্থ সুরক্ষা করে একটি কার্যকরী সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

ড. রঞ্জন কুমার মিত্র ।। সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়