পুরো নাম তার মোহাম্মদ হানিফ। কিন্তু মানুষ তাকে মনে রেখেছে ‘মেয়র হানিফ’ হিসেবে। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র ছিলেন তিনি। নির্বাচিত হয়েছিলেন লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে। 

মোহাম্মদ হানিফের হৃদয়জুড়ে ছিল রাজনীতি, বুকজুড়ে ঢাকা। চারশ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকা এখন মেগাসিটি। আশুলিয়া, উত্তরা, পূর্বাচল ছাড়িয়ে ঢাকা বিস্তৃত হচ্ছে দ্রুতগতিতে। অথচ বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ঢাকার শেষ সীমানা ছিল ফুলবাড়িয়া রেললাইন, বড় জোর দোয়েল চত্বরের কাছে প্রায় হারিয়ে যাওয়া ঢাকা গেট পর্যন্ত। সেই আদি ঢাকাতেই জন্ম মোহাম্মদ হানিফের। 

পুরান ঢাকার প্রখ্যাত পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি ঢাকার শেষ সরদার আলহাজ্ব মাজেদ সরদার ছিলেন তার শ্বশুর। সব মিলিয়ে ঢাকা মিশে ছিল তার রক্তে। আর ছিল রাজনীতি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজনীতি করে গেছেন আর ঢাকাকে ভালোবেসে গেছেন।

মোহাম্মদ হানিফের ৬২ বছরের জীবনের পুরোটাই জনগণের জন্য উৎসর্গ করা। আজ যখন রাজনীতিবিদরা নানা সুবিধার জন্য, ক্ষমতার জন্য দল বদলান, আদর্শ বদলান; তখন মোহাম্মদ হানিফ হতে পারেন উদাহরণ। সারাজীবন তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করেছেন।

তখন বঙ্গবন্ধু পরিবার অবস্থান মোহাম্মদ হানিফের পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারের বাসায়। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মোহাম্মদ হানিফকে খুব স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন।

ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ দিয়েই তার রাজনীতি শুরু। আর শুরুটা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই। মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সঙ্গী। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বঙ্গবন্ধু পরিবারের দুঃসময়েও পাশে থেকেছেন হানিফ এবং তার পরিবার। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের পর পাকিস্তান সরকার যখন প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে এবং ২৪ ঘণ্টার নোটিশে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে মন্ত্রীপাড়ার বাসা ছাড়ার নির্দেশ দেয়। ভয়ঙ্কর সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায়নি। তখন বঙ্গবন্ধু পরিবার অবস্থান মোহাম্মদ হানিফের পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারের বাসায়। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মোহাম্মদ হানিফকে খুব স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। তাই তো তিনি চাইতেন হানিফ যেন বঙ্গবন্ধুর পাশেই থাকে।

১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিবের দায়িত্ব পান মোহাম্মদ হানিফ। তারপর শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের পাশেই। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে মোহাম্মদ হানিফ খুব কাছ থেকে দেখেছেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম। বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা প্রণয়ন, ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ -এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ -এর নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছিল সাহসী ভূমিকা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া ঢাকা-১২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী সময়ে হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মোহাম্মদ হানিফ। পরবর্তী ৩০ বছর, মানে মৃত্যুর এবং আমৃত্যু সে দায়িত্ব পালন করেছেন।

মুক্তি সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ তো বটেই; স্বাধীন বাংলাদেশেও সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছিলেন সামনের কাতারে। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনেও ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৯৬-এর মার্চের শেষ সপ্তাহের বিএনপি সরকার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে মোহাম্মদ হানিফের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘জনতার মঞ্চ’। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে জনতার মঞ্চ এক অনন্য ঘটনা। সে আন্দোলনের সময় মাঠের রিপোর্টার হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছি মোহাম্মদ হানিফের সাংগঠনিক দক্ষতা। তার ভরাট কণ্ঠের বক্তৃতা সমবেত জনতা শুনতো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।

গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতা থেকে শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়েছেন নিজের জীবনের মায়া না করে। মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্প্লিন্টার গেঁথে যায়।

শুরুতে যেমন বলেছি, জীবনভর নানা দায়িত্ব পালন করলেও অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নগর পিতার দায়িত্ব তাকে মোহাম্মদ হানিফ থেকে ‘মেয়র হানিফ’ বানিয়ে দেয়। ৮ বছরের দায়িত্ব পালনকালে নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ঢাকাকে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে রাখেন অনন্য অবদান। তার আমলে ঢাকার ব্যাপক উন্নয়নে রাস্তা-ঘাট, নর্দমা, ফুটপাত উন্নয়ন ও সংস্কার, নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, আন্ডারপাস, সেতু, ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়। পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় ধানমন্ডি লেক এবং আশপাশের এলাকা। ঢাকার সৌন্দর্য বাড়াতে ফোয়ারা নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি, ছিন্নমূল শিশু কিশোরদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ করেন। না

রীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ছিলেন মেয়র হানিফ। নারী শিক্ষা বিস্তারে লক্ষ্মীবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ। এছাড়াও মহিলাদের মাতৃকালীন সময়ে পরিচর্যার জন্য নগরীতে বেশ কয়েকটি মাতৃসদন নির্মাণ করেন। শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য নির্মাণ করেন পৌর শিশু পার্ক, সংস্কার করেন পুরোনো পার্কগুলো। নগরবাসীকে মশার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিতে নিয়েছেন নানান পদক্ষেপ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাত থেকে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করতে না পারলেও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে আরও অনেকের সঙ্গে মিলে তৈরি করেন মানবঢাল। গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতা থেকে শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়েছেন নিজের জীবনের মায়া না করে। মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্প্লিন্টার গেঁথে যায়। লম্বা চিকিৎসা এবং অপারেশনেও মাথার গভীরে বিধে থাকা সব স্প্লিন্টার অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। ২০০৬-এর ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে সে বছরের ২৮ নভেম্বর পরলোকগমন করেন তিনি। সক্রিয় থাকার শেষ সময়টাও তিনি রাজনীতির মঞ্চেই ছিলেন।

রাজনীতি থেকে রাজনীতিবিদরা হারিয়ে যাচ্ছেন, রাজনীতিবিদদের মধ্য থেকে যখন আদর্শ হারিয়ে যাচ্ছে, চারদিকে যখন সুবিধাবাদীদের আনাগোনা, হাইব্রিডের কচুরিপানায় যখন আটকে যাচ্ছে নৌকার গতি; তখন রাজনীতিতে মোহাম্মদ হানিফের মতো কর্মীবান্ধব, জনসম্পৃক্ত, আদর্শে অবিচল রাজনীবিদদের আরও বেশি করে দরকার। 

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ