ছবি : সংগৃহীত

মাথা জুড়ে ঝাঁকড়া চুলের উচ্ছ্বাস। হাতে গিটার। তীক্ষ্ণ চোখ। বহুদিন গান গাননি জনতার মঞ্চে। এমন একটি মানুষ গেয়ে উঠলেন বাংলাদেশের গান। বাঙালির কাছে অতি পরিচিত সেই নাম, জর্জ হ্যারিসন—বিখ্যাত সংগীত দল দ্যা বিটলসের লিড গিটারিস্ট। বেদনার্ত রবিশঙ্কর যার কাছে সহায়তা প্রার্থনা করেছিলেন। রবিশঙ্কর নিজেও পৃথিবী সেরা সেতার বাদক।

১৯৭১ সালে লক্ষ বাঙালির আর্তনাদকে ভাগ করে নিয়েছিলেন হ্যারিসনের সঙ্গে। হ্যারিসন ভাবলেন কিছু একটা করবেন। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানালেন তিনি যুক্ত থাকলে বাংলাদেশের জন্য কিছু করা যাবে। উদ্যোগ নিলেন কনসার্টের। লিখে ফেললেন গান। পত্রিকায় ছাপা হলো বিজ্ঞাপন। দেয়ালে সাঁটানো হলো পোস্টার।

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট। মেডিসন স্কয়ারে চল্লিশ হাজার শ্রোতার সামনে একে একে জড়ো হলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, লিওন রাসেল, রিঙ্গো স্টার, বিলি প্রেস্টন। আরও ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং ওস্তাদ আল্লা রাখা।

আরও পড়ুন : স্বাধীনতা: বাঙালির ঐতিহ্যের নবায়ন

বিশ্ব সংগীতের ইতিহাসে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এক মাইলফলক হিসেবে আবির্ভূত হলো। সংগীত, সুর ও মানবতাকে এই কনসার্ট বেঁধেছিল মিতালির এক ফিতায়। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ তখনো এক অচেনা রাষ্ট্র। কিন্তু মেডিসন স্কয়ারের সংগীতের প্রবল জোয়ারে পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে গেল একটি নাম বাংলাদেশ।

যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সংগীত তালিকায় এই কনসার্টের অ্যালবাম উঠে গেল শীর্ষে। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে জিতে নিল গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড। রবিশঙ্কর বলেছেন, ‘এক রাতের মধ্যে সারা পৃথিবীর সবাই জেনে গেল বাংলাদেশের নাম।’ সে সময়ের পত্রপত্রিকায় এই খবর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছিল। একটি সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মূল্য তৈরি হয়েছিল এই আয়োজনের।

বিশ্ব সংগীতের ইতিহাসে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এক মাইলফলক হিসেবে আবির্ভূত হলো। সংগীত, সুর ও মানবতাকে এই কনসার্ট বেঁধেছিল মিতালির এক ফিতায়।

সংগীতের শক্তি সম্পর্কে যারা আশাবাদী নন; তারা চমকে গেলেন। রক অ্যান্ড রোলের এই অপ্রথাগত শিল্পীরা কী করে গাইলেন জীবনের গান? এরা তো মাদক, বোহেমিয়ানিজম ও উন্মাদনার শিল্পী; ব্যক্তিজীবন নিয়ে কতশত তাদের পাগলামি! মদির নেশায় ডুবে কী করে তারা বাঁধলেন যুদ্ধজয়ের গাঁথা?

আরও পড়ুন : নির্মোহভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলা কেন জরুরি 

প্রকৃতপক্ষে এরা প্রায় সবাই সর্ষে দানার মতো জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলেছেন। বিটলস সেই কবেই গেয়েছিল, ‘অল ইউ নিড ইজ লাভ (All You Need Is Love)’। তাদের কণ্ঠেই উচ্চারিত হয়েছিল, ‘ভালোবাসা পুরনো/ ভালোবাসা নতুন/ ভালোবাসাই সব/ আর ভালোবাসা তুমি।’

ভালোবাসার এক তুমুল শক্তি ছিল বিটলসের। জর্জ হ্যারিসন সেই ভালোবাসার ভাবুক। তার হাতেই রচিত হয়েছিল ‘গিটারের নীরব কান্না’র গান। হ্যারিসনের বিশ্বাসও ছিল এই, ‘ভালোবাসা দিয়েই আমরা বিশ্বকে বাঁচাতে পারতাম।’

হ্যারিসনের অন্য গানগুলো যতটা কাব্যিক, ‘বাংলাদেশ’ গানটি ততখানি নয়। বরং অনেক বেশিই গদ্য ঘেঁষা, নিরেট বর্ণনা মাত্র; যেন ‘ক্ষুধার রাজ্যের পৃথিবী গদ্যময়।’ অবশ্য রক গানে গদ্যের অবিরল প্রবাহ বয়েই যায়; হয়তো তাই হ্যারিসন সহজতার জন্য বেছে নিলেন এমন গদ্য ও গল্পগন্ধী গান; গল্পটি কেমন?

এক বন্ধু এসে নিজের দেশের উদ্বাস্তু মানুষের দুঃখ ও ক্ষুধার কথা বললেন। তার চোখের কোলে বিষাদ। তিনি জানতেন বন্ধুর এই ব্যথার অনুভূতি তিনি বুঝতে পারবেন না। তবু সবার কাছে সহায়তা প্রার্থনা করছেন; যেন কিছু প্রাণ বাঁচে। বাংলাদেশের মতো এমন দুর্ভোগ তিনি আর দেখেননি। তুমি কি বাড়াবে না তোমার হাত? অনাহারীর মুখে তুমি কি দেবে না রুটি?

আরও পড়ুন : মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় আমাদের ভূমিকা

যারা বাণী প্রধান গানের ভোক্তা তাদের জন্য এ গান নেহাত আহামরি কিছু নয়। কিন্তু শিল্প কখনো কখনো ক্লাসিকতার চাদর সরিয়ে নেমে আসে মাটির পৃথিবীতে। সময়ের প্রয়োজনে বেছে নেয় ভিন্ন স্বর—যে স্বর বেছে নেয় সহজ শব্দ, সরল বাক্য, চেনা উপমা। কনসার্ট ফর বাংলাদেশের ওই মঞ্চেই যেমন করে বাজল ক্লাসিক রবিশঙ্করের ‘বাংলা ধুন’। হ্যারিসনের গান অনেকটা তা-ই।

সবাই বাড়িয়ে দিক সহযোগিতার হাত—এই দরকারি বাক্যটিই উচ্চারণ করে গেলেন হ্যারিসন। কারণ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে শুধু সমরাস্ত্রের প্রয়োজন ছিল না, ছিল অর্থ ও খাদ্যের প্রয়োজন।

পাকিস্তানি নয়া ঔপনিবেশিক শাসন অর্থনৈতিক বৈষম্যের সহজাত সঙ্গী হিসেবে দিয়েছিল শূন্য ঝুলি; আর ৭০-এর ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর মোহনায়। আর তাই ক্ষুধা ও রুটির তৃষ্ণা অস্বীকারের উপায় ছিল না। ক্রম জন্মপ্রাপ্ত বাংলাদেশের বাস্তবতাকে হ্যারিসন সম্ভবত এভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। খানিকটা হয়তো দেখেছিলেন বন্ধু পণ্ডিত রবিশঙ্করের চোখ দিয়ে।

হ্যারিসনের অন্য গানগুলো যতটা কাব্যিক, ‘বাংলাদেশ’ গানটি ততখানি নয়। বরং অনেক বেশিই গদ্য ঘেঁষা, নিরেট বর্ণনা মাত্র; যেন ‘ক্ষুধার রাজ্যের পৃথিবী গদ্যময়।’

আর তা দেখারও কথা। বাঙালি এই সেতার বাদকের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে হ্যারিসন পেয়েছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সম্পর্কিত ধারণা। বিটলসের সংগীতায়োজনে জোড় বেঁধেছিল ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা, বাদ্যযন্ত্র, দর্শন। বাংলাদেশ গানে এসবের দৃশ্যমান কোনো প্রয়োগ নেই। সেটি বড় বিষয়ও নয়।

আরও পড়ুন : ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আজও চলছে

সবচেয়ে বড় বিষয়, শিল্প ও শিল্পীর সম্পৃক্তি ও সমাবেশ। হ্যারিসন উদাহরণ সৃষ্টি করে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন প্রয়োজনে শিল্পও হয়ে ওঠে জনতার ঐক্যের মিলনবিন্দু। কোথায় ইংল্যান্ড, কোথায় আমেরিকা, কোথায় বাংলাদেশ—সাত সমুদ্র তেরো নদীর এপার ওপারের মানুষ জেনে গেল বাংলাদেশ ভালো নেই। রাজনীতির অসুখ আঁকড়ে ধরেছে আষ্টেপৃষ্ঠে।

এই জানাটাও জরুরি। না জানলে মানুষ বুঝতে পারবে কী করে কাশ্মীর ভালো নেই, উইঘুর ভালো নেই, ফিলিস্তিন ভালো নেই, সিরিয়া ভালো নেই, কুর্দিস্তান ভালো নেই, আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গরা ভালো নেই, বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত ‘সংখ্যালঘু’রা ভালো নেই। ভালো না থাকার বেদনায় ‘অপর’ যদি শামিল হয়ে থাকে, তাহলে তো সৌভাগ্য।

হ্যারিসন আর তার বন্ধুরা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মর্মের বেদনাকে। তাদের হাত ধরে এই শিক্ষাও সভ্যতা পেয়েছে যে, গানেরও শক্তি আছে; গান কেবল আধ্যাত্মিক চিন্তা কিংবা হৃদয় প্রশমনের শক্তির জোগানদাতা নয়, গানের শক্তি হতে পারে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক।

মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো ঠিক এই কারণেই শক্তিশালী। সংগীত উদ্দীপ্ত করেছিল যুদ্ধের ময়দান এবং ময়দানের বাইরের জনতাকে। দেশ ও জনতার প্রতি বিদ্যমান সত্যিকার দায়বোধ ও আবেগকে উসকে দিয়েছিল গান। আর যুদ্ধ যখন আরম্ভ হয়ে যায় তখন সবকিছুই চলতে থাকে যুদ্ধের নিয়মে; রক্তপাত ও মৃত্যু সেখানে অনিবার্য। কিন্তু জীবনের নিয়মও ফুরিয়ে যায় না। তাই গানেরও জন্ম ঘটে, শিরায় ধমনিতে ছুটে যায় সুরের বিস্তার।

আবার যুদ্ধও ছড়িয়ে পড়ে স্থান থেকে স্থানান্তরে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই ভাবেই মানুষ যুদ্ধে অংশ নিতে পারে। জর্জ হ্যারিসনকে ভাবা যায় এই প্রেক্ষাপটে। তার গান ও সুর, উদ্যম ও আয়োজন নিঃসন্দেহে সংস্কৃতির লড়াইকে বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেয়।

সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়