ছবি : সংগৃহীত

বাংলার মুক্তিসংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ ধারা সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হওয়া দেশভাগের মর্মান্তিক ভুলটি পরবর্তী ২৩ বছরে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে সংশোধন করা হয়। জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের কবর রচনা করে প্রতিষ্ঠিত হয় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামে সংস্কৃতি অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সাতচল্লিশ পরবর্তী সময় থেকে, সংস্কৃতি ছিল তার প্রাণরস।

১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তৎকালীন পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক আত্ম-পরিচয়ের মূলসূত্রটি বিকশিত হতে থাকে। পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলন যত জোরদার হয়েছে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনও তার সঙ্গে পথ চলেছে সমান তালে। ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে একে একে সৃষ্টি হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।

ছায়ানট, ক্রান্তি, সৃজনী বা উদীচীর মতো সংগঠনগুলো মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেই অসাম্প্রদায়িক বহুত্ববাদের আদর্শকে সামনে রেখেই মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করেছিল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে জেগে ওঠা মানুষের মননে স্বাধীনতার সত্যিকারের অর্থ প্রতিষ্ঠা করতেই স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মীরা কাজ শুরু করেছিলেন। একই সঙ্গে মুক্তিসংগ্রামের আদর্শ প্রতিষ্ঠাও ছিল একটি বড় লক্ষ্য। কেবল সার্বভৌম রাষ্ট্রই নয়, স্বাধীন ও সংস্কৃতিবান মানুষও যে স্বাধীনতার অন্যতম পরিচায়ক, সে সময়ের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডে তার প্রতিফলন পাওয়া যায়।

ছায়ানট, ক্রান্তি, সৃজনী বা উদীচীর মতো সংগঠনগুলো মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেই অসাম্প্রদায়িক বহুত্ববাদের আদর্শকে সামনে রেখেই মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করেছিল।

বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় যতগুলো সাংস্কৃতিক উদ্যোগ রাষ্ট্র গ্রহণ করেছিল, তার একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক মানসের পরিবর্তে স্বদেশি মানস গঠন। বঙ্গবন্ধু যেমন সে সময়ে তার বিভিন্ন বক্তৃতায় ইংরেজ ও পাকিস্তান উপনিবেশের চিন্তাধারা ঝেড়ে ফেলে স্বাধীন দেশের জন্য নব মানসিকতার কথা বলেছিলেন, তৎকালীন সংস্কৃতিকর্মীরাও এ বিষয়টি কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন।

নব্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে সরকারের উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমি গঠনের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল এবং এর প্রস্তাব ও সার্বিক কার্যক্রমের দায়িত্ব সংস্কৃতিকর্মীদের ওপরই দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, চিত্রশিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান, সঙ্গীতজ্ঞ ও শিক্ষক সন্‌জীদা খাতুন এবং সংস্কৃতিজন সৈয়দ হাসান ইমাম— এই চারজনের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজকের শিল্পকলা একাডেমি। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছিল, পঁচাত্তরের নির্মম ট্র্যাজেডির পর সে লক্ষ্যে আর স্থির থাকা যায়নি।

আলোচনার এ পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডের একটি সুনিশ্চিত পার্থক্য তৈরি করা যায়। ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলেছে কিন্তু জনগণের মননের পরিবর্তনের জন্য যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন, নানা কারণেই তা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ১৯৭৫ সালের পর চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক রোষানলে পড়ে। একদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সূচনা, অন্যদিকে সংবিধান থেকে ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ স্তম্ভ দুটোকে বাদ দেওয়া— এগুলোর সমন্বয়ে জিয়াউর রহমানের সামরিকতন্ত্র পাকাপোক্ত হলেও বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিকাশ ধারা নির্মমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি দর্শনের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছিলেন, সেই সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদই অব্যাহত রাখা হয় পঁচাত্তরের পর।

জিয়াউর রহমান ও এরশাদ, দুই সামরিক সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় মদদে সাংস্কৃতিক পরিবেশনাকেই সংস্কৃতির একমাত্র রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠার অপপ্রয়াস চালানো হয়। কিন্তু সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারা তাতে স্তিমিত হয়নি, বরং নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সংস্কৃতি আবারও তার অসীম শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে প্রেরণা দিয়েছে।

প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সংগঠন ও জোট এবং মুক্তিসংগ্রামের আদর্শই যে বাংলার মানুষের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য, তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত থেকেছে। তবে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময়ের সামরিক দুঃশাসন সংস্কৃতির পথে কতগুলো গভীর ক্ষত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।

জিয়াউর রহমানের পথ ধরে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হলো, অর্থাৎ জাতিগত সংস্কৃতি বিকাশের পথ ও বহুত্ববাদের দর্শন আরও সংকুচিত হয়ে গেল।

সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বৃত্তটা যত ছোট হয়েছে, মৌলবাদের রাস্তা তত বড় হয়েছে। এ কারণেই সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা মৌলবাদীদের প্রধান লক্ষ্য।

যাত্রা শিল্পের মতো শক্তিশালী সাংস্কৃতিক মাধ্যম, যার হাত ধরে বাংলার মাঠে-প্রান্তরে পৌঁছে দেওয়া যেত সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা, তাকে ক্রমাগত বিতর্কিত করে একসময় প্রান্তিক করে ফেলা হলো। এই পূর্ব-পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার হলো আমাদের বাউল সমাজ ও লোক-সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিল্পীরা।

এই গভীর কিছু ক্ষত নিয়েই নব্বই পরবর্তী বাংলাদেশের সংস্কৃতি সামনের দিকে এগিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সে ক্ষতগুলো এখনো সারিয়ে তোলা হয়নি। আজ ৫০ বছরের বাংলাদেশে থিয়েটার এক নবমাত্রায় উন্নীত হয়েছে।

আমাদের সঙ্গীত, নৃত্য ও চলচ্চিত্রের বিকাশ ঘটেছে। টেলিভিশনের ব্যাপ্তি নিঃসন্দেহে সাংস্কৃতিক বিস্তারের মুকুটে যোগ করেছে নতুন পালক। গত কয়েক বছরে ওটিটি মাধ্যম এই ব্যাপ্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সবই ৫০ বছরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপ্তি।

কিন্তু সাংস্কৃতিক বোধ? যাকে অবলম্বন করেই মুক্তিসংগ্রামের পথ তৈরি হয়েছিল। যে বোধকে অবলম্বন করেই বাংলার মানুষ বারবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, জয় লাভ করেছেন। সেই সাংস্কৃতিক বোধ সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মতো ব্যাপ্ত হচ্ছে না।

একসময় যাত্রাশিল্প, জারি-সারি-ভাটিয়ালি গান আমাদের দেশের সর্বস্তরে যেভাবে আলো তৈরি করেছিল, আজ সে বাতিঘর নিজেই অন্ধকার। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদীরা তাদের সাম্প্রদায়িক আদর্শের বিস্তার ঘটাচ্ছে।

আমরা ৫০ বছরের বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান, হলি আর্টিজানের হত্যাকাণ্ড, উদীচী ও ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মতো বীভৎস ঘটনা দেখেছি। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বৃত্তটা যত ছোট হয়েছে, মৌলবাদের রাস্তা তত বড় হয়েছে। এ কারণেই সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা মৌলবাদীদের প্রধান লক্ষ্য।

তবে মৌলবাদীদের কাছে বাংলার সংস্কৃতি কোনোদিন হার মানেনি। এ দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীরা অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে আলো ফিরিয়ে এনেছেন। সে আলোই আমাদের পথ দেখাবে শতবর্ষের দিকে।

সঙ্গীতা ইমাম ।। শিক্ষক, শিশুসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী