আমরা অদ্ভুত এক দুঃসময় পার করছি। রাজনীতিবিমুখ একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ রাজনীতির কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে, না না, আমি রাজনীতি পছন্দ করি না। রাজনীতির প্রতি নতুন প্রজন্মের এই অনীহার অনেকটা দায় আমাদেরও আছে।

আমাদের সুশীল সমাজের বড় একটা অংশও রাজনীতির প্রতি বিরাগ পোষণ করেন। এই বিরাগের যথেষ্ট যৌক্তিক কারণও আছে। রাজনীতি অনেকদিন ধরেই রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। রাজনীতি এখন ব্যবসায়ী, মাস্তান, চাঁদাবাজ আর দুর্বৃত্তদের দখলে। রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করার বদলে আমরা পরিত্যক্ত করে ফেলেছি। অথচ আমাদের স্বাধীনতা, অগ্রগতি, উন্নতি সবটাই এসেছে রাজনীতির হাত ধরে, রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে।

একাত্তরে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু তার আগে আছে ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল বঞ্চনা, বৈষম্য আর শোষণের বিরুদ্ধে। ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

জন্ম থেকে বিকাশ পর্যন্ত বাঙালি চরম রাজনীতিনিষ্ঠ জাতি। কিন্তু রাজনীতির উল্টো যাত্রাটা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই রাজনীতিবিদদের হাত ধরেই। ছাত্রলীগের অন্তর্কলহ থেকে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল জাসদ। তাদের জন্মটা হয়েছিল প্রবল প্রতাপের সাথেই। কিন্তু একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে রাজনীতিবিদদের যে ভূমিকা রাখার কথা, জাসদ করে তার ঠিক উল্টোটা।

রাজনীতির নামে তারা সন্ত্রাস কায়েম করে। থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন, এমপিকে হত্যা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা ঘেরাও, বিদ্রোহের নামে সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যা, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণের চেষ্টা- সব ধরনের অপকর্মই করেছে জাসদ। তাতে তাদের কোনো লাভ হয়নি। এই অরাজকতার পথ ধরে স্বাধীন দেশে সামরিক শাসনের আগমন ঘটে।

সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমেই বাংলাদেশের রাজনীতির উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় প্রায় দুই দশকের অন্ধকার স্বৈরশাসনের। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রীতিমত ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেন।

রাজনীতি অনেকদিন ধরেই রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। রাজনীতি এখন ব্যবসায়ী, মাস্তান, চাঁদাবাজ আর দুর্বৃত্তদের দখলে। রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করার বদলে আমরা পরিত্যক্ত করে ফেলেছি।

জিয়া এবং এরশাদ একই স্টাইলে রাজনীতিতে অর্থ, অস্ত্র, সুবিধাবাদ; নির্বাচনে হোন্ডা-গুন্ডা-ডান্ডার আমদানি করেন। ক্যান্টনমেন্টে বসে তারা রাজনীতি করেন, ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ চর্চা করেন। তবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি আবার কিছুটা মূলধারায় ফিরে আসে। জনগণের পাশে থেকে, জনগণকে সাথে নিয়ে জনগণের দাবি আদায়ই রাজনীতির লক্ষ্য।

দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারের পতন ঘটে। নতুন আশায় বুক বাধে গোটা জাতি। কিন্তু প্রায় দুই দশকে সামরিক শাসকরা নিজেদের স্বার্থে রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়নের বিষ ঢুকিয়েছেন, ততদিনে তা ছড়িয়ে গেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অত সহজে তা দূর হওয়ার নয়।

স্বৈরাচারের পতন ঘটলেও গণতন্ত্রের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি মেলেনি। সংসদে আর রাজপথে দুই দলের পাল্টাপাল্টি, হরতাল-অবরোধ থামিয়ে দেয় দেশের অগ্রগতির সকল সম্ভাবনা। ১৯৯১ থেকে ২০০৬ এই দীর্ঘ সময়ে দুই দলের অসহিষ্ণুতা, আন্দোলনের নামে সহিংসতায় মানুষ রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

ছাত্র রাজনীতির বিশাল ঐতিহ্য রয়েছে বাংলাদেশে। ৫২ থেকে ৯০- সকল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, ন্যায্য আন্দোলনে ছাত্ররা সবসময় ছিল সামনের কাতারে। কিন্তু স্বৈরাচার পতনের পর থেকে ছাত্র রাজনীতি যেন খসে পড়া তারা, লক্ষ্যহীন জাহাজ। আসলেই ছাত্রদের সামনে কোনো মহৎ লক্ষ্য না থাকায় তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি, খুন-খারাবিতে ব্যস্ত হয়ে যায়।

ছাত্রনেতারা হন মাফিয়া নেতাদের লাঠিয়াল। আগে সবাই ছাত্রনেতাদের সম্মান করে সালাম দিত, এখন ভয় পেয়ে সালাম দেয়। নেতারাও জানে সবাই তাদের ভয় পায়, তারাও এই ভয়টা জারি রাখতে চায়। হলে হলে যে গেস্টরুম কালচারের কথা শুনি, সে তো এই ভয় দেখানোরই কৌশল। কেউ ভালোবেসে জয় করতে চায় না। সবাই ভয় দেখিয়ে জয় করতে চায়।

৯০ থেকে ২০০৬ এই সময়ের ছাত্র রাজনীতির দুর্দশা দেখে কেউ আর ভয়ে রাজনীতি বা ছাত্র রাজনীতির কাছে ঘেষতে চায় না। বলা ভালো, রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে জনমত গড়ে ওঠে। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে গণভোট হলে রাজনীতি হেরে যাবে বিপুল ভোটে।

অবস্থা খারাপ হতে হতে ২০০৬ সালে এসে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে সেনা সমর্থনে অন্যরকম এক তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে ক্ষমতায়। রাজনীতি বিমুখতার জনপ্রিয় স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয় তারাও। দুই নেত্রীকে মাইনাস করার ফর্মুলা উঠে আসে তাদের নিজ নিজ দল থেকেই। পর্দার সামনে-পেছনে নানান ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তবে শেষ পর্যন্ত জয় হয় রাজনীতিরই।

উন্নয়ন অবশ্যই চাই; তার আগে চাই গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদ করার অধিকার। মাথা নিচু করা নির্বিকার প্রজন্ম দেশের জন্য ভালো নয়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে বাংলাদেশে একটা নতুন অধ্যায়ের যাত্রা শুরু হয়েছে, যার সাথে আগের কোনো মিল নেই। 

স্বৈরাচার পতনের পর একবার বিএনপি, একবার আওয়ামী লীগ- এভাবেই চলছিল। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই। আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় দফা ক্ষমতায় আছে। খুব যে জনপ্রিয়তার জোরে তারা ক্ষমতায় আছে, এমন দাবি আওয়ামী লীগাররাও করেন না; আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে কৌশলের জোরে।

২০১৪ সালের বিএনপি নির্বাচনে আসেনি। ফাঁকা মাঠে প্রার্থীবিহীন, ভোটারবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও তাদের সিরিয়াস মনে হয়নি। বরং আওয়ামী লীগের কৌশল বুঝতে বুঝতেই বিএনপি নেমে আসে সিঙ্গেল ডিজিটে। নির্বাচনী ক্যুতে আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। আপনি পছন্দ করেন আর অপছন্দ করেন, মানতেই হবে বাংলাদেশে রাজনীতি পাল্টে গেছে চিরদিনের জন্য। ২০০৬ সালের গতিজড়তায় বিএনপি ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভাঙচুর, পেট্রল বোমা চালিয়ে যায়। কিন্তু গত পাঁচ বছরে রাজপথ শান্ত। হরতাল-অবরোধ-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ-পেট্রল বোমা এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীত কাল।

অনেকে মনে করেন, রাজনীতিকে মাঠ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার দায় বিএনপির। তাদের অক্ষমতার কারণেই রাজনীতি আজ রাজপথ থেকে অনেকটাই নির্বাসিত। তবে দায় একা বিএনপির নয়। গত একযুগে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি-জামায়াতের ওপর আইনি ও বেআইনিভাবে দমন-পীড়নের যে স্টিম রোলার চালিয়েছে; তার নজির মেলা ভার। সরকারের হামলা-মামলা, গুম-খুনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তি নিঃশেষিত হয়ে গেছে।

অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ কখনো বিরোধী দলে গেলে আবার জ্বালাও-পোড়াও শুরু হবে। কিন্তু আমার ধারণা, বাংলাদেশের রাজনীতি একেবারেই বদলে গেছে। একসময় সোনার হরিণ হয়ে ওঠা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থেকে মানুষ যে স্বস্তি পেয়েছে, সেটা তারা হারাতে চাইবে না। 

এটা মানতে দ্বিধা নেই, টানা তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকায় বাংলাদেশ উন্নয়নে মোমেন্টাম পেয়েছে। গত এক দশকে অবিশ্বাস্য গতিতে উন্নয়ন হয়েছে, যা আগের চার দশকে হয়নি। আর এই সুযোগে আওয়ামী লীগের মাঠের নেতারাও আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র-এই সর্বনাশা তত্ত্ব আওড়াতে লাগলেন। এটা মারাত্মক ভুল। টেকসই উন্নয়নের জন্য চাই শক্ত গণতন্ত্র। উন্নয়ন অবশ্যই চাই; তার আগে চাই গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদ করার অধিকার। মাথা নিচু করা নির্বিকার প্রজন্ম দেশের জন্য ভালো নয়।

শুরুতে যে রাজনীতি বিমুখতার কথা বলছিলাম, সে ভয়ংকর প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আপনি যে আপনার মেধাবী সন্তানকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখলেন, সে বিসিএস দিয়ে সচিব হবে। আর যে দুর্বৃত্তের হাতে ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে দিলেন সে পরে এমপি হবে, মন্ত্রী হবে।

নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব কিন্তু রাজনীতিবিদদেরই। তাই আমাদের সবাইকে মিলে রাজনীতিকে দুর্বৃত্তমুক্ত করতে হবে, পরিচ্ছন্ন করতে হবে। রাজনীতিকে দূরে ঠেলে দেওয়া যাবে না, দুর্বৃত্তদের কাছে লিজ দেওয়া যাবে না। কারণ রাজনীতিই আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে, রাজনীতিই আমাদের শেষ ভরসা।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com