রিয়াজ ভাইয়ের সাথে শেষ দেখাটা ছিল এক পলকের জন্য। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত। প্রতিবছর ৩০ নভেম্বর রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পেশাগত ব্যস্ততার কারণে এখন আর রিপোর্টার্স ইউনিটি বা প্রেসক্লাবের দিকে যাওয়া হয় না। কিন্তু আমি এই অনুপস্থিতির ঘাটতি পুষিয়ে দেই ভোট দিতে গিয়ে।

প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি, বিএফইউজে, ডিইউজেসহ সাংবাদিকদের সবগুলো সংগঠনের নির্বাচনের দিন ভোট দিতে যাই আমি। তাতে অনেকের সাথে দেখা হয়ে যায়। নিয়মিত অনুপস্থিতিটা আর চোখে লাগে না। এবারও রিপোর্টার্স ইউনিটির ভোট দিতে গিয়ে ভোট কেন্দ্রের ভেতরে রিয়াজ ভাইয়ের সাথে দেখা। তিনি সম্ভবত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন।

ব্যালট পেপার নেওয়ার পর এক পলক দেখা। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে গল্প করার সময় নেই। সালাম দিলাম। জবাবে তিনি স্নেহমাথা চাহনি দিলেন। সেই চাহনিই স্মৃতিতে গেঁথে থাকল। যদি জানতাম শেষ দেখা, তাহলে নিয়ম ভেঙে হলেও একটু কথা বলে আসতাম।

একসময় সাংবাদিকতা ছিল মহৎ পেশা। মানুষ সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত। কারণ তখন রিয়াজউদ্দিন আহমেদের মতো আদর্শনিষ্ঠ মানুষেরা সাংবাদিকতা করতেন।

শুধু রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেই নয় রিয়াজউদ্দিন আহমেদ সত্যিকার অর্থেই ছিলেন সাংবাদিকদের অভিভাবক। এখনকার সাংবাদিকদের অভিভাবক প্রজন্মের শেষ কয়েকজনের একজন তিনি। রিয়াজউদ্দিন আহমেদরা ছিলেন বলেই, আমরা তবু সাংবাদিকতা নিয়ে কিছু গর্ব করতে পারতাম। একের পর এক মাথার ওপর থেকে ছায়ারা সরে যাচ্ছেন আর সাংবাদিকতা আরও বেশি নেতৃত্বহীন, গন্তব্যহীন হয়ে যাচ্ছে।

একসময় সাংবাদিকতা ছিল মহৎ পেশা। মানুষ সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত। কারণ তখন রিয়াজউদ্দিন আহমেদের মতো আদর্শনিষ্ঠ মানুষেরা সাংবাদিকতা করতেন। এখন মানুষ সাংবাদিকদের গালি দেয়, ভয় পায়। কারণ সাংবাদিকতা এখন দলনিষ্ঠ, স্বার্থনিষ্ঠ, এজেন্ডানিষ্ঠ। সাংবাদিকতা সত্যি বদলে গেছে। যত দিন যাচ্ছে, সাংবাদিকতার পতনটা তত দ্রুত হচ্ছে।

আমাদের এখানে কিছু সাংবাদিক আছেন, যারা মূলত নেতা। বছর বছর তারা নির্বাচন করেন। সাংবাদিকতা নয়, নেতাগিরি করাই তাদের মূল কাজ। কিন্তু এই নেতাদের মূল যে পেশা সেখানে তাদের খুঁজে পাওয়া ভার। রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি চারবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। সভাপতিত্ব করেছেন অবিভক্ত বিএফইউজে ও ডিইউজেরও। নেতৃত্বে তুখোড় রিয়াজ ভাই কাজেও তুখোড় ছিলেন।

১৯৬৮ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইংরেজি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই ছিলেন দারুণ পারদর্শী। ছিলেন দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস এবং দ্য নিউজ টুডে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। নেতৃত্বে, আদর্শে, দক্ষতায় তিনি ছিলেন সত্যি অনন্য।

তার পরিচয় দিতে গিয়ে যে লিখলাম ‘অবিভক্ত বিএফইউজে ও ডিইউজে’, এই অবিভক্ত শব্দেই রোপিত হয়েছে সাংবাদিকতার অধঃপতনের বীজ। শুনতে অবাক লাগতে পারে, একসময় বাংলাদেশের সাংবাদিকরাও অবিভক্ত ছিলেন। স্বৈরাচার এরশাদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছিল অবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নই।

রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি চারবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। সভাপতিত্ব করেছেন অবিভক্ত বিএফইউজে ও ডিইউজেরও। নেতৃত্বে তুখোড় রিয়াজ ভাই কাজেও তুখোড় ছিলেন।

১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ডা. মিলন নিহত হওয়ার পরদিন মানে ২৮ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশের সকল পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ থাকে। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পতনের পর ইত্তেফাক আর সংবাদ তাৎক্ষণিক টেলিগ্রাম বের করলেও পত্রিকার নিয়মিত প্রকাশনা শুরু হয় ৭ ডিসেম্বর থেকে।

ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক ইউনিয়নের শক্তিটা টের পেয়েছিলেন এরশাদ। সাংবাদিকতার শুরুর দিকে আমরাও দেখেছি, মালিকপক্ষ ইউনিয়নকে ভয় পেত। কোথাও কোনো অন্যায় অবিচার হলেই সাংবাদিক নেতারা ছুটে যেতেন। গণতান্ত্রিক আমলেই সাংবাদিকরা আলাদা হন, ইউনিয়ন বিভক্ত হয়। এই বিভক্তিতেই সাংবাদিক ইউনিয়নের শক্তি শেষ, অধঃপতনের শুরু।

বাংলাদেশে এখন দুটি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক-বিএফইউজে, দুটি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজে। একটি আওয়ামী লীগ সমর্থক, আরেকটি বিএনপি-জামায়াত সমর্থক। সাংবাদিকতার মূল কথা যেখানে বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা; সেখানে সাংবাদিকরা এখন প্রবলভাবে বিভক্ত। আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকের চোখে দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে, আওয়ামী লীগের কোনো দোষ তাদের চোখে পড়ে না।

বিএনপিপন্থী সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও উল্টোটা সত্যি। সাংবাদিকতা যখন একচোখা, তখন আর তারা সমাজের দর্পণ হতে পারেন না। বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়ে যায় দলবাজির স্রোতে। বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়ন আসলে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ সংগঠনের ভূমিকা পালন করে।

সাংবাদিক নেতাদের বক্তব্যের সাথে যুবলীগ নেতার বক্তব্যের ফারাক থাকে না। নানারকম প্রাপ্তির আশায় সাংবাদিক নেতারা দলীয় আনুগত্য প্রমাণে ব্যাকুল থাকেন। এই বিভক্তির স্রোতে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন রিয়াজ ভাই। আর সবার মতো তাকেও বিভক্তির শিকার হতে হয়েছে।

তিনি বিএনপিপন্থী সাংবাদিক ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে তার বলায়, কথায়, লেখায় পেশাদারিত্বে কোনো ঘাটতি দেখিনি কখনো। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করতেন যুক্তি দিয়ে, ভালো কাজের প্রশংসাও করতেন। একজন সত্যিকারের সাংবাদিকের তেমনই হওয়া উচিত।

একজন সাংবাদিকের অনেক চোখ থাকবে, সব দলের ভুলত্রুটিই তার চোখে পড়বে। একচোখা মানুষ, দলীয় আনুগত্যে অন্ধ মানুষ কখনো ভালো সাংবাদিক হতে পারেন না। এখন সাংবাদিকতায় একচোখা মানুষের ভিড় বেশি। রিয়াজউদ্দিন আহমেদের মতো সাংবাদিকের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। রিয়াজ ভাইয়ের চলে যাওয়া তাই আমাদের অভিভাবক শূন্য করে দিল।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com