রিকশা আস্তে চলছিল না, চলছিল দ্রুতই। আমি রাস্তা পার হচ্ছি। আধেক পেরিয়ে সড়কে বায়ে চোখ রাখতেই দেখি—অসংখ্য রিকশার ভিড়ে একটি দ্রুতগামী। রিকশার সওয়ার এলোমেলোভাবে দু’দিক দেখতে দেখতে আসছেন। আমি ঔ রিকশার ভয়েই পথে নামছি না। কিন্তু উড়ালপঙ্খী বাহন আমার কাছে এসেই থমকে দাঁড়াল, আয়। চল।

জানতে চাই, কোন দিক থেকে আসলেন? তিনি বললেন, ভুলে গেছি। বললাম, যাচ্ছেন কোথায়? বললেন, ঠিক করিনি। তিনি তখনো দুই দিকে কি বা কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন। জানতে চাই, খুঁজছেন কাউকে? অস্ফুট উত্তর, হুম। বলি, কাকে খুঁজছেন? এবার আমার দিকে ফিরে বললেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।

তারপর বললেন, টেলিভিশনে গিয়ে লেখা ছেড়ে দিলি? বললাম, না দাদা, ছাড়িনি। বললেন, বেশ। আমি জানতে চাইলাম, মেয়ে তুমি ওভাবে তাকালে কেন’র মেয়েটা কে দাদা? তিনি তখন আসমানের দিকে তাকালেন।

আরও পড়ুন : আইয়ুব বাচ্চু : রুপালি গিটার ফেলে 

আসমানে তখন কমলা জামদানির কারুকাজ। দাদা আমার হাতের ওপর হাতের পরশ দিয়ে বললেন, তোর কী মনে হয়? বললাম, একেকবার একেকজনের মুখ ভেসে ওঠে। আমার দেখার বাইরেও তো আপনার কতজন ছিল। এখন আছে।

আচ্ছা দাদা, প্রেমিকারা কখনো সাবেক হয়? দাদার চোখে মুগ্ধতার হাসি। যেন সৌন্দর্যের ভাঁজ খুলে পড়ছে কোনো প্রিয়তমার। দাদা বললেন, ভুল দরজায় কড়া নাড়লেও, কান্নার রঙ ছুঁয়ে গেলেও প্রেমিকারা কখনো সাবেক হয় না।

আচ্ছা দাদা, প্রেমিকারা কখনো সাবেক হয়? দাদার চোখে মুগ্ধতার হাসি। যেন সৌন্দর্যের ভাঁজ খুলে পড়ছে কোনো প্রিয়তমার। দাদা বললেন, ভুল দরজায় কড়া নাড়লেও, কান্নার রঙ ছুঁয়ে গেলেও প্রেমিকারা কখনো সাবেক হয় না। জানতে চাই, আমরা কি বাড়ি ফিরি, ফিরে যাই সেই প্রেমিকাদের কাছে?

আকাশ এখন কান্না ভেজা। দাদা কোনো প্রেমিকার কাছে হৃদয়ের দাবি রেখেই হয়তো বলেছিলেন, বাড়ি ফেরা কি হয়েছে, হয়তো বাড়ি ফেরা হলো না কোনো প্রেমিকার বাড়িতেই। সেই বিকেল হয়তো ছিল বছরের সংক্ষিপ্ত বিকেল।

আমাদের দেখা হয়েছিল নয় বছর পর। দাদা তখন নগর গ্রাম মাতানো বাউল। বরাবরই যিনি দলছুট, তিনিই প্রেমের নতুন স্বরলিপি পড়ে যাচ্ছিলেন তখন। একই শহরে থেকেও, শহরের নষ্টামি দূরে রেখেছিল আমাদের। সেদিনও দ্রুতগামী রিকশা থেকে লাফিয়ে আমাকে চলে আসতে হয়েছিল সময়ের অনিবার্যতায়। দাদাকেও আমার ছেড়ে আসতে হয়েছিল পেশাগত জীবনের অনিবার্য কারণে।

আরও পড়ুন : আজম খান : আসি আসি বলে তুমি আর এলে না 

ভোরের কাগজে সেই তিনের কলাম থেকে শুরু করে সাময়িকী ‘মেলা’। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭’র যাত্রায় দাদা কেবল নিকটবর্তী হয়েছেন। কেঁচো খুঁড়তে, প্রধান ফিচার, তারকাদের সাক্ষাৎকার বৈঠকে যেমন নিজে লিখেছি। তেমনি দাদা অন্যদের কাজ শেখানোর দায়িত্বও দিয়েছিলেন।

নতুন কেউ ফিচারের উঠানে এলেই, দাদা আমার দিকে ঠেলে দিতেন। তাদের মাঠে নিয়ে যাওয়া, লেখা ধরিয়ে দেওয়ায় দাদা ভরসা রাখতেন।
দাদাকে দেখে প্রথম চমকে ওঠা, নয়া পল্টনের জুয়েল হাউজে ভোরের কাগজ অফিসে। তিনি টেবিলে আঙুল ঠুকে গাইছিলেন—‘এই নষ্ট শহরে নাম না জানা যেকোনো মাস্তান’। ঝাঁকড়া চুলের দাদা’কে দেখে আমার ফরহাদ মজহারের লেখা এই গানের সেই কোনো এক মাস্তানই মনে হয়েছিল।

নতুন কেউ ফিচারের উঠানে এলেই, দাদা আমার দিকে ঠেলে দিতেন। তাদের মাঠে নিয়ে যাওয়া, লেখা ধরিয়ে দেওয়ায় দাদা ভরসা রাখতেন।

দাদা যখন দলছুট শুরু করেন। তখন আমি দাদা’র কাছ থেকে বেশ দূরে। অন্য কিছু পত্রিকা হয়ে টেলিভিশনে। কিন্তু শহর ঘুরতে যখন পানশালা চোখে পড়ত। মনে হতো ঢুঁ দেই। দাদা হয়তো ভেতরে আছেন।

ঢাকার পানশালা দেখার অভিজ্ঞতা দাদার সঙ্গেই। দিনে-রাতে বহুবার দাদার সঙ্গে পানশালায় গিয়েছি। আমি জলজ না হলেও সঙ্গ দিয়েছি দাদা’কে। সেখানে বসে পরিকল্পনা হতো মেলা’র পরবর্তী সংখ্যা নিয়ে। মাঝে পাগলা হাওয়ার মতো ঢুকে পড়ত প্রেম, বিচ্ছেদ। এই দুই নিয়ে দাদা’র বালকপনা দেখেছি কাছ থেকেই। যেমন দেখেছি তার প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা।

আরও পড়ুন : লতা মঙ্গেশকর : না যেও না 

প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে যোগ্য লোক হওয়ার পরেও অবহেলা, বঞ্চনা, কখনো পীড়নে গুটিয়ে পড়তে দেখেছি। ভেঙে যে পড়েননি, সেই মিথ্যেটুকু বলব না। তবে আপস করে হাতের ওপর তৈল হাতের পরশ রাখার রুচি তৈরি হয়নি কখনো তার। তাই তো আজও শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় এখনো চোখটা পোড়ায় সেই মাস্তান সঞ্জীব চৌধুরীর জন্য।

তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী