ছবি : সংগৃহীত

এটা গল্প নয়, সত্য। শচীন টেন্ডুলকার তখন দুর্দান্ত ফর্মে। এনডোর্স-বিজ্ঞাপনের বাজারেও নাম্বার ওয়ান তারকা। ভারতের বিখ্যাত বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রহ্লাদ কাক্কার তাকে নিয়ে একটা বিজ্ঞাপনের থিম তৈরি করেন। শচীন উইকেটে দাঁড়িয়ে ব্যাট করছেন। প্যাড ছাড়া। হাতে ব্যাটের বদলে চামচ। বোলিং অ্যান্ড থেকে বোলার বল করবেন। শচীন হাতে ধরা চামচ দিয়ে বলকে গ্যালারিতে পাঠাবেন। গ্যালারির দর্শকরা আনন্দে চিৎকার করে উঠবে। দৃশ্যটা ঠিক এমনই। 

বিজ্ঞাপনের কনসেপ্ট শুনে সবাই দারুণ উৎসাহিত। কিন্তু স্ক্রিপ্ট এবং আইডিয়া দেখে শচীন বিজ্ঞাপন নির্মাতাকে ডেকে বললেন, এটা তিনি করতে পারবেন না। ছোট একটা চামচ দিয়ে ক্রিকেট বলকে মাঠের বাইরে উড়িয়ে মারার দৃশ্যে হয়তোবা নাটকীয় বীরত্ব আছে। কিন্তু এতে মূলত ক্রিকেটকে ছোট করা হয়। চামচ তো আর ক্রিকেট ব্যাটের সমকক্ষ হতে পারে না। ও প্রান্ত থেকে যিনি বল করছেন তাকেও অপমানিত করা হয়। শচীনের বিনয় এবং ক্রিকেটের প্রতি সন্মানবোধ দেখে বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট পরে বদলে দেওয়া হয়।

এতবড় ক্রিকেটার হয়ে শচীন ঠিকই বিনয়ের অবতার। তিনি জানতেন, বিশ্বাস করতেন এবং মানতেন ক্রিকেটার নয়, ক্রিকেটই বড়! আর আমরা এখনো পড়ে আছি ‘প্রথম পাণ্ডব’; ‘উনি এতদিন ধরে সিলেক্টর কেন’; ‘তুই দেশদ্রোহী’- এমন সব কদাচার কাণ্ডকীর্তি নিয়ে।

আমিই সব, আমিত্বের এমন অসুখে আমিষে ক্রিকেটকে কুৎসিত করছেন আমাদের তারকা, এমনকি মহাতারকাও। একে অন্যের সমালোচনা করতে গিয়ে যা করছেন তা দেখে কলপাড়ায় কলসি নিয়ে মারামারির দৃশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন। 

ক্রিকেটে মিডিয়া তো থাকবেই। খোরাকেরও প্রয়োজন থাকবে। ক্রিকেটের জন্য মিডিয়ায় এখন পৃথক স্লট বরাদ্দ আছে। ডেডিকেটেড স্পেস বরাদ্দ। এই স্লট এই স্পেস প্রতিদিন ভরাট করতে হবে। যখন মাঠে ক্রিকেটের সত্যিকারের পারফরমেন্স থাকবে না, তখন এই স্লট এই ফাঁকা স্পেস ভরাট করার জন্য তুচ্ছ ঘটনাকে বিশাল আকারে লিড বানিয়ে দেওয়া হয়।

শচীন ঠিকই বিনয়ের অবতার। তিনি জানতেন, বিশ্বাস করতেন এবং মানতেন ক্রিকেটার নয়, ক্রিকেটই বড়! আর আমরা এখনো পড়ে আছি ‘প্রথম পাণ্ডব’; ‘উনি এতদিন ধরে সিলেক্টর কেন’; ‘তুই দেশদ্রোহী’- এমন সব কদাচার কাণ্ডকীর্তি নিয়ে।

কারণ? পাবলিক যে ওসবই বেশি খায়! ওতেই যে হিট বাণিজ্য! এ ধরনের তুচ্ছ বিষয় আলোচনায় আসে কখন? স্পটলাইটে আসবে কখন? যখন মাঠে ক্রিকেট নিয়ে করার মতো কিছু নেই বা বলার মতো কিছু থাকবে না।

নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম টেস্টে বাংলাদেশের যে পারফরমেন্স হয়েছে, সেটা যদি পাকিস্তানের সঙ্গে দেশের মাটিতে হতো তাহলে এসব ফালতু এবং অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তার ময়লা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি হতো না। তখন সবাই নিউজিল্যান্ড সিরিজে দলের বিল্ডআপ কী হবে—পারফরমেন্স কেমন হবে, তিন নম্বরে কে সেরা, কেন মমিনুল তিন নম্বরে ব্যাট না করে চার নম্বরে ব্যাট করবেন, একাদশ কেমন হবে—মূলত সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজত। অর্থাৎ পুরোদস্তুর ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা হতো। কিন্তু দুঃখজনক হলো, ক্রিকেট এখন সেকেন্ডারি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গুরুত্বহীন কথাবার্তা যেন আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে প্রথম পাণ্ডব আর কে চতুর্থ, পঞ্চম-এমন সব হিংসুক, হাস্যকর, বুদ্ধিহীন ও বালখিল্য বিষয় ক্রিকেট আলোচনার প্রধান অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

জাতীয় দলের সাবেক দুই অধিনায়ক একে অন্যকে নিয়ে যা বলছেন—সেটা কোনোভাবে ক্রিকেটের শিষ্টাচার, সহনশীলতা, পরিমিতি বোধের সঙ্গে যায় না। অনুজের প্রতি অগ্রজের স্নেহ-ভালবাসা এবং ভুল করলে জুনিয়রকে সেটা শুধরে দেওয়ার যে গুণাবলি ক্রিকেট শিখিয়েছে, তার উল্টোটা দেখছি আমরা!

একইভাবে সিনিয়রদের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা এবং কমান্ড পালনের যে চিরায়িত শিক্ষা ক্রিকেটের অন্যতম অনুষঙ্গ- সেই পরিশীলিত বোধের দুর্ভাগ্যজনক অনুপস্থিতিরও দেখা মিলল আমাদের এখনকার ক্রিকেট অঙ্গনে! কথার লড়াইয়ের এই বিতণ্ডায় কে লাভবান হলো সেই হিসাব খোঁজার আনন্দে দুপক্ষই বাহু ফোলাচ্ছেন। কিন্তু আদতে তো হেরে গেল ক্রিকেট!

সাকিব, নান্নু ও আশরাফুল তিনজনেই সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বাক্যবাণ নিয়ে যে বিতর্কের সূচনা করেছেন, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে আরেকবার জানিয়ে দিল আমাদের অগ্রজ-অনুজদের প্রতি পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ কমে গেছে। আমিত্ব চলে এসেছে।

দেশের ক্রিকেটে এমন কাদা ছোড়াছুড়িতে কোনো পক্ষের পোশাকই সাদা থাকছে না। অযাচিত সমালোচনার সুচে উভয় পক্ষের সম্মানহানি ঘটছে। কোনো কালেই কেউ কিন্তু পুরোপুরি পারফেক্ট হয় না। তাই বলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে একাল এবং সেকালে তাদের কারোরই কোনো অবদান নেই—এমন ভাবনাটা নেহাতই ছোটলোকি চর্চা ছাড়া আর কিছু নয়।

সম্মানিত সিনিয়র-জুনিয়রদের একে অন্যকে অশ্রদ্ধা, শ্লেষ্মাভরা মন্তব্য এবং প্রথম পাণ্ডব হওয়ার পাঁয়তারা দেখে অনেকে মুখটিপে ‘বাচ্চালোগ তালিয়া বাজাও’ বলে মজা নিচ্ছেন। সুন্দর ক্রিকেট ক্রমশ কুৎসিত হয়ে যাচ্ছে! 

মিনহাজুল আবেদিন নান্নুকে অস্বীকার করলে বাংলাদেশের ক্রিকেট হয় না। ঠিক একই রকমভাবে মোহাম্মদ আশরাফুলকে অস্বীকার করলেও বাংলাদেশের ক্রিকেট স্বীকৃতি পায় না। দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসের বাঁকে এদের প্রত্যেকের অবদান আছে। প্রত্যেককেই তাদের প্রাপ্য সম্মানটা দেওয়া উচিত। 

সাকিব, নান্নু ও আশরাফুল তিনজনেই সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বাক্যবাণ নিয়ে যে বিতর্কের সূচনা করেছেন, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে আরেকবার জানিয়ে দিল আমাদের অগ্রজ-অনুজদের প্রতি পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ কমে গেছে। আমিত্ব চলে এসেছে। 

এই আমিত্ব প্রদর্শনের সময় কখন আসে? যখন স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষ নিজেকে জাহির করতে চায়, তখন। নিজেকে জাহির করতে গিয়ে অন্যকে খাটো করার একটা সুখ অনুভব করেন অনেকে। অথচ তারা ভুলে যান এটা মোটেও সুখ নয়, মানুষের মজ্জাগত অসুখ! আমিত্বের অসুখ! অথচ ক্রিকেটের শ্লোগান হলো আমি নয়, আমরা! সেটা আমরা বলি ঠিকই, মানি ক’জনা? 

এম. এম. কায়সার ।। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, রাইজিংবিডি; ক্রিকেট বিশ্লেষক