ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার একজন ব্যবসায়ী ফেসবুকে লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছেন। গণমাধ্যমে উঠে আসা নানা তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া যায়, এটা ঠাণ্ডা ও স্থির মাথায় আত্মহত্যা। মানসিক সুস্থতায় আমি সে অনাকাঙ্ক্ষিত ভিডিওটি দেখিনি। কিন্তু ঢাকা পোস্টের খবর মতে, তিনি লাইভে বলেছেন, গত ৩০ তারিখ আমার খালা মারা যান। ওনার একটি মাত্র ছেলে, মৃত্যুর খবর পেয়েও সে দেশে আসেনি। এ বিষয়টি আমাকে অনেক দুঃখ দিয়েছে।

‘আমার একটা ছেলে আছে, সে অস্ট্রেলিয়াতে থাকে, আমি আমার বাসায় সম্পূর্ণ একা থাকি। খালা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার ভেতরে ভয় ঢুকে গেছে। আমি যদি আমার বাসায় মরে পড়ে থাকি, আমার মনে হয় না এক সপ্তাহেও কেউ জানতে পারবে।’ জানা গেছে তিনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, কিন্তু নানাভাবে নানা জনের কাছ থেকে প্রতারিত হয়েছেন, তার স্ত্রী ও ছেলে অস্ট্রেলিয়া থাকে।

তার মানে সমাজের তথাকথিত ‘সফল’ ব্যক্তিরাও সম্মানজনক বা স্বাভাবিক মৃত্যু ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না। দেশের উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশ হয়েও ভদ্রলোক বছরের পর বছর ধরে থাকছেন একা!

আমরা যে সংস্কৃতি ও আবেগের মানুষ পরিবার ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব। আমাদের বাবা-মায়েরা একটা বয়সে দাম্পত্য জীবন উপভোগ করেছেন। মধ্য বয়সে তারা সন্তানের জন্য বউ নিয়ে পরিবার পূর্ণ করার কথা ভাবেন, শেষ বয়সে তারা সঙ্গী করেন নাতি নাতনীদের। এসব আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ।

আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে সন্তানহীন, পরিবারহীন, একা ফ্ল্যাটে বাস করতে জানি না। আমরা শেষ বয়সে সঙ্গীহীন হয়ে পুনরায় বিয়ে করতে জানি না। পারিবারিক কাঠামো মূল্যবোধে আমরা পশ্চিমা থেকে ভিন্ন। কিন্তু আমরা পশ্চিমা পরিবার কাঠামো ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবোধের অতিরিক্ত চর্চা করতে গিয়ে পারিবারিক কাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছি। ফলে মধ্য বয়স থেকে আমাদের বাবা- মায়েদের বয়সীরা হয়ে পড়ছেন একা, সম্পূর্ণ একা।

আত্মহত্যা করা ভদ্রলোক অভিযোগ করেছেন, তিনি তার জীবনের সমস্ত অর্জন সন্তানদের পেছনে ব্যয় করেছেন। আমাদের সব বাবারাই তাই করেন, আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তো আমাদের পরিবার নিশ্চিত করে। পশ্চিমা দেশের মতো রাষ্ট্রের কাছে বিমা নিয়ে শেষ বয়স পার করার সংস্কৃতিতে আমরা অভ্যস্ত নই।

আমাদের বাবারাও টাকা জমান না, গড়ে তোলেন সন্তানদের, ভাবেন সন্তানরাই তাদের ভবিষ্যতের বিমা। কিন্তু সেসব সন্তানরা ক্যারিয়ারের মোহে ইউরোপ পাড়ি দিয়ে হয়ে উঠছেন ‘ইউরোপীয়’। মনে করছেন বাবা মায়েদের প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই, আবেগ রাখা আনস্মার্টনেস, এমনকি বাবা মায়েদের খোঁজখবরও নেন না। নিজেরা নতুন সংস্কৃতিকে নতুন পরিবার খোঁজে নেন।

গত বছর দেশের স্বনামধন্য একজন অধ্যাপক ও কলামিস্টের লাশ উত্তরার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়। তার স্ত্রী সন্তানও উন্নত দেশে থাকতেন। স্ত্রী সন্তানহীন মৃত্যু, ফ্ল্যাট ভেঙে লাশ উদ্ধার এসব তো কোনদিন আমাদের সংস্কৃতিতে ছিল না। নিজেদের ইউরোপীয় করে তোলার বাসনায় আমরা বড় পরিবার ভেঙে ছোট পরিবার গড়ে তুলছি, ছোট পরিবার থেকে করছি একক পরিবার।

পরিবারের একেকজন থাকছি একেক দেশে। আত্মীয়স্বজন বাসায় আসলে বিরক্ত হচ্ছি। ইউরোপীয় কায়দায় একটি সন্তানের জনক বা জননী হওয়াকে মনে করছি স্মার্টনেস, ভদ্রলোকি কারবার। অথচ আমরা গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছে যেমন অভ্যস্ত জাতি তেমনই বাড়ি ভর্তি পরিবারের লোকজনে অভ্যস্ত। ফলে আমরা যেটাকে স্মার্টনেস মনে করছি, যেটাকে মনে করছি ক্যারিয়ার সেটা আদৌ তেমন কিছু কি না ভাবার সময় এসেছে।

যে বয়সে সন্তানরা বাবা মায়েদের একা করে দিচ্ছে সে বয়সেই বাবা মায়েদের সঙ্গী বেশি দরকার। মানুষের যত বয়স হয় তত একা হয়ে যায়, বন্ধুবান্ধব কমে যায়। ফলে মানুষের শেষ বয়সেই পরিবারকে বেশি দরকার। শুধু জৈবিক চাহিদা নয়, মানবিক স্পর্শের জন্য একে অপরের পাশে থাকতে হয়। 

সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্যমতে, গত বছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে। অনুসন্ধানে আত্মহননের পেছনে ‘সম্পর্ক নিয়ে জটিলতা’ ও ‘আর্থিক সমস্যাসহ’ বেশ কয়েকটি কারণ ওঠে এসেছে। এরমধ্যে ‘পারিবারিক সমস্যা’ এবং ‘হতাশাও’ রয়েছে।

আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬২জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২জন, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তার মানে দেশের শীর্ষ মেধাবীরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।

আচঁল ফাউন্ডেশনের আরেকটি তথ্য বলছে, ২০২০ সালে সারাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬জন নারী-পুরুষ। পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট এসব আত্মহত্যার ঘটনার মূল কারণ।

বেশকিছু উন্নত দেশে আত্মহত্যার হার ব্যাপক হলেও জাপানকে আত্মহত্যা প্রবণ দেশ হিসেবে আমাদের দেশে আলোচনা করা হয়। জাপানে আত্মহত্যা করার সাথে সরকারের পক্ষ থেকে পরিবারকে বিমার অর্থ দেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবে সেখানে আত্মহত্যা পাপ না। জাপানে ‘সম্মানজনক আত্মহত্যা’র একধরনের ঐতিহ্য রয়েছে। ফলে ওদের প্রেক্ষিত ও আমাদের প্রেক্ষিত আলাদা।

জীবন কোনোভাবে লটারি নয়, জীবন সবসময়ই সংগ্রামের। যাপিত জীবনের সবারই উত্থান পতন থাকে। এই সময়টাতে আমরা আপনজনদের কাছে সাহস খুঁজি, আশ্রয় খুঁজি। কিন্তু আমাদের একে অপরের প্রতি সহমর্মী হওয়ার বাসনা কমে যাচ্ছে। একে অপরের দুঃখে পাশে থাকছি না। অন্যদিকে আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ ভয়ংকর ভুল ধারণা রয়েছে।

চোখের দাঁতের বিশেষায়িত ডাক্তারের চেম্বারে আমরা যেতে অভ্যস্ত হলেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা কথা বলি না। মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা বলতেই আমরা বুঝি লোকটা ‘পাগল’। এই ধারণা বদলাতে হবে।

শারীরিক সুস্থতার চেয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা কোনো অংশে কম নয়। আমি পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে দুইবার চিকিৎসা করতে গেছি, দু’বার আমার শারীরিক চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছে। শরীর ও মন একে অপরের পরিপূরক। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের ধারণা বদলাতে হবে। শুধু তা নয়, আমাদের সংস্কৃতির যে পারিবারিক উৎসব, উদ্দীপনা তা ফিরিয়ে আনতে হবে। পরিবার নিয়ে বাঁচতে হবে, সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে, নতুন করে বাঁচতে হবে। মোদ্দকথা বাঁচতে হবে, বাঁচার মধ্যেই আমাদের জন্মের সার্থকতা।

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন ।। শিক্ষার্থী, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি