ছবি : সংগৃহীত

‘আমাদের লতা’—এটা বলার গৌরব এবং অধিকার লতা মঙ্গেশকরের ক্ষেত্রে বোধহয় সব চাইতে বাঙালির-ই আছে। বাঙালির শৈশব-কৈশোর, এমনকি প্রৌঢ়ত্ব জীবনেও তার মতো দাপুটে ক্ষমতা কোনো সংগীতশিল্পীর ছিল না। বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে গভীর যোগ ছিল লতা মঙ্গেশকরের।

আমবাঙালি লতা মঙ্গেশকরের পরিজন হয়ে উঠেছে তার বাংলা গানের মায়ায়। বাংলার প্রতি তার সখ্যতা একটু বেশিই ছিল। বারবার বলেছেন সে-কথা। লিখেও গিয়েছেন। মনে করতেন, মারাঠি আর বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত মিল রয়েছে। বাংলার সঙ্গে একাত্ম বোধ করেছেন নানাভাবে।

লতা মঙ্গেশকরের বাবার ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার প্রিয় লেখক। রবীন্দ্রনাথের গান তার পাথেয়। সুস্পষ্ট ও ঝরঝরে বাংলা উচ্চারণেই তিনি বলতেন—‘বাংলা ভাষা খুব প্রিয়, কিন্তু শিখেও আমি বলতে পারি না!’

মারাঠি ভাষার শিল্পী লতা মঙ্গেশকরকে বাংলা গান গাওয়ানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। ১৯৫৬ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে’ গানটি লতার গাওয়া প্রথম বাংলা গান। পরবর্তীতে বহু সুরকারের সুরে তিনি বাংলা গান গেয়েছেন। বাংলা মৌলিক গানের প্রচুর রেকর্ড করেছেন লতা।

বাংলার বহু সুরকারের সুরে গেয়েছেন। পাশাপাশি গেয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের জন্যও। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’, সলিল চৌধুরীর কথা-সুরে ‘না যেও না’র মতো অবিস্মরণীয় সব বাংলা গান রেখে গিয়েছেন লতা। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে তার গাওয়া ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ বাঙালির স্মৃতির কুয়াশা-আস্তরে জেগে থাকা আকাশ প্রদীপই।

লতা মঙ্গেশকরের বাবার ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার প্রিয় লেখক। রবীন্দ্রনাথের গান তার পাথেয়। সুস্পষ্ট ও ঝরঝরে বাংলা উচ্চারণেই তিনি বলতেন—‘বাংলা ভাষা খুব প্রিয়, কিন্তু শিখেও আমি বলতে পারি না!’

পশ্চিমবঙ্গের অনেক শিল্পী ও সুরকারের সঙ্গে লতার সুসম্পর্ক থাকলেও হেমন্তর সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল সবচেয়ে নিবিড়। দুই পরিবারের মধ্যেও ছিল সুসম্পর্ক। লতার মা ও ভাইবোনেরা ভালোবাসতেন হেমন্তকে। হেমন্তর স্ত্রী বেলা দেবীর সঙ্গেও লতার বন্ধুত্ব ছিল। সলিল চৌধুরী, রবীন চট্টোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত, এমনকি কিশোর কুমারের সুরেও গান গেয়েছেন লতা।

তার সাত দশকের দীর্ঘ কর্মময় জীবনে এক হাজারের বেশি হিন্দি সিনেমার গান রেকর্ড করেছেন। মোট ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে তার রেকর্ড করা বাংলা গানের সংখ্যা ১৮৬টি। নিজের বাংলা উচ্চারণ সঠিক করার জন্য বেশ পরিশ্রম করেছেন তিনি। এ বিষয়েও তাকে সহযোগিতা করেছেন হেমন্ত। বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় বাংলায়ই কথা বলার চেষ্টা করতেন লতা।

হেমন্ত যখন তাকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়াচ্ছেন, তখন তার ‘হেমন্তদা’র কাছ থেকে বুঝে নিচ্ছেন সে-গানের মর্মার্থ, অনুষঙ্গ এবং ইতিহাস। হেমন্ত’র প্রযোজনায় হিন্দি ও বাংলা সিনেমায় গান গেয়ে কোনোদিন পারিশ্রমিক নেননি লতা।

‘আনন্দমঠ’ ছবিতে ‘বন্দেমাতরম’ গাওয়ার জন্য কত টাকা লাগবে জানতে চাওয়ায় হেমন্তকে বলছেন, ‘টাকার জন্য নয়, আপনি বলেছেন বলে গাইছি।’ বাংলা সাহিত্য নিয়েও তার আগ্রহ ছিল। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্রসহ অনেকের মারাঠি অনুবাদ পড়েছেন। বাঙালি খাবারের প্রতিও ছিল দুর্বলতা। 

পীযূষ বসুর ‘সুভাষচন্দ্র’ ছবিতে ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’-র মতো ইতিহাস, মাইলফলক হয়ে যাওয়া গানেও তিনি। ছবিতে এক দৃষ্টিহীন ব্যক্তি একতারা বাজাতে বাজাতে যাচ্ছেন তার কন্যার সঙ্গে এবং সেই নাবালিকা গাইছে অমর সংগীত। যা শুনে বালক সুভাষচন্দ্রের মধ্যে দেশাত্মবোধের উন্মেষ হবে।

লতার ওই গান শুনলে বাঙালি চেতনা দ্রোহের আগুন জ্বলে, অনেকে ভাবেন—খোদ ক্ষুদিরাম বসুই ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে ওই গান গেয়েছেন। এবং সেই দৃশ্যকে কল্পনা করে আমাদের চোখের জল পড়ে অঝোর ধারায়। দেশপ্রেমের গানে এই স্তরে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।

‘আনন্দমঠ’ ছবিতে ‘বন্দেমাতরম’ গাওয়ার জন্য কত টাকা লাগবে জানতে চাওয়ায় হেমন্তকে বলছেন, ‘টাকার জন্য নয়, আপনি বলেছেন বলে গাইছি।’ বাংলা সাহিত্য নিয়েও তার আগ্রহ ছিল।

লতা মঙ্গেশকর বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের সহযোগী ছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি তার একটা টান ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় শুরু থেকেই বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছেন, পাশে থেকেছেন এবং নানা ধরনের কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, সেখানেও এ মানবতাবাদী মানুষটিকে দেখতে পাওয়া যায়। হয়তো অনেকেই জানেন না, লতা মঙ্গেশকর মোটা অঙ্কের টাকা দান করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য।

এ প্রসঙ্গে মৃন্ময়ী বোসের একটা লেখার কথা বলতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে তিনি গিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকরের কাছে। তিনি তাদের বসিয়ে রেখে ভেতরের রুমে গেলেন। বেরিয়ে আসলেন চেকবই নিয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে দান করলেন ১ লাখ টাকা। ১৯৭১ সালের ১ লাখ টাকা! বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, সেই টাকাটা কত বড় অঙ্কের ছিল।

মৃন্ময়ী বোসকে অবাক করে দিয়ে লতা মঙ্গেশকর আরেক ধাপ এগিয়ে গেলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, তার কিছু গানের রয়্যালিটির টাকা মুক্তিযুদ্ধের জন্য তিনি দান করতে চান। যতদিন মুক্তিযুদ্ধ চলবে ততদিন কিছু গানের রয়্যালিটি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে জমা হবে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তার জন্য ভারতীয় অনেক শিল্পীই এগিয়ে এসেছিলেন। তারা গান গেয়ে তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বব্যাপী সচেতনতা।

১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর মুম্বাইয়ের ব্রাবোর্ন স্টেডিয়াম (Brabourne Stadium)-এ বাংলাদেশের সমর্থনে একটি বড় তারকা সমাবেশ হয়েছিল। সেই সমাবেশে লতা মঙ্গেশকর গান গেয়েছিলেন। সমাবেশে আরও ছিলেন—আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি, মান্না দে, মহেন্দ্র কাপুর, শচীন দেববর্মনসহ হিন্দি চলচ্চিত্র ও সংগীত জগতের প্রখ্যাত সব শিল্পী।

১৯৭২ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরে প্রখ্যাত অভিনেতা সুনীল দত্তের নেতৃত্বে ভারতের একটি সাংস্কৃতিক দল অজন্তা শিল্পীগোষ্ঠী নামের বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেই দলে লতা মঙ্গেশকরও ছিলেন। ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরে করা টুইটারে সে কথা স্মৃতিচারণ করেছিলেন। 

লতা লিখেছিলেন—‘নমস্কার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতেই আমি সুনীল দত্তের গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশ গিয়ে অনেক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলাম। সে সময়ে সেনাবাহিনীর উড়োজাহাজে করে সব জায়গায় গিয়েছিলাম।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ভারতে গিয়েছিলেন, তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে গিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকরও। সলিল চৌধুরীর সুর ও সংগীতে বাংলাদেশের একটি সিনেমায়ও গেয়েছিলেন লতা।

১৯৭২ সালে নির্মিত মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ সিনেমার গানটি ছিল ‘দাদাভাই মূর্তি বানাও’। বাংলাদেশের রুনা লায়লার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল লতার। বাংলা গানের ইতিহাসে ‘আমাদের লতা’ এক চিরকালীন অধ্যায়, যার বিদায় নেই।

হাবীব ইমন ।। সাংবাদিক